শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু

‘আকাশের নীল দরজা খুলে’ এসেছিলেন এই জাদুকর

ড. আতিউর রহমান

‘আকাশের নীল দরজা খুলে’ এসেছিলেন এই জাদুকর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের আরেক নাম। এখন থেকে শতবর্ষ আগে এই বাংলাদেশ এবং বিপুলা বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করার জন্য জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার এক নাম না জানা গ্রামে। গ্রাম বাংলার আলো-ছায়ায় বেড়ে ওঠা শেখ মুজিব যে একদিন এক জাদুকরে রূপান্তরিত হবেন এবং আমাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেবেন তা কজনাই বা জানতেন। এমন এক সময়ে তিনি জন্মেছিলেন যে সময় আমাদের দেশ ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে পরাধীন। সেই পরাধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু নতুন করে যে অবাস্তব দেশটি আমরা পেলাম দ্বিজাতিতত্ত্বের মারপ্যাঁচে তাতে উদারনৈতিক মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযোগীরা মোটেও স্বস্তিবোধ করেননি। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের মন বদল ঘটল। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির আশায় তখন গুড়েবালি। একই সঙ্গে এলো বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর নিপীড়নবাদী রাষ্ট্রের আঘাত। শুরু হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের এক নবযাত্রা। এ অভিযাত্রার নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ল শেখ মুজিবের কাঁধে। কেননা তাঁর মাঝে ছিল আমাদের ‘স্বপ্নের সম্রাট’ হওয়ার জাদুকরি গুণাবলি। হুমায়ুন আজাদ ঠিকই লিখেছেন, ‘এমন একটি বর্বর সময় এসেছিল যখন আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম। এমন সময় এমন অবস্থায় সেই জাদুকর আসে। কোথা থেকে এসেছিল আমরা জানি না। তাঁর জাদু আমাদের এত মুগ্ধ করেছিল যে আমরা সবাই বলাবলি করতাম জাদুকর এসেছে আকাশের নীল দরজা খুলে, কারও মনে মাটির নিচে একটা সোনার জগৎ আছে সেখান থেকে, কারও মতে সমুদ্রের জগৎ আছে সেখান থেকে, কারও মতে সমুদ্রের ভিতর থেকে এসেছিল। আমরা, বর্বররা আসার পর মুগ্ধ হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম, হারিয়ে ফেলেছিলাম রহস্য দ্বারা আলোড়িত হওয়ার ক্ষমতা। জাদুকর ফিরিয়ে দেয় সেই শক্তি-মুগ্ধ হওয়ার রহস্য অনুভব করার অলৌকিক শক্তি।’ (‘জাদুকরের মৃত্যু’, জনকের মুখ, সম্পাদনা আখতার হোসেন, কথা প্রকাশ, ২০১৫, পৃ. ১৭৮)।

এই জাদুকরের কাছে আমাদের ঋণ অশেষ। সেই জাদুকরের শৈশব-কৈশোর কেমন ছিল? নানা অসুখ-বিসুখ মোকাবিলা করে একটু বেশি বয়সেই শেখ মুজিব ১৯৩৭ সালে ভর্তি হলেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে।

এখানে তাঁর জীবনে দুটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। এক. বাড়িতে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হলো কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টার সাহেবকে। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মুষ্টি ভিক্ষা চাল ওঠাতেন সব মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার তারা থলি হাতে বেরোতেন বাড়ি বাড়ি থেকে চাল সংগ্রহ করতে। এ চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই, পরীক্ষাসহ অন্যান্য খরচ জোগাড় করা হতো। হঠাৎ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে হামিদ মাস্টার মারা গেলেন। তখন সেবা সমিতির ভার পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। অন্য একজন শিক্ষকের কাছে টাকা-পয়সা জমা রাখা হতো। তিনি ছিলেন সভাপতি, শেখ মুজিব সম্পাদক। এ অভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে। তাই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এমন দক্ষ এক সংগঠক। হতে পেরেছিলেন এতখানি মানবিক।

আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ১৯৩৮ সালের। শেরেবাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী, সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। সহপাঠীদের তুলনায় একটু বড় হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। সভা শেষে হক সাহেব গেলেন পাবলিক হল দেখতে। আর শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। শেখ মুজিব দলবল নিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দিলেন এবং জানালেন, স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কথা। তাই তাঁকে ওয়াদা করে যেতে হবে যেন ছাদ শিগগিরই ঠিক করে দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী এই তরুণতুর্কির কথায় চমৎকৃত হলেন। স্কুল পরিদর্শন শেষে সোহরাওয়ার্দী লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। মুজিবও তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলেছেন। যেতে যেতে সোহরাওয়ার্দী ভাঙা ভাঙা বাংলায় মুজিবের নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। এক সরকারি কর্মচারী মুজিবের নাম বলে তাঁর বংশ পরিচয়ও দিলেন। বহু বছর পরে শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায় বসে লিখছেন সেসব স্মৃতিকথা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এই অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এভাবে, ‘তিনি আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?” বললাম, কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম লীগও নাই। তিনি আর কিছুই বললেন না, শুধু নোটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমিও তাঁর চিঠির উত্তর দিলাম। এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম।’

সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর পরবর্তী দেখা হয় ১৯৩৯ সালে কলকাতা বেড়াতে গিয়ে। তারপর ১৯৪০ সাল থেকেই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। গোপালগঞ্জেই মুজিব তখন নবীন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এভাবেই সূত্রপাত হয় দুই গুরু-শিষ্যের বর্ণিল এক রাজনৈতিক যুগলবন্দীর। ১৯৪২ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করে মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তখন তাঁদের যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়।

অনেকেই এসব কথা জানেন। তার পরও একটু বিস্তৃত আকারে বললাম এজন্য যে একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনা কীভাবে সংযুক্ত হয়ে যায় সে কথাটি স্পষ্ট করার জন্য। ইতিহাসের ভালোমন্দ কে নির্ধারণ করতে পারে! আমরা তো সবাই শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের সন্তান। আজ এখানে দাঁড়িয়ে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু, শতবর্ষ আগের ঘটনাগুলো স্রেফ গল্প-উপন্যাসের চরিত্র বলেই মনে হয়। ছোটবেলায় যদি শেখ মুজিবুর রহমানের চোখ খারাপ না হতো তাহলে তাঁর পড়াশোনায় দেরি হতো না। তাহলে হয়তো তিনি স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গড়ার দায়িত্বও পেতেন না। স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি না পড়লে সেদিন হয়তো সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর এত কথা বলারও প্রয়োজন হতো না। এই একটি ঘটনা একটি জাতির ইতিহাসকে কীভাবে বদলে দিল! যার জন্য আজ আমরা এখানে তাঁকে নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি।

ঘটনার পরম্পরা কোন দিকে বাঁক নেয় তা বলা মুশকিল। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে না এলে হয়তো দেশভাগও হতো না। বাংলা কোনো দিন ভাগ হবেÑ এ তো দুঃস্বপ্নেও কেউ কল্পনা করেনি। বাংলা প্রথম ভাগ হলো ১৯০৫ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজরা বুঝতে পারল বিশাল বাংলা একসঙ্গে থাকলে বিপদ। যে কোনো মুহূর্তে প্রবল বিদ্রোহে ইংরেজ সাম্রাজ্য ধসে পড়তে পারে। তারপর তো দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালে দুই বাংলা আড়াআড়ি খাড়াখাড়ি ভাগ করে দিল, রাতারাতি। তবে এর পেছনে আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভুললেও চলবে না। মূলত, কৃষিভিত্তিক পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের আকাক্সক্ষার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি। এসব টানাপোড়েনের প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। তারপর আমাদের জীবন কীরকম উলট-পালট হয়ে গেল তা তো ব্রিটিশদের বোঝার কথা নয়। তা বুঝেছি আমরা, হাড়ে হাড়ে, জীবন দিয়ে। লোটাকম্বল গুছিয়ে এক দেশের মানুষকে ছুটতে হলো আরেক দেশে। দেশভাগের সেই গভীর ক্ষত আজও পুরোপুরি শুকায়নি।

এ কথা সত্য, তরুণ শেখ মুজিবও প্রথমে দেশভাগের পক্ষে ছিলেন, মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝে যান ১৪০০ মাইল ব্যবধানে যে অস্বাভাবিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তা বেশি দিন টিকবে না। ১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর পিছু নেয়। তাঁর বক্তব্যে তারা দেখতে পায় বিদ্রোহের সুর। তাই তাঁকে সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় রাখে। ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে প্রতিটি সভা-সেমিনারে, মিছিলে-মিটিংয়ে। ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ তাঁর নামে ১৯৪৮ সালে একটি ব্যক্তিগত ফাইল খোলে এবং তাতে সব তথ্য সংরক্ষণ করা শুরু করে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স¤পাদনায় সেই গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর দুটি ভলিউম প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও ১২টি খণ্ড। প্রথম ভলিউমে সংকলিত হয়েছে ১৯৪৮-৫০ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন। সদ্যগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে শেখ মুজিব কী চোখে দেখছেন তার প্রমাণ এখানে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগই রেখে দিয়েছে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অনেক কথারই প্রতিধ্বনি এসব প্রতিবেদনে দেখতে পাই।

১৪ আগস্ট, ১৯৪৮ ছিল পাকিস্তানের প্রথম ‘আজাদি দিবস’। এক বছরের আজাদিকে তরুণ শেখ মুজিব কী চোখে দেখছেন তা জানা যাক : ‘১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমরা যে আজাদী লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণআজাদী নয়, তা গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। “জাতীয় মন্ত্রিসভা” দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কোনো চেষ্টা তো করেন নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপাইয়াছেন। ভুখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত ও শত অভাবের ভারে ন্যুব্জ জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্য-ব্যবহার্য দ্রব্যের কোনো ব্যবস্থা তাঁরা করেন নাই; বরঞ্চ পাট, তামাক সুপারী ইত্যাদির ওপর নয়া ট্যাক্স বসাইয়া ও বিক্রয়-কর বৃদ্ধি করিয়া জনগণের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছেন। বিনা খেসারতে জমিদারি বিলোপের ওয়াদা খেলাফ করিয়া তাঁরা জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদিগকে পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতেছেন। নতুন জরিপের নাম করিয়া তাঁরা জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছর স্থগিত রাখার ষড়যন্ত্র করিতেছেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অসিলায় তাঁরা অনেক দেশভক্ত লীগ-কর্মীকেও বিনাবিচারে কয়েদখানায় আটকাইয়া রাখিতেছেন। রাষ্ট্র্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের উপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার উপর লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার ও গুলি চালনা করিয়া তারা আজাদীকে কলঙ্কিত করিয়াছেন।’ (সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ ভলিউম-১, হাক্কানী পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৪৪)।

যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের হাত ধরে দেশভাগ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সমমনা সহযোগীরা দ্রুতই তা থেকে সরে এসে উদারনৈতিক ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদেও রূপান্তরের বীজ বপন করতে শুরু করলেন। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যে কত উগ্র হতে পারে তা বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছেন এই কলকাতা শহরেই। তখন তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। বেকার হোস্টেলে থাকতেন। সোহরাওয়ার্দীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সোহরাওয়ার্দী তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। দেশভাগকে কেন্দ্র করে ১৯৪৬ সালে যে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয় তার বিস্তৃত বর্ণনা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়!’ (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, পৃষ্ঠা-৬৬)।

সাত-আট পৃষ্ঠাজুড়ে বঙ্গবন্ধু সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। পড়তে গিয়েও গা শিউরে ওঠে। কী ভয়াবহ দমবন্ধ করা পরিবেশ। তাদের পরিবারের ছয় ভাইবোনের পাঁচজনই তখন কলকাতায়। সবার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগও করা যাচ্ছে না। কখন কী হয়! দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতা থেকে ঢাকায়, নোয়াখালীতে, বিহারে। স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নিয়ে তিনি তখন রওনা দিলেন পাটনায়। পরিচালনা করেন ত্রাণশিবির। দাঙ্গা আক্রান্তদের দুঃখ-দুর্দশা তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। আর এভাবেই বেড়ে ওঠেন মানবিক শেখ মুজিব।

শুধু ’৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, শেখ মুজিব ছিলেন ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষীও। এবারেও তিনি আরও বেশি সক্রিয়। বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়ে যান সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। আওয়াজ তোলেন এ অপশক্তির বিরুদ্ধে ‘রুখে দাঁড়াও’। ‘১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় একতরফাভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুটপাট, নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা। মানবতাবিরোধী এ হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় কাশ্মীরে হযরতবাল মসজিদ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চুল হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রীয় বা কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে এ দুর্ঘটনাকে প্রকাশ্যে হিন্দু কাফেরদের কীর্তি বলে অভিযোগ আনে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, তারা সম্পত্তি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। খুলনা অঞ্চলে দাঙ্গার সূচনা ঘটলে খুব দ্রুত তা গোটা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ৭ জানুয়ারি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।... ... নারায়ণগঞ্জে ১৪ জানুয়ারি দাঙ্গা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে শেখ মুজিবুর রহমান উন্মুক্ত জনতাকে নিবৃত্ত করতে ছুটে যান এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত শত শত হিন্দু শ্রমিককে দেখতে যান। ১৫ জানুয়ারি ঢাকার ওয়ারিতে হিন্দুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সময় তিনি দাঙ্গাবাজদের আক্রমণের মুখে পড়েন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, মোনায়েম সরকার (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমি, ২০০৮, পৃষ্ঠা-৩০৯)।

আগের এবং এবারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়েই তিনি অর্জন করেন অসাম্প্রদায়িক অহিংস চেতনার মূলসূত্র; যা তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের যে চার মূলনীতি যুক্ত করেছিলেন তার একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যই ছিল তাঁর সারা জীবনের পাথেয়। আর এ ক্ষেত্রে তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুলও ছিলেন তাঁর এই আধুনিক চেতনার আরেক উৎস। তিনি যে কতখানি গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছিলেন তা তাঁর নিজের লেখনীতে যেমন আছে, তেমন তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরাও বলেছেন। নান্দনিক বঙ্গবন্ধু নামে একটি বই লেখার কাজে সম্প্রতি আমি বাংলাদেশের অনেক সংস্কৃতিজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কামাল লোহানী, বিশিষ্ট অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই একটা কথা বলেছেন, অনেক কথার উত্তরে রবীন্দ্রনাথের কোনো গান-কবিতা থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধৃতি দিতে পারতেন বঙ্গবন্ধু। কবিগুরুর চিন্তা-চেতনাকে তিনি ধারণ করতেন। তাই তাঁর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’কে আমাদের জাতীয় সংগীত করার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পেরেছিলেন দেশ স্বাধীনের পরপরই। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, কারাগারের নিভৃত কোণে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’। আপদে-বিপদে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে বল-ভরসা পেতেন। ১৯৬৬ সালের ২৪ জুলাই কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘বারবার আমার আব্বা ও মা’র কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সঙ্গে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানেও কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।

“বিপদে মোরে রক্ষা করো

এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি না যেন করি ভয়”।’

(শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০১৭, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা- ১৭৯)।

আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, আজ আমরা স্বাধীন দেশে মুজিববর্ষ পালন করতে পারছি। একটি জাতির জন্ম দিতে গিয়ে সারাটা যৌবনকাল তাঁর কেটেছে জেলখানায়। স্বাধীন দেশেও তিনি এক মুহূর্ত শান্তিতে বসতে পারেননি। সারাক্ষণই ছোটাছুটি, কর্মব্যস্ততা। সমাজ ও অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড। মুক্তিযোদ্ধা তথা তরুণদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা উধাও। শিল্পকারখানা বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। রেল, সেতু, সড়ক, সমুদ্রবন্দর বিধ্বস্ত। তাই দেশ গড়ার জন্য তিনি সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। সব কাজ সেরে বেশ রাত করে ঘরে ফিরতেন, আর খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই বসার ঘরে জমা হতেন অনেক লোক। তাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি ৩২ নম্বরের বাড়িতেই থাকতেন। একজন সাধারণ মানুষের মতোই তাঁর চলা-বলা।। প্রাতরাশ সেরে অনেক দিন লুঙ্গি পরেই পাইপ মুখে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেন নিচের বসার ঘরে। একদিন মাঝরাতে সেই সিঁড়ি দিয়ে শেষবারের মতো নেমে আসেন। সেদিন তাঁর জন্য আর কোনো অতিথি নয়, শুভাকাক্সক্ষী নয়, অপেক্ষা করছিল একদল খুনি। নিজের হাতে গড়া দেশ তিনি আর স্বনির্ভর দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই খুনিরা তাঁকে শারীরিকভাবে তাঁর দেশের মানুষদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমার বইয়ে ইচ্ছা করেই আমি এ অধ্যায়টি লিখিনি। বঙ্গবন্ধু নেই, এ কথা আমি ভাবতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি তিনি এখনো আমাদের সঙ্গেই আছেন। তাঁর সাহসে, প্রেরণায় ভর করেই আমরা এখন এগিয়ে যাচ্ছি। আর আমাদের এই এগিয়ে যাওয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ এক দেশ। উন্নতির মহাসড়ক ধরে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

শুধু স্বদেশের উন্নতি নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মতোই সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁরই সুনিপুণ দিকনির্দেশনায় ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বও আজ অন্য উচ্চতায়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সম্মিলনের গোড়াপত্তন বঙ্গবন্ধুই করে দিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য বারবার তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ও শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্য ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে কলকাতা সফর করেন। বাংলাদেশের সরকারের প্রধান হিসেবে এটাই ছিল প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। সেই সফরের সময় উভয় দেশের মধ্যে আন্তরিক ও উষ্ণতার উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তি পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে। ভারত-বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আর সাম্রাজ্যবাদের খেলা চলতে দেওয়া হবে না। বিশ্বের আর কোনো শক্তিই এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিশ্বের ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য এত বড় মূল্য আর কেউ দেয়নি। এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের শেষ মানুষটিও প্রাণপণ সংগ্রাম করবে...

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এশিয়ায় এক নতুন যুগের উন্মেষ ঘটাবে। আমি আমাদের প্রতি ভারত সরকার ও জনগণের ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। আসুন মানবতার সেবায় আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করি।’ (দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের আরেক নাম, আতিউর রহমান, আলোঘর, ২০১৮, পৃষ্ঠা-১৯৬)।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সাল। ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে’ তিনি তাঁর দেশগড়ার যাত্রা করেছিলেন। ঢাকার মাটিকে স্পর্শ করেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের অজেয় প্রাণশক্তিকে কজে লাগিয়ে ‘সোনার বাংলা গড়ার’ প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। মাটি ও মানুষকে পুঁজি করেই তিনি ‘বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন। ওইদিনই মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে হৃদয়ের গহিন তলদেশ থেকে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে তাতে যোগ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে।

আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারও জন্য কোনো বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে।’

বিজয়ের সেই অভিযাত্রা আজও বহমান। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বদলে যাওয়া এক সাহসী বাংলাদেশ। ঠিক যেমনটি বঙ্গবন্ধু প্রত্যাশা করেছিলেন। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীর দিনগণনার এই শুভক্ষণে তাই তাঁর প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।

 

সর্বশেষ খবর