শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ভালোবেসে বিয়ে অতঃপর আইনি ফলাফল!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ভালোবেসে বিয়ে অতঃপর আইনি ফলাফল!

গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরিপাটি চেহারার ভদ্রলোক মামলা করেছেন থানায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই ছাত্র ভদ্রলোকের স্কুলপড়ুয়া নাবালিকা মেয়েকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। অপরাধ খুবই গুরুতর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় ওই ছাত্র অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সহসা জামিনের আশা নেই। কারণ প্রথমত জামিন-অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন শুনানি করার এখতিয়ার নিম্ন আদালতের নেই। সে কারণে অভিযোগকারী ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন আসামিকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে ওই ছাত্র বেচারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। বাড়িতে আছেন কেবল তার মা-বাবা এবং কথিত অপহৃত কিশোরী মেয়েটি। এফআইআরসহ মামলাটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। পুলিশ ওই আসামির বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং আসামির মা-বাবা এবং ওই কিশোরীটিকে উদ্ধার করে আদালতে সোপর্দ করে। মেয়ের পিতা-মাতার দাবি, তাদের মেয়ে অপরিণত বয়সের। ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তার হয়নি। তাই তারা মেয়েটিকে তাদের জিম্মায় দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। মেয়েটির বয়স কম সে বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য সরকারপক্ষ তথা মেয়ের বাবা মেয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক সত্যায়িত একটি সনদপত্র এবং মেয়ের মায়ের একটি এফিডেভিট আদালতে দাখিল করেন। অন্যদিকে মেয়ের কথিত অপহরণকারী ওই আসামির পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীরা বলছেন, মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম শরিয়াহ মোতাবেক তার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক তৎক্ষণাৎ মনস্থির করতে শঙ্কায় পড়ে যান। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো তাঁকে দিতেই হবে। মেয়েটি কোথায় যাবে? বাপের ঘরে নাকি কথিত অপহরণকারী বা স্বামীর ঘরে? এ পর্যায়ে তিনি মেয়েটির বক্তব্য শুনতে চান। মেয়েটি আদালতকে জানায়, আসামি তার স্বামী। তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে কাজী অফিসে রেজিস্ট্রি হয়েছে। সে তার স্বামীকে ভালোবাসে। তাদের বিয়ে উভয় পক্ষের সম্মতিতে করার চেষ্টা হয়েছে। তার স্বামী পারিবারিকভাবে তার পিতা-মাতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অহংকারী পিতা-মাতা বেকার যুবকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হননি। তারা বাধ্য হয়ে নিজেরাই বিয়ে করেছেন। মেয়েটি আরও জানায়, তাকে তার পিতা-মাতার কাছে যেতে বাধ্য করলে তারা তাকে মারধর করবেন, তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাবেন এবং তাকে বাধ্য করবেন স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে। একবার তার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার স্বামীর জেল হবে। এ অবস্থায় তার পিতা-মাতার সঙ্গে যাওয়ার চেয়ে তার মৃত্যু হওয়াই ভালো। এ ধরনের বক্তব্য আদালতে মেয়েটি উপস্থাপন করে। মেয়েটির এ বক্তব্য শোনার পর বিচারক কিছুটা বিভ্রান্ত হন। কী আদেশ দেওয়া যায়? অবশেষে তিনি আদেশ দেন, ভিকটিমের (মেয়েটির) বয়স প্রমাণের পরীক্ষা করার জন্য ভিকটিমকে সিভিল সার্জনের কাছে প্রেরণ করা হোক। দুই দিন পর মেয়েটির বয়স সম্পর্কে প্রতিবেদন পাওয়া গেল। মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেল মেয়েটির বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে, অন্যদিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক যে সনদপত্র দিয়েপ্রণ তাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েটির বয়স ১৫ বছর। আর মেয়েটির মা এফিডেভিট করে বলেছেন, তাঁর মেয়ের বয়স ১৩ বছর। সব মিলিয়ে মেয়েটির বয়স যে কত তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীরা তাঁদের নিজ নিজ দাবির পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিতে যৌনসঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে না। ধর্ষণের এ সংজ্ঞা থেকে সহজেই বোঝা যায়, ১৬ বছর বয়স যে কোনো মেয়ের বিয়ের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স। পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌনমিলনকে এ আইন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তাহলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য, ভিকটিমের বয়স সম্পর্কিত প্রমাণাদি পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা হলো। বিয়ের কাবিননামা দেখা গেল, সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং ভিকটিমের বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করে আদালতের কাছে মনে হচ্ছে যে, ভিকটিমের বয়স ১৬ বছর অতিক্রম করেছে সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায় না। তদুপরি তার বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ঘটনা ও পারিপার্শি¦ক অবস্থা বিবেচনা করে আদালতের কাছে এটিও প্রতীয়মান হয়, ভিকটিম মেয়েটি নিজের ইচ্ছায় তার পিতা-মাতার ঘর ত্যাগ করেছে এবং ফিরে আসার কোনো ইচ্ছা তার মধ্যে আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাই তাকে জুডিশিয়াল হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। তিনি স্বেচ্ছায় যেখানে যেতে চান সেখানে যেতে পারেন, স্বামীর ঘরে কিংবা পিতা-মাতার বাড়িতে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী এবং একজন উপযুক্ত স্থানীয় জামিনদারের জিম্মায় জামিনে থাকবেন।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর