রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষকের মাঠে নবরঙে নারঙি

শাইখ সিরাজ

কৃষকের মাঠে নবরঙে নারঙি

‘নারঙি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কমলা। কমলা নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। অনেক আগে ইংরেজরা আমাদের নারঙি বা নরঙি অর্থাৎ কমলা জাহাজে করে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছিল। তো ইংরেজরা বাক্সের ওপর ইংরেজিতে লিখল NORANGE (নওরঙি)। কিন্তু কোনোভাবে বাক্সের ওপর লেখার ‘N’ বর্ণ মুছে গিয়ে হলো ‘ORANGE’, সেই থেকে কমলার ইংরেজি হয়ে গেল অরেঞ্জ। এ তো প্রচলিত জনমানুষের গল্পকথা। কিন্তু কমলা তার রং ও গন্ধে মানুষের কাছে লোভনীয় সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কোনো বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করলে প্রিয় ফল হিসেবে কমলার নাম হয়তো বলবে না, কিন্তু সাধারণ মানুষ ফল বলতেই বুঝতে চায় কমলা, আপেল আর আঙুর। আর এ ফলগুলোর প্রতি আমাদের শতভাগ আমদানি -নির্ভরতা। আপনাদের ধারণা আছে বছরে কী পরিমাণ কমলা আমরা আমদানি করি? চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমস বিভাগের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমলা-মালটা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৭০ টন। প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকা হিসাবে এর মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে কমলা-মালটা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ১০০ টন। এই সূত্র জানাচ্ছেন, গত পাঁচ বছরে কমলা, মালটা, আপেল ও আঙুর আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশি কমলা বলতেই আমরা বুঝি সিলেটের কমলা। বছর দশেক আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সিলেটে কমলা উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ‘বৃহত্তর সিলেট সমন্বিত কমলা চাষ উন্নয়ন’ নামে আট বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ৮ হাজারের বেশি কমলার নতুন বাগান করার পরিকল্পনা হয়। ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০৬ সালের জুন পর্যন্ত ওই প্রকল্পে চার জেলায় ২৫০টি বাগান তৈরির স্থান নির্ধারণ করা হয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৫ হাজার কমলা চাষিকে। সব মিলিয়ে সিলেট অঞ্চলে ২৮২ হেক্টর জমিতে হয় কমলার চাষ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে সিলেটে কমলার গড় উৎপাদন ১ হাজার ৪৭০ মেট্রিক টন। ২০০৯-২০১০ সালে পঞ্চগড়েও কমলা চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু আশানুরূপ উৎপাদন না হওয়ার পাশাপাশি রঙে, ঘ্রাণে, মিষ্টতায় সেই কমলা খুব একটা পরিচিতি পায়নি। সুস্বাদু আর সুঘ্রাণের জন্য সিলেটের বিয়ানীবাজারের জলঢুপী এলাকার কমলার পরিচিতি ব্যাপক। জৈন্তাপুর সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সিলেট জেলার সদর, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর; মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল; সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার ও হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার টিলা-পাহাড় এলাকায় একসময় কমলার প্রচুর চাষ হতো।

পাঠক! পাহাড়ি এলাকায় কমলার চাষ নতুন কিছু নয়, কিন্তু কমলার চাষ যদি হয় সমতলভূমিতে এবং যদি দেখেন সে মাঠভর্তি কমলার গাছে গাছে কমলা রঙে ছেয়ে আছে পাকা পাকা কমলা, নিশ্চয়ই অবাক হবেন। অবাক হওয়ার মতোই। গত অক্টোবরের শেষ দিকে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার চাঁপাতলার কৃষক রফিকুল জানালেন তিনি কমলা চাষ করেছেন। গাছে গাছে কমলা এসেছে। আমি যেন একবার দেখে আসি। তখন আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতির মেলায় অংশ নিতে চীনে যাচ্ছিলাম। চীন থেকে ফিরে গেলাম ওমরাহ হজে। রফিকুল অপেক্ষা করে থাকলেন। মক্কা থেকে ফিরে তারিখ করলাম রফিকুলের ওখানে যাব। কিন্তু আমার ছোট ভাই শেখ নজরুল ইসলাম মারা গেলেন হঠাৎ করে। আমি রফিকুলকে ফোনে জানালাম এ মৌসুমে হয়তো আর তাঁর বাগানে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু রফিক নাছোড়। বললেন, ‘স্যার আপনি একটু দেখেন, সময় করতে পারেন কিনা। আমি পণ করেছি আপনি না এলে কমলা বাজারে পাঠাব না।’ অবশেষে গত ডিসেম্বরে গিয়ে হাজির হলাম রফিকুলের বাগানে। গাছে গাছে পাকা কমলা। যথার্থ রঙিন ও বড় আকারের। ঘন সবুজ পাতার ভিতর কমলার ভারে ঝুঁকে আছে ডাল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হয় না। মনে পড়ল ঠিক চার বছর আগের কথা। ২০১৬ সালের জানুয়ারির এই সময়ে পিরোজপুর সদরের ডাকাতিয়া গ্রামে রেবতি সিকদারের মালটাবাগান দেখেও অবাক হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মাটিতে অভাবনীয় সুমিষ্ট মালটা। তারপর মালটা ছড়িয়েছে বহুদূর। এখন দেশের এমন কোনো জেলা-উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন নেই, যেখানে মালটা গাছ নেই। মালটা এখন এ দেশের ফলের তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে। রফিকুলের আজকের এ কমলা চাষের অনুপ্রেরণাও সেই রেবতি সিকদার। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ মালটা চাষের পর্বটি দেখে মালটা চাষ শুরু করলেন রফিকুল। মালটার সঙ্গে লাগালেন পেয়ারার চারা। এর মাঝে ভারতের দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে দেখলেন কমলার বাগান। সেখান থেকে ২০০ চারা নিয়ে এসে লাগালেন বাগানে। পেয়ারা থেকে আয় করলেন ১০ লাখ টাকা। কমলার চারা দেখে আশপাশের মানুষ বলল, কমলা হবে না, পাগল নাকি! সমতলে কমলা হয়! মানুষের কথা শুনে একবার ভাবলেন কমলার চারা তুলে ফেলে মালটাই লাগাবেন। তারপর ভাবলেন দেখা যাক কী হয়। পরের বছর গাছে ফুল আসতে শুরু হলো। এ কমলার ফলনে বিস্মিত হলেন রফিকুল। বিস্মিত করলেন আমাদেরও। রফিকুলের বাগানে বড় আকারের কমলার ফলন এবার সবার দৃষ্টিকেই এদিকে ঘোরাতে বাধ্য। শুধু রঙেই নয়, স¦াদ ও ঘ্রাণে আকর্ষণীয় এ কমলা। গাছে গাছে কমলা নয়, কমলা যেন পাতায় পাতায়। রফিকুল এখানে কয়েকটি জাতের কমলার পরীক্ষামূলক আবাদ করেছেন। তাঁর প্রতিটি পরীক্ষাই সফল। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের একেবারে লাল আভাযুক্ত এই ম্যান্ডারিনও ধরেছে বিপুল হারে।

একসময়ের একজন নার্সারি মালিক রফিকুলের এ কমলাবাগান গড়ার গল্পটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে এখনকার সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সফল উদ্যোগের গল্প। ভালো লাগে কৃষকের এ উদ্যম দেখে। টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন দেখে যে স্বপ্ন তারা চোখে-মুখে আঁকেন তা আমাকে বারবার উজ্জীবিত করে। এরই মধ্যে রফিকুল আরও ৫ বিঘায় সম্প্রসারণ করেছেন কমলা-বাগান। প্রশ্ন হচ্ছে, রফিকুল কমলাবাগান গড়ে তোলার নিয়ম-কানুন বা কৌশল জেনেছেন কীভাবে? রফিকুল জানালেন, কোনো কৌশল নেই। পেয়ারা-মালটার মতোই পরিচর্যা করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি গাছে গড়ে প্রায় ৫০ কেজি করে ফল এসেছে। প্রতি কেজি ১২৫-১৩০ টাকা দরে বিক্রি করে পাবেন প্রায় ৫ লাখ টাকা। রফিকুলের কথা শুনে বিস্ময় জাগে, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। ইতিমধ্যে কমলার চারা উৎপাদন করে উদ্যোগী কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে শুরু করেছেন। রফিকুলের বাগান এখন পরিণত হয়েছে সারা দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের এক স্বপ্নভূমি। এ কমলাবাগান বহু মানুষকেই এখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ১০ বছর আগেও রফিকুলের জীবন ছিল সংকটাপন্ন। পরিশ্রম আর নিষ্ঠা দিয়েই তিনি আজ এত দূর। রফিকুল বলছিলেন কমলা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা। দেশে যে পরিমাণ কমলা আমদানি করতে হয়, কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারলে পাঁচ বছরেই সে পরিমাণ কমলা আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারব। তাঁর সাফল্য দেখে অনেক তরুণই এগিয়ে এসেছেন। রফিকুলও তাঁদের সহযোগিতা করছেন। বেকারত্ব দূরীকরণে রফিকুলের এমন কৃষি উদ্যোগ অনুসরণীয়। সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রফিকুলের এ উদ্যোগকে সামনে ধরে তরুণদের উৎসাহী করে তুলতে পারে। তরুণরা যদি মেধা ও দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে আসেন আমাদের কৃষির চিত্র পাল্টে যাবে। কৃষকের এসব সাফল্য দেখতে বড় ভালো লাগে। রফিকুলের মতো এমন উদ্যমী কৃষকই কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সফলতায়ই সফল আমরা। সফল বাংলাদেশ।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর