শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বিশ্বমানবতা জাগ্রত হোক

নূরে আলম সিদ্দিকী

বিশ্বমানবতা জাগ্রত হোক

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে দুরুদুরু বক্ষে অবতরণ করলাম, হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে দেখলাম, বিমানবন্দরসহ সমগ্র তেজগাঁও এলাকা জনসমুদ্রের রূপ লাভ করেছে। ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভার পর একসঙ্গে এত বিশাল জনসমাবেশ আর কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। শুধু জনসংখ্যার আধিক্যই নয়, আবেগ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেলতায় শুধু ভরপুরই নয়, গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলজ্বল করছিল প্রতিটি মুখ। প্রতিটি মানুষের উদ্বেলিত চিত্তের উচ্চারিত দৃপ্ত স্লোগান শুধু আমাকে নয়, তারুণ্যের যে অপরাজেয় নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে প্রতীক হিসেবে সামনে নিয়ে গোটা জাতিকে ইস্পাতকঠিন প্রত্যয়দৃঢ় ঐক্যে রূপান্তরিত করতে পেরেছিল, তাদের বজ্রনিক্ষেপে জানিয়ে ছিল আমরা পারি। আমরা পারি দুর্ধর্ষ, বীভৎস এবং বর্বরোচিত হিংস্র পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধে পরাভূত করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ, সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বকীয়তাকে গভীর মমতার সঙ্গে বক্ষে লালন করত তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আরেকটি সংগ্রামের সোপান তৈরি করেছে তারা। আন্দোলনের স্রোতধারায় বাঙালি জাতির চেতনার প্রতীতিকে সমস্ত সত্তায় ধারণ করে এবং বাংলার শেখ মুজিবকে এই লালিত বিশ্বাসের মূর্তপ্রতীক বানিয়ে যে সংগ্রামের বিভায় পূর্ণ স্বাধীনতা, তার পূর্ণ স্বাদ পেয়েছিলাম সেদিন তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপস্থিত জনতার উচ্ছ্বসিত হৃদয়ের নির্মল আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে।

জীবনসায়াহ্নে মুক্তস্বাধীন বাংলাদেশে সব কিছুর মধ্যেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের বড়ই আকাল। গণতন্ত্রের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় প্রকাশ্য না হলেও অতিসূক্ষè ও সুচারুভাবে হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা রয়েছে, তা বোঝা যায়। তবে আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, টিভি টকশোয় অথবা আমার লেখনীতে কোনো দিনই কোনো বাধাবিঘ্ন দূরে থাক, কোনো ঈঙ্গিতও কখনো পাইনি। যেটিকে সত্য ভেবেছি, সততার সঙ্গে নির্মল চিত্তে সেটিকে উদ্গিরণ করতে কুণ্ঠিত হইনি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই, সংবাদ-মাধ্যমগুলোর কোথায় যেন একটু জড়তা আছে। কবিগুরুর সেই কালজয়ী বক্তব্যÑ ‘সত্য যে কঠিনে রে ভালোবাসিলাম’। বাংলার কালজয়ী দুরন্ত সন্তান মানিক মিয়া, শেখ মুজিব ও সিরাজুদ্দীন হোসেন যে নির্ভয়ে সমস্ত হৃদয় দিয়ে অকপটে সত্যকে ভালোবেসেছিলেন, চিন্তা-চেতনায়, মননে ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অবলীলাক্রমে যেভাবে তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, আজকে বাংলাদেশের রাজনীতির মননের দিকে তাকালে কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক ছলচাতুরী করবেন, এটি দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু জনতাকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরোধিতা করে সঠিক ধারায় সরকারকে আবর্তিত হতে বাধ্য করায় বিরোধী দলের যে নৈতিক দায়িত্ব, সেই বিরোধী দলের অবস্থা আজ বড়ই ভঙ্গুর। বাংলাদেশের আজকের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সেই বিএনপি আজ নিষ্প্রাণ, ভঙ্গুর ও বিবৃতিসর্বস্ব। সর্বোপরি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব যার ওপর অর্পিত হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নেতা, হাওয়া ভবনের প্রতিষ্ঠাতা এবং নিত্যনতুন দুর্নীতি কৌশলের জনক। তাকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পণ শুধু বিএনপির রথী-মহারথীদের হতাশ ও বিক্ষুব্ধই করেনি, দলটির চলমান স্রোতধারায় একটা অদৃশ্য ভাটার টান পড়েছে। এমনিতেই বিএনপি প্রচুর জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও কোনো সফল গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাদের সাংগঠনিক এ দুর্বলতা শেখ হাসিনাকে অনেকটা বেপরোয়া করে তুলেছে। দলের মধ্যে শেখ হাসিনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তো নেই-ই, দলের অভ্যন্তরে তিনি কাউকে গোনায়ই ধরেন না। তার মতের বাইরে অন্য কেউ মতপ্রকাশের সাহস রাখেন না।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলতেন, দেশ শাসনের প্রশ্নে জনগণের মতই শেষ কথা। আর শেখ হাসিনা বলেন- শাসনের প্রশ্নে তাঁর অভিমতই চূড়ান্ত। দলের অভ্যন্তরে কেউ তাঁর বিরোধিতা করেন না। আর আগেই বলেছি, দলের বাইরে একটি সবল ও সুদৃঢ় বিরোধী দলের আজ অস্তিত্ব নেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেটুকু নিষ্প্রাণ, ম্রিয়মাণ গণতন্ত্র আছে, তাও আজ নিঃশেষিত হওয়ার পথে। ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীর মতো।

ব্যক্তিনির্ভর দলের যা হওয়ার কথা তাই হচ্ছে আজ বিএনপিতে। সামরিক ছাউনির গর্ভে জেনারেল জিয়ার ঔরসে যে দলটির জন্ম, সেই দলটিতে যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে আসা স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী লোকেরা। দলটিতে এমনিতেই আদর্শকেন্দ্রিক নীতিমান ব্যক্তিত্বের অভাব আগাগোড়াই পরিলক্ষিত হয়েছিল। সেই অভাবটি আজ আরও প্রকট ও করালগ্রাসী হয়েছে। এ অনিশ্চয়তার গহ্বর থেকে দলটিকে টেনে তুলতে যে বিপুল পরাক্রম ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দরকার তা যে তারেক রহমানের নেই তা অনেকের মতোই আমি নিশ্চিত। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি এরশাদ সাহেবের জীবিতকালেও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সুবিধাবাদকেই বেছে নিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে নেতৃত্বের প্রশ্নে সাংঘর্ষিকতা এতটাই প্রকট হয়ে দেখা দেয় যে, ভাঙনের আশঙ্কা থেকে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে আপাতত রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ আশঙ্কাবিমুক্ত হয়নি।

গ্রিক সভ্যতায় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়। সেখানে রাজনীতিতে এলিটদের প্রচ- প্রভাব থাকলেও গণতন্ত্রের ঢঙে বিশাল বিতর্ক হতো। বিশ্বখ্যাত বীর আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন অ্যারিস্টটল। আর অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো। প্লেটোর গুরু সক্রেটিস সেই প্রাচীন আমলেও গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন। রাজনীতিতে তখনো মিথ্যা বলার একটা প্রচলন ছিল। সক্রেটিস তাঁর আজন্ম সাধনা এবং গভীর প্রত্যয়ে মিথ্যার বিরুদ্ধে শুধু বিদ্রোহই করেননি, সত্য ও সুন্দরের পক্ষে সক্রিয় ও সরব হওয়ার অপরাধে রাজরোষে নিপতিত হন। রাজরোষ এতটাই প্রবল ছিল যে, হেমলক বিষ পান করিয়ে সক্রেটিসের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। সেই প্রাচীন যুগে প্লেটোর গুরু সক্রেটিস একজন কালজয়ী ও বিস্ময়কর দার্শনিকই ছিলেন না, সত্যের অকৃত্রিম অগ্রদূতও ছিলেন। হেমলক পানের প্রাক্কালে এই কালজয়ী দার্শনিক তাঁর শিষ্য প্লেটো ও ক্রিতোকে উদ্দেশ করে বলে গেছেন, ‘সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে আপসকামী চেতনা লালন করলে রাজরোষে পড়তে হয় না। বরং পুরস্কৃত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তোমরা সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণের জীবন বেছে নিও না। তাতে সাময়িকভাবে পুরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইতিহাসে ধিকৃত ও সুবিধাবাদী হিসেবে কলঙ্কিত হবে।’ দার্শনিকের জীবনে এটি বর্জনীয় তো বটেই, সত্যনিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে মিথ্যার প্রশ্রয় হেমলকের চেয়েও মারাত্মক। কারণ হেমলক পানে একবারে একজনের মৃত্যু হয়, আর মিথ্যা গোটা জাতিকে সত্যনিষ্ঠার পাদপীঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। যার পরিণতিতে ধ্বংস অনিবার্য। অধুনা বাংলাদেশে সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট ও বীভৎস রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক উন্নত ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশেও রাজনীতিতে মিথ্যার বীভৎসতা পরিলক্ষিত হয়। সারা বিশ্ব আজ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে প্রচ- ঔজ্জ্বল্য পেলেও একটা সংঘাত বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাবিমুক্ত হতে পারেনি। আজকে বিশ্বের যতটুকু ভারসাম্য তা পারমাণবিক শক্তির ভয়াবহতার কারণে। আমেরিকাসহ সেন্টো-সিয়েটোর অনেক দেশÑ রাশিয়া, চীন এমনকি উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত আজ পারমাণবিক শক্তিধর। এমনকি ভারত-পাকিস্তান উভয়েরই পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ আছে। কোনো কারণে এ উপমহাদেশে যুদ্ধের দামামা বাজলে ধ্বংসের অতলান্তে যে আমরা তলিয়ে যাব তা বলাই বাহুল্য। যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাইÑ এটি শুধু স্লোগানই নয়, সারা বিশ্বের সমগ্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের মননে সেটি আনতে হবে। আজকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা সমগ্র বিশ্বের বিবেককে প্রচ-ভাবে নাড়া দিয়েছে। রণক্ষেত্রে নয়, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিকালেও নয়, এমনকি লাদেনের মতো ধ্বংসাত্মক নেতৃত্বও নয়, ইরানের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কৌশলী ও দেশপ্রেমিক সমরবিদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে বিনা প্ররোচনায় ড্রোন হামলা করে ইরাকের মাটিতে হত্যা করার যে ধৃষ্টতা আমেরিকা প্রদর্শন করেছে, তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে প্রতিবাদে বিস্ফোরিত করেছে। আমেরিকার এই যুদ্ধংদেহী মানসিকতাই আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। আল্লাহ না করুন, তেমনটি হলে সারা বিশ্বে এর মারাত্মক প্রভাব তো পড়বেই, বরং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও অমূলক হবে না। এ আশঙ্কার স্রষ্টা আমেরিকাকে স্মরণ করানো প্রয়োজন, আজকে তাদেরই মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের অমিত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বিশ্বমানবতাকে সাময়িকভাবে বিধ্বস্ত করলেও পরিণতিতে তারাই নির্মমভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আত্মম্ভরী হিটলার আত্মহত্যা করে নিষ্কৃৃতি পেতে চেয়েছেন।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে ড্রোন হামলা করে আমেরিকা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, তাকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে মোকাবিলা করা অত্যাবশ্যক। আমার ধারণা, যুদ্ধের প্রশ্নে সারা বিশ্বে জনমত জরিপের মতো একটা নির্বাচন হলে যুদ্ধকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ‘না’ বলবে শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ লোক। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদির মতো মানবতাবিরোধী নেতৃত্বের কথা স্বতন্ত্র বা আলাদা। সব চিন্তা, মননশীলতা, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এবং অসংখ্য ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা একটি জাতি ভারত বিশ্বের কাছে নন্দিত। তবে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটিয়ে মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বোস, শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর চিন্তা-চেতনাকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষকে হিন্দুস্তানে রূপান্তরিত করার যে আত্মঘাতী অপচেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছেন, তাতে তারা সফল হলে তাদের রাজনীতি তাদেরই কোথায় প্রতিস্থাপিত করবে, তা বলা কঠিন। আর তাতে সব ধর্মের সব বর্ণের ভারত যে খন্ডিত হওয়ার আশঙ্কা শুধু বৃদ্ধিই পাবে না, অনেকাংশে বাস্তবে ভারতকে খন্ডিত করবে। যদিও আসামের এনআরসি বাতিল করা হয়েছে, তবু বলতেই হয়, এনআরসির সুস্পষ্ট বার্তা ভারতের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার একটি অপচেষ্টা ছিল। ভারতে সাম্প্রদায়িকতা সত্যিই অগ্রহণযোগ্য। মুসলিমবিদ্বেষী নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ তাদের বিশ্বাসের আঙ্গিক থেকে সরে আসবেন বলে মনে হয় না। তবে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কাই শুধু নন, গোটা ভারতের প্রগতিশীল মহল যেভাবে গর্জে ফুঁসে উঠেছে, তা ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে এই জাতিগত সমস্যাটিকে জটিল করার কোনো অবকাশ নেই। শতাব্দীর স্রোতধারায় তারা এ সমস্যাটিকে অতিক্রম করেছে। তবু আমেরিকা ও গ্রেট ব্রিটেন তাদের জাতীয় ভিত্তি বিনির্মাণের প্রাক্কালে গৃহযুদ্ধসহ নানাবিধ সমস্যাসংকুল পরিবেশ পেরিয়ে এসেছে। পাশ্চাত্যের এসব উন্নত দেশে রাজনীতিচর্চায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কূটনৈতিক কৌশল ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক বিনির্মাণের প্রচেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে আবর্তিত হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের রাজনীতিচর্চার মূল বিষয়টিই হলো নেতিবাচক। যারা ক্ষমতায় থাকেন, দেশপ্রেম তাদের একচেটিয়া এবং একক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। বিরোধী দলসমূহ, যারা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে, তাদের বিষয়টি আলোচনায় না আনাই শ্রেয়, কিন্তু যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আজও ক্ষমতাপ্রত্যাশী, তারা দেশের মানুষকে রাজনৈতিক মূল ভাবনার দিকে আকর্ষণ করেন না। বরং দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয়ের আড়ালে রাখতে স¦চ্ছন্দবোধ করেন। ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়াটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। ভেবেছিলাম মানবিক তো বটেই, সাময়িকও। কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণে একটি ভয়াবহ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মজার কথা হলো, এ বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে সব মতের নির্যাস হতে অভিজ্ঞতা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এটা আমাদের রাজনৈতিক মননের দৈন্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কবে যে আমরা এ দৈন্য থেকে বিমুক্ত হব, আল্লাহই জানেন। আল্লাহর অশেষ রহমত ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে তাকে স্থায়ী করতে হলেও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের রাজনীতির সত্তায়, চর্চায় তা নেই বললেই চলে। আমাদের প্রত্যাশা, দেরিতে হলেও সেই মনন সৃষ্টির কাজটি অতিসত্বর শুরু হোক।

আত্মস্বার্থ-বিবর্জিত অথবা বিবেক দ্বারা পরিচালিত ব্যক্তিবর্গ সংখ্যায় নগণ্য হলেও যত শিগগিরই এগিয়ে আসবেন, জাতির জন্য ততই কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত। আমি কবি হয়ে যৌবনের পাদপীঠে দন্ডায়মান থাকলে হয়তো বিদ্রোহী সত্তায় বলতাম-

‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর