শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কর্মসংস্থান : সবাই ভেবে দেখুন

কালাম আজাদ

বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর একটি। দু-একটি নগররাষ্ট্র বাদে আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক অনেক বেশি। মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। স্বাধীনতার পর গত চার যুগে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি থেকে প্রায় ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে। বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে চাষযোগ্য জমি অন্ততপক্ষে ৩০ শতাংশ কমেছে। কারও কারও মতে কৃষিজমি কমেছে আরও বেশি। সর্বনাশা এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। রাস্তাঘাট, বাজার, স্কুল-কলেজ, কলকারখানা ও বসতবাড়ি নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহৃত হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি আধুনিকীকরণের জন্য গত চার যুগে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। চার যুগে দেশবাসীর গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে বিশেষত ধান উৎপাদনে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য চাহিদা পূরণে এখনো বছরে কয়েক কোটি মণ গম আমদানি করতে হয়। কোনো কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে চাল আমদানির কারণে দেশের সংরক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারে চাপ পড়ে। দাবি করা হয়, বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চার যুগে খাদ্য উৎপাদন তিন গুণ বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো সাফল্য এখনো অর্জিত হয়নি। বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষ এখন বিদেশে কর্মরত। কোনো কারণে তারা দেশে ফিরে এলে তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর অন্যান্য চাহিদা পূরণও অসম্ভব হয়ে পড়বে। জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস হলেও সে ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা। দেশের জনশক্তির বাজার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ বাজার আরও সীমিত হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যৌথভাবে চাষাবাদ করে উৎপাদিত খাদ্যের একাংশ দেশে এনে নিজেদের চাহিদা মেটানোর সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগানো হচ্ছে না। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সৈন্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। সেসব দেশে শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশি সৈন্যরা সফল হয়েছেন। শান্তি স্থাপনের পাশাপাশি সেসব দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা, খাদ্য সহায়তা, যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্গঠনে অবদান রেখে বাংলাদেশের সৈন্যরা সুনাম কিনেছেন। কৃষি কাজে পিছিয়ে থাকা বিভিন্ন আফ্রিকান দেশে পতিত জমি চাষাবাদের জন্য লিজ নিতে চাইলে ওইসব দেশের সরকার সহজে সম্মত হবে এমনটিই আশা করা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে পাঁচ গুণ আয়তনবিশিষ্ট দেশ জাম্বিয়া হতে পারে বাংলাদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র। এ দেশটির জনসংখ্যা বাংলাদেশের ১১ ভাগের ১ ভাগ। জাম্বিয়ার একজন এমপি বেশ কয়েক লাখ বিঘা জমিতে যৌথ উদ্যোগে কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। জাম্বিয়া সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক মুহাম্মদ নওয়াব আলী ভূইয়া আরও দুজন ব্যাংকারকে নিয়ে জাম্বিয়া সফরকালে সে দেশে ‘ইসলামী ব্যাংক অব জাম্বিয়া লিমিটেড’ নামে একটি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি পেয়েছেন। অত্র ব্যাংকের সহযোগিতায় আফ্রিকায় লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও করেছেন উদ্যোক্তারা।

কয়েক দিন আগে কথা হয়েছে জনাব ভূইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বেকারত্ব সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করছে। দেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান ও তাদের খাদ্যের জোগান দেওয়া ভবিষ্যতে কঠিন হয়ে পড়বে। আফ্রিকার স্বল্প জনসংখ্যার দেশগুলোয় কৃষি ও পুনর্বাসনের কর্মসূচি নিলে তাতে এ সমস্যা সহজে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। জাম্বিয়ায় ব্যাংক স্থাপনের যে অনুমতি তারা পেয়েছেন, তা কাজে লাগাতে পারলে ওই দেশটিতে যৌথ উদ্যোগে কৃষি প্রকল্প হাতে নেওয়া সম্ভব হবে। ব্যাংক স্থাপনে বাংলাদেশ থেকে আইনসম্মত উপায়ে ৫০ কোটি টাকা তাদের প্রস্তাবিত ব্যাংকের জন্য মূলধন হিসেবে হস্তান্তরের জন্য তারা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের নীতিমালা না থাকায় এগোতে পারছেন না। সিয়েরা লিওনের সাবেক কৃষিমন্ত্রী Hon Msufian karghbo শান্তি মিশনের সদস্য লে. কর্নেল মহিউদ্দিনের মাধ্যমে আড়াই লাখ একর জমির ওপর The Bangla-Salone joint ventuse agricultural project (BAN-SAL JVAP) নামের একটি প্রকল্প তৈরি করে জনাব ভূইয়াদের কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এ প্রস্তাবকেও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের অংশ হিসেবে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি সৈন্য মোতায়েন রয়েছেন। প্রতিটি দেশের সরকার বাংলাদেশি সৈন্যদের বন্ধু হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সিয়েরা লিয়ন বাংলাকে তাদের দেশের দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু এ দেশটির সঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সে দেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে যৌথ উদ্যোগে কৃষি প্রকল্প গ্রহণে আমরা কোনো সুযোগ নিতে পারিনি। চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ আফ্রিকায় যৌথভাবে কৃষি প্রকল্প হাতে নিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বিদেশে বিনিয়োগসংক্রান্ত বিধিবিধানের অভাবে। এই আত্মঘাতী অবস্থার অবসানে সরকার বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখবেÑ এমনটিই প্রত্যাশিত।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর