শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলো

তোফায়েল আহমেদ

ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলো

প্রতি বছর জানুয়ারি মাস ফিরে এলে ১৯৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। আমার জীবনেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ঊনসত্তর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। সেই কালপর্বে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এবার ঊনসত্তরের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা কেন যেন বেশি মনে পড়ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মতো এত বড় আন্দোলন হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট। কিন্তু ৬ দফা দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুকে যখন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর সব পরিকল্পনা আইয়ুব খান গ্রহণ করেছিল, তখনই এ আন্দোলন আমরা করেছিলাম। যে আন্দোলনের ফলে আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীরসহ অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। এ আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। কেন জানি না প্রতি বছরই এ দিনগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু যেভাবে এ দিনগুলো স্মরণ করার কথা সেভাবে আমরা পালন করি না। এটি খুব পীড়াদায়ক এবং কষ্টকর। এই তো সেদিন আমি জাতীয় জাদুঘরে গিয়েছিলাম। দেখলাম, সেখানে ঊনসত্তরে শহীদ আসাদ, মতিউর, মকবুল, রুস্তম, আলমগীর, এমনকি ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহার ছবি নেই! খুব কষ্ট পেয়েছি। যে কারণে বন্ধুবান্ধবের সহযোগিতায় আমার জন্মস্থান ভোলার বাংলাবাজারে স্ব-উদ্যোগে ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছি। যেখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, এবং ফাঁসির মঞ্চ থেকে জাতির পিতাকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে বঙ্গবন্ধুকে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়েছিল, সেসব স্মৃতি সেই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। আমরা একদিন চলে যাব। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বলগ্নে যে আন্দোলন হয়েছিল, যা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল, সেই আন্দোলনটি আমাদের স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাবে এটা হতে পারে না। সে কারণেই ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করেছি। কেউ যদি পরিদর্শনে যায় স্বাধীনতার পরিপূর্ণ ইতিহাস এখানে পাবে। এ ডিজিটাল জাদুঘরটি ২০১৮-এর ২৫ জানুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ উদ্বোধন করেন।

.ঊনসত্তরের সোনালি দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। অনেক সময় ভাবী, কী করে এটা সম্ভবপর হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দেন আমি তখন ইকবাল হলের ভিপি। ইকবাল হলে বসেই ৬ দফার পক্ষে আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমার কক্ষ নম্বর ছিল ৩১৩। এ কক্ষে প্রায়শই থাকতেন শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। ৬ দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ অর্থাৎ এ ৬ দফার সিঁড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতায় পৌঁছবেন। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ঝটিকা সফর করে ৩২টি জনসভা করেন এবং বিভিন্ন জেলায় বারবার গ্রেফতার হন। শেষবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকা আসার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর ছেষট্টির ৭ জুন আমরা সর্বাত্মক হরতাল পালন করেছিলাম। আটষট্টির ১৭ জানুয়ারির শেষ এবং ১৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেফতার করা হয়। জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে প্রিজনভ্যানে তোলার প্রাক্কালে এক টুকরো মাটি কপালে ছুঁইয়ে বলেছিলেন, ‘হে মাটি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওরা যদি আমাকে ফাঁসি দেয় আমি যেন মৃত্যুর পর তোমার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারি।’ প্রথমে আমরা জানতাম না প্রিয় নেতা কোথায় কীভাবে আছেন। আমরা জাগ্রত ছাত্রসমাজ এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মিছিল করি। আমার সৌভাগ্য ওইদিনই ডাকসুর ভিপি হয়েছিলাম। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বঙ্গবন্ধু চিঠি লিখে বিশ্বস্ত এক কারারক্ষীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন; চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি হয়েছিস, এ কথা শুনে খুউব ভালো লেগেছে। বিশ্বাস করি এবারের এই ডাকসু বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে।’ আটষট্টির ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যেদিন শুরু হয়, সেদিন থেকে আমরা জানতাম আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদন্ড দেবে। কারণ, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান উপলব্ধি করেছিল, সবাইকে বশে আনা যায় কিন্তু শেখ মুজিবকে বশে আনা যায় না। তাই আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই একটি কণ্ঠকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। কেননা, একটি কণ্ঠে কোটি কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা। ‘আইয়ুব খান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন আলতাফ গওহর। সেই বইতে উল্লেখ আছে, বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ঊনসত্তরের ১৭ জানুয়ারি যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম,-যে আন্দোলনের ফলে বঙ্গবন্ধু ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্তিলাভ করেন- সেদিন যদি এই আন্দোলন না হতো, সেদিনের শহীদেরা যদি জীবন বিলিয়ে না দিত, তাহলে তো আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। যে আন্দোলন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এত বড় ভূমিকা পালন করেছে, সে আন্দোলন যখন কম আলোচিত হয়, তখন তা মনঃকষ্টের কারণ হয় বৈকি! কিন্তু আমরা জাতির জনকের কাছে কৃতজ্ঞ। যখনই প্রসঙ্গ উঠত তখনই- এমনকি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন।

১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ডাকসু ভিপির কক্ষে বসেই আমরা ১১-দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখছি বারবার মনে পড়ছে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতাদেরÑছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ; এবং এনএসএফ-এর একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এ ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান ও বড় নেতা। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি; সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। ঊনসত্তরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সভাপতি হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেওয়ার যে আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব কি ভাঙব না। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত জানিয়ে মিছিল নিয়ে রাজপথে এলাম। পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলে আহত হন। পরদিন ১৮ জানুয়ারি, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি দিই। ১৮ জানুয়ারি বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খন্ড খন্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ সেদিনও ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত এবং মিছিল নিয়ে রাজপথে এলাম। দাঙ্গাপুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করল। পরদিন ১৯ জানুয়ারি ছিল রবিবার। সে সময় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। কর্মসূচি নেওয়া হলো আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। গত দুই দিনের চেয়ে মিছিল আরও বড়। পুলিশ গুলি চালাল। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল রাজপথে। ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি দিনাজপুর। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ ২০ জানুয়ারি সোমবার পুনরায় বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলাম। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক। এদিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট প্রথম দিন শুরু করেছিলাম শ’পাঁচেক নিয়ে, আজ কয়েক সহস্র, যেন জনসমুদ্র। যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখনো দলে দলে মানুষ আসছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে বলি, ‘যত দিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে মুক্ত করতে না পারব, তত দিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহির পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! লাখো মানুষের ঢল রাজপথে। আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝে। মিছিল যখন আগের কলাভবনের (বর্তমান মেডিকেল কলেজ) সামনে তখনই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলী, আসাদুজ্জামান ও আমি,Ñআমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোড়ে। গুলি আসাদুজ্জামানের বুকে বিদ্ধ হয়। আমি আর খালেদ আসাদকে মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একজন শহীদের শেষনিঃশ্বাসটি আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হয়। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আকাশে উড়িয়ে, আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে বলি, ‘আসাদ তুমি চলে গেছ। তুমি আর ফিরবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ এরপর শহীদ মিনার চত্বর থেকে শহীদ আসাদের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করি বিক্ষুব্ধ শোকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশে বক্তৃতায় বলি, ‘আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।’ আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয় শোকমিছিল। সবার সামনে আমি এবং অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ। শোকমিছিলে হাজার হাজার মহিলা, গৃহবধূ, তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক, কর্মচারী অংশগ্রহণ করে। শোকমিছিল মুহূর্তেই লাখো মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। শোকমিছিলের সম্মুখভাগ যখন তিন নেতার সমাধিসৌধের কাছে তখন মাইকে পুলিশ ও ইপিআরের কণ্ঠস্বর ‘ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!’ কিন্তু শোকমিছিল শোকে আর ক্ষোভে উত্তাল। ডেঞ্জার শব্দের কোনো মূল্যই নেই সেই মিছিলের কাছে। ডেঞ্জার ক্রস করে রক্তাক্ত লাল পতাকা নিয়ে পল্টনে পৌঁছাই আমরা। পল্টনে ঠাঁই নেই। লোকে লোকারণ্য। সবকিছুই অনির্ধারিত। মঞ্চ বা মাইক কিছুই নেই। সবাই চায় সংগ্রামের কর্মসূচি। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর ২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২১ জানুয়ারি পূর্ব ঘোষিত হরতালের কর্মসূচি পালনকালে চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামে পল্টন ময়দানে। এদিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। পল্টনে চারাগাছের ইটের বেষ্টনীর ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়। বক্তৃতার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোকমিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশালমিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোকমিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল। এরপর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তৎকালীন ন্যাপ নেতা, পরে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মহিউদ্দীন আহমদ ও কারাগারের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২২ জানুয়ারি, ঢাকা নগরীতে আমি এমন কোনো বাঙালি দেখিনি যার বুকে কালো ব্যাজ নেই। বাড়িতে, অফিসে সর্বত্রই কালো পতাকা উড়ছে। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া ঘৃণা প্রকাশের এই প্রতীকী প্রতিবাদ ছিল সর্বত্র। ২৩ জানুয়ারি, শহরের সব অলিগলি থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় মশালমিছিল। ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ২৪ জানুয়ারি, সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। সবার তখন একই প্রশ্ন, ‘শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবে’ (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি)? ‘কবে আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হবে?’ ‘যদি সরকার না মানে তাহলে?’ ‘এমন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে যেন আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারি।’ ‘এখনই আমাদের তুমুল সংগ্রাম শুরু করা উচিত যেন আইয়ুবের পতন ঘটে।’ ‘আইয়ুব-মোনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবে না।’ ঢাকা শহরের সর্বত্র এ ধরনের আলোচনাই চলছিল। হরতালের পরও মিছিলের বিরাম নেই। ডাকসু ভিপি হিসেবে আমার স্কন্ধে তখন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক, মুখপাত্র ও আহ্বায়কের দায়িত্ব। সমগ্র বাংলাদেশ সংগ্রামের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত, অগ্নিগর্ভ। জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা যে কত কঠিন সেদিন তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। হরতাল চলাকালে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। কিছুক্ষণের মধ্যে ইপিআর এবং পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই নিহত হয়ে শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। তখনই শুনতে পাই মোনায়েম খান শহরের নিয়ন্ত্রণভার ছেড়ে দেবে সেনাবাহিনীর হাতে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। আমরা পল্টন থেকে ইকবাল হলে এলাম মতিউরের লাশ নিয়ে। মতিউরের পকেটে এক টুকরো কাগজে নাম-ঠিকানাসহ লেখা ছিল- ‘মা-গো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে। ইতি- মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণী, নবকুমার ইনস্টিটিউট। পিতা- আজহারউদ্দীন মল্লিক, ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ কারফিউর মধ্যেই আমরা মতিউরের লাশ নিয়ে গেলাম ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনিতে। শোক-বিহ্বলতা ভেঙে স্বাভাবিক হয়ে, মতিউরের মা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নাই!  আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। মনে রেখো, যে জন্য আমার ছেলে রক্ত দিয়েছে, সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ সেদিন শহীদ মতিউরের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিইনি। ঢাকা শহরের বিবেক নড়ে উঠেছিল। কারফিউ কোথায়? রাজপথে বিক্ষুব্ধ মানুষের ভয়াল গর্জন আর সরকারি ভবনগুলো এবং ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিস তখন আগুনে জ্বলছে। বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান, নবাব হাসান আসকারীর বাড়ি এবং রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনসহ আরও কয়েক মন্ত্রীর বাসভবন। ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি প্রবল গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরীর মানুষ রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করল। বাংলাদেশে বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি মাত্র আট দিনের মধ্যে নিরস্ত্র বাঙালি জাতি এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক যে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিল তা আজও স্মৃতির পাতায় অম্লান। কারফিউর মধ্যে এক দিনও থেমে থাকেনি আমাদের সংগ্রাম। দেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি প্রশাসন বর্জন করেছে। কলকারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। পুলিশ দ্বিধাগ্রস্ত। সরকারি কর্মকর্তারা জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য ধরনা দিতেন ইকবাল হলে। কিছুদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দফতর তথা ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষ। ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ১১ দফার প্রতি ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলাম। কারণ আমাদের সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর। যে চারটি ছাত্রসংগঠন একত্রিত হয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতির সামনে ১১-দফা দাবি পেশ করেছিলাম তাদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য সত্ত্বেও একই টেবিলে বসে আমরা ১১ দফা দাবি প্রণয়ন করেছি। নিজেদের মধ্যে ঐক্যের দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি। ছাত্রসমাজের সাধারণ সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে এসেছি। সবার চিন্তাধারাকে সমন্বিত করেছি। ৬ দফা সবাই সমর্থন করত না। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত না। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ ৬ দফা সমর্থন করত। আবার উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রশ্নে এককভাবে তাঁর নাম দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতেই আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হয়েছে, গতিশীলতা লাভ করেছে। দেশব্যাপী এমন একটি জনসমর্থিত তুমুল গণআন্দোলন সংগঠিত করতে পেরেছিলাম কেবল মানুষের সুবিপুল আস্থা আর বিশ্বাস আমাদের ওপর ছিল বলেই। আমরা মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছি। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে শপথ দিবসে সেøাগান দিয়েছিলাম ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মা-গো তোমায় মুক্ত করব।’ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের মহাসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক সবার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। সমগ্র দেশ গণবিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান সব রাজবন্দীকে বিনা শর্তে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রিয় নেতাকে কারামুক্ত করার মধ্য দিয়ে শপথ দিবসের সেøাগানের প্রথম অংশ ‘মুজিব তোমায় মুক্ত করব’, এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করে সেøাগানের দ্বিতীয় অংশ ‘মা-গো তোমায় মুক্ত করব’ বাস্তবায়ন করেছিলাম।

 

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য    মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।

[email protected]

সর্বশেষ খবর