শনিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র : মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পথ

তুষার কণা খোন্দকার

গণতন্ত্র : মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পথ

নোয়াখালী জেলায় একটা প্রবাদ আছে। ওখানে বিশেষ কিছু চাওয়া-পাওয়া থেকে বঞ্চিত মানুষ লম্বা শ্বাসের ভিয়েন দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ মালিক! ব্যাকগুনরে দিছ ময়নার ছাউ আঁরে দিছ শালিক!’ গত এক শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের কপালে যে লাঞ্ছনা জুটছে তাতে আমারও এখন গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছা করে, ‘আল্লাহ মালিক! ইসরায়েলরে দিছ ময়নার ছাউ মুসলিম দেশগুলারে দিছ শালিক! মুসলিম দেশগুলোর দুর্ভোগের জন্য আল্লাহর ওপর দোষ চাপানোর কারণ আল্লাহ আল কোরআনে বলেছেন, ‘আমি যখন কাউকে রাজা বানাই তখন তাকে হাতে ধরে রাজা বানাই না বরং তাকে রাজা হওয়ার বুদ্ধি দিই। সে সেই বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করে রাজ্য জয় করে রাজা হয়। আবার আমি যখন কাউকে ভিখিরি বানাই তাকে হাতে ধরে ভিখিরি না বানিয়ে তাকে ভিখিরি হওয়ার বুদ্ধি দিই। ভিখিরি হওয়ার দুর্বুদ্ধি নিয়ে সে লোক আহাম্মকের কাজকারবার করতে করতে একসময় ভিখিরি হয়ে যায়।’ আরব মুলুকের মুসলমান দেশগুলোর ভিখিরি দুর্দশা দেখে মনে হয় আল্লাহ এদের ভিখিরি হওয়ার বুদ্ধি দিয়েছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করল। সেই সঙ্গে আরও তিন জায়গায় একযোগে আত্মঘাতী হামলা চালানোর ফলে আল-কায়েদার ১৯ সদস্যসহ মোট ২ হাজার ৯৯৬ জন মানুষ মারা গেল। এ ২ হাজার ৯৯৬ জন মানুষের মধ্যে আল-কায়েদার ১৯ সন্ত্রাসী ছাড়া বাকি সবাই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ মুসলিম দুনিয়াকে শায়েস্তা করতে নামলেন। ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করার পর থেকে আরব বিশ্ব হাবিয়া দোজখের আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হতে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪ হাজার ৫০০ সৈন্য মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করার পর ইরাকে আজ পর্যন্ত ৬ লাখ নিরীহ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে যাদের প্রায় কারও যুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। এরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে ইরাককে ধ্বংস করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে ৬ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এসব অভিযোগ তুলে গলা ছেড়ে বিলাপ করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতির উন্নতিবিশেষ ঘটার কোনো সম্ভাবনা আছে? মোটেই না। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় বন্ধুরা অনেক নোংরা খেলা খেলেছে এটা দুনিয়ার কারও অজানা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশের গত এক শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আরব বিশ্বে সব ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য পশ্চিমা দুনিয়া কখনো নিজেরা সরাসরি জড়িত অথবা তারা আড়ালে বসে কলকাঠি নেড়ে আরব দুনিয়ায় গণহত্যা চালিয়েছে। মওকা পেলে আরব দেশগুলোর বিবাদী গোষ্ঠীগুলোর জন্য বিবাদের পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে সেখানে রক্তের বান ডাকিয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্য পশ্চিমা দুনিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নোংরা রাজনীতি করে, এ নিয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। আমার নিজের মনেও পশ্চিমা দুনিয়ার ছলচাতুরী নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। আমার মনে প্রশ্ন, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো একটি সঠিক পদক্ষেপ কি নিয়েছে? বরং এক দেশের যুদ্ধ সব দেশে নানান বিরোধে রূপ নিয়ে এক সর্বগ্রাসী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আরবীয়রা তাদের সুখ-শান্তির জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে পশ্চিমারা তাদের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলবে এটাই স্বাভাবিক।

আরব বসন্তের নামে পশ্চিমা দুনিয়া মধ্যপ্রাচ্যে রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। রক্তের খেলা ইরাকের সীমায় বাঁধা নেই। সিরিয়ার দিকে চেয়ে দেখুন। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদকে উচ্ছেদ করার নামে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়েছে তা এখন হরেক দেশের হরেক গোষ্ঠীর মধ্যে স্রেফ বর্বর হানাহানির রূপ নিয়েছে। সিরিয়ার বাসিন্দাদের জন্য সিরিয়ায় বেঁচে থাকাটাই এক বিস্ময়। সে দেশে বোমার আঘাতে মরে যাওয়াকে লোকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন, তুরস্ক ও রাশিয়া সিরিয়া যুদ্ধে সরাসরি অংশীদার। বর্বর আইসিস তো আছেই। সিরিয়ার যুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। ছোট পরিসরে সিরিয়ার মাটিতে এ যেন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়ায় এ পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ মানুষ মারা গেছে। যুদ্ধের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে তুরস্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ার ভিতরে যারা আটকে আছে তাদের দুর্দশা অকল্পনীয়।

ইয়েমেনে দুর্দশা আপনারা টেলিভিশনের খবরে মাঝেমধ্যে দেখেন। ইয়েমেনের সরকার ও হুথি বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ শিশু অনাহারে এবং রোগে ভুগে মরে যাচ্ছে। ইয়েমেনের শিশুমৃত্যু সভ্যতার মুখে কলঙ্কের ছাপ ফেলে দিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ার পরমবন্ধু সৌদি আরবের নেতৃত্বে ইয়েমেনের মাটিতে নির্বিচার বোমাবর্ষণ চলতে থাকলেও পশ্চিমা দুনিয়া নির্বিকার। লেবাননের রাজনৈতিক সংকটের শুরু ১৯৫৮ সালে। সে বছর যুক্তরাষ্ট্র লেবাননে সৈন্য নামিয়ে দিয়েছিল। এরপর অনেক রকম রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্য দিয়ে লেবাননের পরিস্থিতির শুধু অবনতিই ঘটেছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করে পিএলওকে তাড়ানোর নাম করে লেবাননের সাবরা শাতিলা শরণার্থী শিবিরে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছিল। ইতিহাসের পাতা খুঁড়লে লেবাননের মাটিতে এমন অনেক রক্তের দাগ পাওয়া যাবে। খ্রিস্টানদের রক্ষার নাম করে যুক্তরাষ্ট্র লেবাননে অভিযান চালানোর ছয় দশক পার হয়ে গেলেও লেবানন সংকটের অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। লেবাননে ইরানপন্থি শিয়াদের সংগঠন হিজবুল্লাহর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে সুন্নি সৌদি আরব জুজুর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কম্পমান সৌদি আরবের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে তার পশ্চিমা মিত্ররা লেবানন সংকটকে সমাধান-অযোগ্য একটি সমস্যা বলে কত ফ্যাকরায় খেলে চলেছে। সেই সঙ্গে হিজবুল্লাহর জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিমা দুনিয়া সৌদি আরবের কাছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্য গড়ছে!

ইরান সংকট মধ্যপ্রাচ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। ১৯৫২ সালে ইরানের শাসক ড. মোসাদ্দেক ব্রিটিশ মালিকানার তেল কোম্পানিকে ইরান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সূত্র ধরে ইরানের ওপর গজব নাজিল হয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হলো। শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরানকে হজরত আলীর যুগে ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। ইরানের একগুঁয়ে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যকে শিয়া-সুন্নি বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। এর ফলে ইরান নিজেও মরতে বসেছে সেই সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধের বীজ পুঁতে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব করার সঙ্গে সঙ্গে ৫২ জন মার্কিন কূটনীতিককে ইরান জিম্মি করে প্রায় দেড় বছর বন্দী করে রেখেছিল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন একটি গর্হিত কাজ কোনো সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। মার্কিন কূটনীতিকদের বন্দী করার মধ্য দিয়ে ইরান আমেরিকার স্থায়ী শত্রুতা কিনে নিয়েছে। ২০২০ সালের শুরুতে ইরান-আমেরিকা বিরোধের ধরন দেখে মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সহজে শেষ হওয়ার নয়। আরব দুনিয়ার মরুভূমির বালুতে হাবিয়া দোজখ আরও বহু বছর জ্বলতে থাকবে।

সব কথার শেষ কথা, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় জনগণের অধিকার অস্বীকৃত। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় যত দিন গণতন্ত্র কায়েম না হবে তত দিন ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ওখানে এভাবেই মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ছাড়া আর কোনো দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনো দেশে গণতন্ত্র না থাকলে সে দেশকে সহজেই বেচাকেনার জন্য পাল্লায় তুলে ফেলা যায়। জনগণ যে দেশের মালিক নয়, সে দেশের একনায়ক শাসক কোনো না কোনো বিদেশি শক্তির ওপর আসর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সংকটের মূল সেখানেই। আরব বিশ্বের মানুষগুলো যুদ্ধবিগ্রহে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে কিন্তু তারা সাহস করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে পারে না। আরব দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কলকাঠি আরবীয়দের হাতে। আরব দুনিয়ার কমন শত্রু ইসরায়েলের কাছ থেকে আরবীয়দের গণতন্ত্রচর্চা করার সবক নিয়ে মাঠে নামতে হবে। পশ্চিমা দুনিয়া আরব বিশ্বে রেজিম চেঞ্জের নামে কেমন নরক গুলজার করতে পারে তা ইরাক ও লিবিয়ার উদাহরণ দেখে আরবীয়দের হুঁশ হওয়া উচিত। আরবীয়রা নিজ নিজ দেশের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস এবং বুদ্ধি সঞ্চয় করতে না পারলে চিরকাল তাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে হবে- ব্যাকগুনরে দিছ ময়নার ছাউ আঁরে দিছ শালিক! আরবীয়দের দুর্দশা দেখে আমরা চোখের পানি ফেলে মরুভূমি ভেজাতে পারব কিন্তু তাতে আরবীয়দের কপাল ভিজবে না। আরবীয় শাসকরা তাদের প্রজাদের হত্যা আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে না। আরবের জনগণ শান্তিতে বাঁচতে চাইলে তাদের সাহস করে নিজ দেশের মালিকানা বুঝে নিতে হবে। জনগণ যে দেশের মালিক সে দেশ নিয়ে কেউ নোংরা খেলা খেলার সাহস পায় না।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর