রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ফুলের রাজ্যে আধুনিক কৃষির অভিষেক

শাইখ সিরাজ

ফুলের রাজ্যে আধুনিক কৃষির অভিষেক

কৃষির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের একটা ভালো উদাহরণ হচ্ছে যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী এলাকা। ১৯৮৩ থেকে অদ্যাবধি ফুল চাষের মাধ্যমে এ এলাকার যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, বলা ভালো এখনো হচ্ছে, সেটা বেশ স্পষ্ট। অর্থাৎ খুব সহজেই এ এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের গ্রাফ বা পরিসংখ্যানরেখা ব্যাখ্যা করা যায়। আমি সেই আশির দশক থেকে প্রায়ই গদখালী, পানিসারের কৃষি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে আসছি। প্রতি বছর যাওয়া না হলেও দু-এক বছর পরপর যাওয়া হয় ফুলের রাজ্যে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে গদখালীর ফুল নিয়ে একটি ফলোআপ প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। গত তিন বছরে কতটুকু পরিবর্তন এলো গদখালীর কৃষকের জীবনে তা দেখতে আবার ছুটে গিয়েছিলাম নভেম্বরে। সপ্তাহ দু-এক আগের লেখায় গদখালী-পানিসার এলাকার জীবনচিত্রের যে পরিবর্তন আমি দেখে এসেছি তা তুলে ধরেছি।

প্রিয় পাঠক! আজ আপনাদের এক উদ্যমী তরুণের গল্প বলতে চাই। যে কিনা ফুলের রাজ্যে বপন করেছেন নতুন স্বপ্নের বীজ। কৃষিপ্রকৌশলী মাহবুব আলম। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন যশোরের সেচ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। পেশাগত দায়িত্বের ভিতরে থেকেই এই তরুণ স্বপ্ন দেখেছেন কৃষির প্রচলিত প্রেক্ষাপট পাল্টে দেওয়ার। আর স্বপ্নক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের রঙিন অর্থনীতির কৃষিক্ষেত্র যশোরের গদখালীকে। ফুল চাষের মাধ্যমে বিস্ময়করভাবে পাল্টে যাওয়া এ ক্ষেত্রে এখন শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের এক কর্মউদ্যোগ। খাদ্যশস্যের জমিতে ফুল চাষই এখন আর শেষ কথা নয়, সেখানে ঢুকে পড়েছে সমন্বিত চাষ কার্যক্রম। গদখালীর ফুলের মাঠে এখন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। অনুশীলন শুরু হয়েছে আধুনিক পলিনেট হাউসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কৃষি। এ এলাকার সাতজন কৃষককে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন তৈরি করে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত পলিনেট হাউস। কৃষকের কাছে এ উদ্যোগগুলো নিয়ে এসেছেন বিএডিসির তরুণ প্রকৌশলী মাহবুব আলম।

শীতের সকালে ফুলের রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় মাহবুবের সঙ্গে। জানান, ফুল চাষের আধুনিকায়ন নিয়ে কৌতূহল জন্মে তার ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ প্রচারিত নেদারল্যান্ডস, চীন, কাতার, মিসরে ফুল চাষের প্রতিবেদনগুলো দেখে। তিনি বলেন, ‘আপনার অনুষ্ঠান আমার কাছে উইকিপিডিয়ার মতো, এখান থেকেই বিশ্বকৃষি সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানি বুঝি। আপনার অনুষ্ঠান দেখেই এ প্রকল্পের কথা আমি চিন্তা করি।’ বড় ভালো লাগে তার কথা শুনে।

মাহবুবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রবেশ করি কৃষক শের আলী সরদারের গ্রিন হাউসে। এই শের আলীই ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম ফুল চাষ শুরু করেন। এরপর নেদারল্যান্ডসের গ্রিন হাউস দেখে নিজের মতো করে বাঁশ আর পলিথিন দিয়ে তৈরি করেন পলিনেট হাউস। সেই শের আলী আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত গ্রিন হাউস পেয়ে বেজায় খুশি। বললেন, শুধু ফুলই নয়, এ নেট হাউসে চাষ করছেন নানারকম শাক-সবজিও। সবচেয়ে বড় কথা, একটা বড় সমস্যার সমাধান পেয়েছেন তারা। আগে তাদের নিজস্ব উপায়ে তৈরি বাঁশ-পলিথিনের নেট হাউসে চাষকৃত জারবেরা ফুলের ঘাড়টি বেঁকে যেত। ইউরোপে চাষকৃত ফুলের মতো সোজা থাকত না। ফলে বাজারে তাদের ফুলটার দাম থাকত কম। কিন্তু এই আধুনিক নেট হাউসে ডিপ ওয়াটার ইরিগেশনে চাষ করা জারবেরা ফুলের ঘাড়টি থাকে সোজা।

ফুল চাষ নয় শুধু, যে কোনো চাষের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন সঠিক মাত্রায় পানি ব্যবহার। যাদি সৌরশক্তিকে কাজে লাগানো যায় তাহলে কমে যায় সেচ ব্যয়। যদি কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যায় তাহলেও আরেক দফা বাঁচে অর্থ। সেই সঙ্গে বাঁচে জনস্বাস্থ্য। এমন বহু চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটেছে এ গদখালীর মাঠে মাঠে স্থাপিত সাতটি বিশালাকার পলিনেট হাউসে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত ১৫টি ডাগওয়েল। রেইন ওয়াটার ইরিগেশন ব্যবস্থাও চোখে পড়ে। বৃষ্টির পানি জমা করা হয় কুয়োর ভিতর। সৌরবিদ্যুৎ-চালিত মর্টারে সেই পানি তুলে নেওয়া হয় ট্যাংকে। সেখান থেকে বিভিন্ন আউটলেটের মাধ্যমে সেচ দেওয়া যায়। আধুনিক পলিনেট হাউসে রয়েছে আলো ও তাপ নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা। ইউভি পলিথিন আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, ইনসেক্ট নেট দেয় পোকা-মাকড় থেকে সুরক্ষা। আলো নিয়ন্ত্রণ ও ফগারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাপমাত্রাও।

মনোয়ারা বেগমের শেড। ২০১৩ ও ২০১৭ সালে মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় আমার। অল্প সময়ে তিনিও গুছিয়ে নিয়েছেন কৃষি। আর এবার বিএডিসির কর্মসূচির সুবাদে তার খেতেও গড়ে উঠেছে বিশালাকার এ শেড। তিনি বললেন, ‘এ শেডে পোকা-মাকড় আসে না, তাই কীটনাশক দিতে হয় না। ঘাসও জন্মায় না, ফলে নিড়ানি খরচ বেঁচে যাচ্ছে। বাইরের ধুলাবালি আসতে পারে না বলে ফুলের রংও হয় সুন্দর।’ এটাই আশার কথা যে, এই আধুনিক ছাউনি বা শেড এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর কারণে এখানে ফুলের মান যেমন ভালো হচ্ছে, একইভাবে অন্যান্য কৃষিপণ্যেরও শুদ্ধতা রক্ষা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এ শেডে উৎপাদিত ফুল-ফসলের বাজার নিয়ে। বাজারের অন্যান্য ফুল-ফসলের সঙ্গে মিশে গিয়ে পৃথক মূল্যায়ন তো আর পাচ্ছে না। কৃষিপ্রকৌশলী মাহবুব জানালেন পণ্যের বাজারব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখারও উদ্যোগ রয়েছে তাদের। সেখান থেকেই মোবাইল ফোনে কথা হয় বিএডিসির চেয়ারম্যান ড. সাইদুল ইসলামের সঙ্গে। তাদের এমন উদ্যোগের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। এখানে উৎপাদিত ফল-ফসলের বাজার নিয়ে তাদের কী ভাবনা সে বিষয়ে জানতে চাই। তিনি বলেন, ‘কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য সরকার নানান কার্যক্রম নিয়েছে। এসব পণ্যের বাজার নিয়ে যেমন চিন্তা আছে, বাইরের দেশে এসব পণ্য রপ্তানির কথাও আমরা ভাবছি।’

যে যে কৃষকের জমিতে এ গ্রিন হাউস গড়ে উঠেছে, পাল্টে গেছে তাদের কৃষিচিন্তা। পানিসারের সফল ফুল চাষি ইসমাইল হোসেনের জমিতেও গড়ে উঠেছে সমন্বিত চাষের এই গ্রিন হাউস। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘আপনার অনুষ্ঠানে এ রকম নেট হাউস দেখে ভাবতাম আমরাও যদি এমন নেট হাউসে ফুল চাষ করতে পারতাম! আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।’

সমন্বিত চাষব্যবস্থা ঘিরে এ এলাকায় বিভিন্ন সংগঠনের কৃষিভিত্তিক নানা সহায়তাও যুক্ত হয়েছে। আঞ্চলিক উন্নয়ন সংগঠন আরআরএফের কর্মীদের দেখা গেল পলিনেট হাউস আছে এমন খেতের জন্য জারবেরার চারা বিতরণ করতে।

বিএডিসির এ উদ্যোগের মাধ্যমে ফুল চাষের রাজধানী গদখালীতে কৃষির নতুন এক পরিবর্তন সূচিত হতে চলেছে। পলিনেট হাউসসহ আধুনিক কৃষি সহায়তার এ কার্যক্রমগুলো নিয়ে নানাভাবে অগ্রসর হচ্ছে বিএডিসি। সত্যিই বিষয়টি ভালো লাগার। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ইংল্যান্ড সব জায়গা থেকে কৃষির নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা, প্রযুক্তি আর অনুশীলন তুলে ধরেছে। এগুলো দেশের অনেক কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তার দৃষ্টিতে পড়েছে। অসংখ্য কৃষক বিদেশি সেরা অনুশীলনগুলো নিজের মাঠে প্রয়োগ করে সাফল্যের নজির গড়েছেন। কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বহির্বিশ্বের আধুনিক কৃষি অনুশীলন এভাবে কৃষকের মাঠে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের এই নজির সত্যিই আশাজাগানিয়া। মাহবুব আলম বলছিলেন, গ্রিন হাউসে এভাবে সমন্বিত কৃষি আবাদ প্রযুক্তি তিনি ছড়িয়ে দিতে চান অনেক স্থানে। আজকের দিনে কৃষি উৎপাদন পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকের আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা না থাকায় পিছিয়ে থাকেন তারা। অনেক ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতিগত শিক্ষায় সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা বা কর্মীরাও তেমন অগ্রসর নন। কিন্তু বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে কৃষিতে বিজ্ঞানসম্মত সুবিধা তথা প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা। গদখালীতে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদনব্যবস্থাসহ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মিশ্র ফসল উৎপাদনের সর্বাধুনিক এ ব্যবস্থা কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের একটি প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে পাল্টে গেছে যশোরের গদখালীর চেহারা। আধুনিক কৃষির যে শিল্পসম্মত চেহারা এ এলাকার নতুন সমৃদ্ধির কথাই জানান দিচ্ছে। আশা করি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনাময় অন্যান্য জেলায়ও আধুনিক কৃষি উদ্যোগের এ ধরনের সরকারি সহায়তার সম্প্রসারণ ঘটবে। এতে কৃষক যেমন ক্ষমতায়িত ও লাভবান হবেন, একইভাবে উদ্বুদ্ধ হবেন নতুন উদ্যোক্তারাও। কৃষিতে লাভজনক ও কার্যকর বিনিয়োগেরও একটি প্রেক্ষাপট রচিত হবে। পরিশেষে ধন্যবাদ জানতে চাই বিএডিসির চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম ও কৃষিসচিব মো. নাসিরুজ্জামানকে যাদের তত্ত্বাবধানে প্রকৌশলী মাহবুব আলম এ প্রকল্প মাঠে নামাতে পেরেছেন। মাহবুব আলমকেও ধন্যবাদ। তার মতো স্বপ্নবান তরুণদের হাত ধরেই আমাদের কৃষির নতুন ইতিহাস রচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

                মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর