মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর স্বাদ সব জীবকেই গ্রহণ করতে হবে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মৃত্যুর স্বাদ সব জীবকেই গ্রহণ করতে হবে

গত রবিবার নঈম নিজামের ‘মান্নান ভাই, হজরত ওমর ও উবারচালকের কথা’ এক অসাধারণ লেখা। লেখার মধ্যে যেন বগুড়ার সারিয়াকান্দির মান্নানকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। বগুড়ার চন্দনবাইসা-সারিয়াকান্দি-ধুনটের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। সারিয়াকান্দি নৌকায় গেছি, গাড়ি-ঘোড়াতে গেছি, পায়ে হেঁটে গেছি- এমনকি ধুনটে হেলিকপ্টারে গেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধে বগুড়ার আবদুল খালেক খসরু যমুনার নিশ্চিন্তপুর যুদ্ধে শহীদ হয়। তাকে কবর দিতে পারিনি, ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বগুড়া যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরুর বাড়িও ছিল চন্দনবাইসা। দারুণ লেগেছে লেখাটি। খুব ছোটবেলায় বিখ্যাত কবি মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়েছিলাম। শান্তিকুঞ্জের যে ঘরে বসে কবি বিষাদ সিন্ধু লিখেছিলেন এখন আমি মাঝেমধ্যেই সেই ঘরে বসে কাজ করি। বগুড়ার মান্নান যখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তখন আমি ছিলাম নির্বাসনে। সেই সময়ের ছাত্রনেতা রাজ্জাক-প্রদীপ-শাজাহান-মকবুল হোসেন খোকা এরা অনেকেই আমার প্রিয় কর্মী ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। আজকাল অতীত নিয়ে কেউ ভাবে না। বর্তমানের তুবড়ি ছুটিয়ে সবাই হাওয়ায় ভাসছে। অতীতহীন বর্তমান যে শূন্য বা অসার সে চিন্তাই যেন কারও নেই। তাই মান্নানকে নিয়ে লেখাটি আমাকে আলোড়িত করেছে, করেছে অভিভূত। সঙ্গে হজরত ওমর (রা.) এবং ছেলের সঙ্গে এক উবারচালকের কথাবার্তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। আজ আমাদের দেশে অনেক লোকই ব্যাংকে গচ্ছিত গরিবের টাকা লুট করে বড়লোক হয়েছে। সবচাইতে চরম দুঃখের বিষয়, এসব অর্থলোলুপ চোর যেভাবেই হোক সরকারের সমর্থন পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সময় এখন আওয়ামী লীগ, আগে ছিল বিএনপি, পাকিস্তানের সময় মুসলিম লীগ- রং বদলে এরা বিশ্বসেরা।

মনটা ভালো নেই। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আমার এক পরম হিতৈষী ইন্তেকাল করেছেন। জনাব বুলবুল খান মাহবুব বাম ঘরানার রাজনীতির এক পথিকৃৎ। হুজুর মওলানা ভাসানীর ছায়াসঙ্গী। চিররোগা কবি বুলবুল খান মাহবুব মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিলেন। কবি হিসেবে একজন মানুষের যা করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি করেছেন। আজকাল সমাজে যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মুক্তিযুদ্ধটা তার চেয়ে সহজ কিছু ছিল না। ১ লাখ সাধারণ মানুষ সামাল দেওয়ার চাইতে দু-চার জন কবি সামাল দেওয়া অনেক বেশি কঠিন। আল্লাহর দয়ায় সে অসাধ্য কাজটি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমি সম্ভব করতে পেরেছিলাম। তখন থেকেই বুঝেছিলাম, মেধাবী মানুষদের বেঁধে রাখা যায় না। তাদের মুক্ত করে ছেড়ে দিতে হয়। আমি তা-ই করেছিলাম। এক কবি আরেক কবিকে যেখানে খবি বলে সেখানে দেশের খ্যাতনামা আট-দশ জন প্রখ্যাত কবি নির্বিবাদে মহানন্দে মহানন্দপুর কাদেরিয়া বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে সাপ্তাহিক ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদনা করতেন, কোনো বিবাদ বাধেনি। বুলবুল খান মাহবুব, রফিক আজাদ, মাহবুব সাদিক, সায্যাদ কাদির, আবু কায়সার, কাজী আতোয়ার, সোহরাব আলী খান আরজু, আলী হোসেন, আলী আজগর খান দাউদ এ রকম ২০-২৫ জন এক মধুর পরিবেশে যুদ্ধের সময় কাটিয়েছেন। এদের মধ্যে বুলবুল খান মাহবুব মাটিকাটা জাহাজ দখলের যুদ্ধের পর গর্জনায় কমান্ডার খোরশেদ আলম বীরপ্রতীক গুলিবিদ্ধ হলে তাকে ছনখোলা থেকে হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত বয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সফলভাবে সে দায়িত্ব পালন করে তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘জখমি সাথীকে নিয়ে আমরা দশজন’, যা খুবই সমাদৃত হয়েছিল পাঠক মহলে। সেই বুলবুল খান মাহবুবের স্ত্রী তাহমিনা মাহবুব রেবা গত বৃহস্পতিবার ইহধাম ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার জানাজায় শরিক হয়েছিলাম বাদ জুমা টাঙ্গাইল গোরস্থান মসজিদে। অবহেলিত প্রায় পরিত্যক্ত টাঙ্গাইল গোরস্থান এখন চোখে পড়ার মতো। মাদ্রাসা, মসজিদ, গোরস্থান সে এক চমৎকার পরিবেশ। রাফিয়া আক্তার ডলি এমপির বাবা মরহুম খন্দকার আবদুর রউফ মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটিতে ছিলেন। সম্পর্কে আমার নানা। নানীর হাতে খাবার যে খেয়েছে তার অবশ্যই ১০ বছরের আয়ু বেড়েছে। রউফ নানাকে দেখে আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো এত ভালো মানুষ কী করে শান্তি কমিটিতে গেলেন! পরে দেখেছি সবাইকে শান্তি কমিটিতে যেতে হয়নি। সরকার যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়েছে, ভালোমন্দের বিচার করেনি। তা না হলে করটিয়া কলেজের অধ্যাপক খলিল স্যার, ঘাটাইল স্কুলের প্রধান শিক্ষক শামসুজ্জামান স্যারের মতো মানুষের নাম কেন শান্তি কমিটিতে থাকবে? পূর্ব পাকিস্তানের সব ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন শান্তি কমিটিতে। যার বারো আনাই ছিল মুক্তিবাহিনী বা আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর খন্দকার আবদুর রউফ নানা দিন-রাত খেটে মসজিদ-মাদ্রাসা-গোরস্থানের উন্নয়ন করেছেন। তার গড়া মসজিদে গত শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করেছি। ভাবী তাহমিনা মাহবুব রেবার জানাজায় বুলবুল খান মাহবুব দু-তিন মিনিট কথা বলেছেন যা হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। ভদ্রলোকের ৮০ বছরের ওপরে বয়স। ২৫-৩০ বছর সব সময়ই অসুস্থ। ভালো করে কথা বলতে পারেন না। তবু স্ত্রীর জানাজায় অসম্ভব সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তার জীবনের যা কিছু সাফল্য তার স্ত্রীকে অবলম্বন করে।

এই রেবা ভাবীর সঙ্গে আমারও কঠিন আত্মিক সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আমি যখন নির্বাসনে তখন আমার বিয়ে নিয়ে অনেকেই ছোটাছুটি করেছেন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক চেষ্টা করেছেন। নির্বাসনে থাকায় মেয়ের পছন্দ তো বাপের নয়, বাপের পছন্দ তো মেয়ের নয়। অনেকের চিন্তা কোনো দিন দেশে ফিরতে পারবে না। ভারতীয় মেয়ে বিয়ে করলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তা আমার ইচ্ছা ছিল না। ’৮০-এর আগে বিয়ের কথা ভাবিইনি। মনে মনে স্থির করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না করে বিয়ে করব না, মাংস খাব না। বিয়ের সঙ্গে যে হত্যার বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই তা বুঝিনি। বয়স কারও জন্য বসে থাকে না। হারিয়ে গেলে হয়তো সব ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের যৌবন এমন জিনিস যা কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। তাই কী করে যেন আমার মা নাসরীনের মাকে চিঠি দিয়েছিলেন নাসরীনকে তার ছেলের বউ করতে চান। নাসরীনের মা নার্গিস হামিদ কোরায়শী কুমুদিনী কলেজের অধ্যক্ষ। মার চিঠিতে রাজি হয়েছিলেন। রাজকন্যা যখন ভারতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ঠিক তখনই জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ পুলিশ পাঠিয়ে পাসপোর্ট সিজ করেছিলেন। আবদুল হামিদ এবং নার্গিস হামিদ কোরায়শী নির্বিবাদী মানুষ। পুলিশ পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় তারা খুবই বিব্রত ও ভীত হয়েছিলেন। যে কারণে তারা পিছিয়ে যান। প্রায় তিন বছর পর শুনতে পাই রাজকন্যার আর বিয়ে হচ্ছে না। শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে গেছে। এ সময় বুলবুল খান মাহবুবের স্ত্রী, তার ছেলে রাজন এবং আমার ভাবী লায়লা সিদ্দিকী, ছেলে বাপ্পীকে নিয়ে বর্ধমানে যান। মা তাদের বলে দেন তোমরা দুজন গিয়ে নাসরীনকে জিজ্ঞাসা করবে, বিয়েতে সে রাজি আছে কিনা। সে রাজি থাকলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব। পরে তাই হয়েছে। ৭০০ টাকার শাড়ি পরে রাজকন্যা দমদমে গিয়েছিল। আজ আমার সন্তান দীপ-কুঁড়ি-কুশি এটা রেবা ভাবীর অবদান। তাই হঠাৎ রেবা ভাবীর মৃত্যুতে বড় আঘাত পেয়েছি। সব সময় অসুস্থ থাকেন বলে মনে হতো বুলবুল খান আগে যাবেন। কিন্তু রেবা ভাবী চলে গেলেন। চমৎকার মানুষ ছিলেন। দু-তিন মাস আগেও তার বাড়ি গিয়েছিলাম। পাঁচ তলা বাড়ি। পাঁচ তলায় উঠতে ইচ্ছা করে না আর এখন উঠতেও পারি না। কত কথা, গল্প হলো। যে রাজন ’৮২-৮৩ সালে ছোট্টটি বর্ধমানে গিয়েছিল সেও আজ সন্তানের বাবা। কী করে যেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বন্ধু রক্কুর মেয়ে বিয়ে করেছে। মেয়েটি দৃষ্টিহীন স্বামীকে ভালোই দেখাশোনা করছে। যাই হোক, জন্মের পর মৃত্যুই সত্য, মৃত্যুর হাত থেকে কারও মুক্তি নেই। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন রেবা ভাবীকে মাফ করেন, বেহেশতবাসী করেন।

ঢাকা সিটি নির্বাচন এখন এক বিরাট আলোচনার বিষয়। রেডিও-টিভি-পত্রপত্রিকায় বেশুমার আলোচনা। প্রার্থীরাও ছোটাছুটি করছেন তাদের সাধ্যমতো। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা যেভাবে চলছে তাতে খুব খারাপ বলা যাবে না। কিন্তু ফলাফল পূর্বনির্ধারিত কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। দুটি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলে সরকারের কিছু আসে যায় না। কিন্তু নির্বাচনটা যে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ! ঢাকা বিরোধীদের হাতে চলে গেলে বিশেষ করে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির হাতে, সরকারের জন্য সেটা হবে এক ভয়াবহ ঘটনা। অন্য দশটা সিটি করপোরেশন-উপজেলা-পৌরসভা আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হলে কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু ঢাকা হাতছাড়া হলে সত্যিই খবর আছে! অন্যদিকে যে যাই বলুন যেভাবেই বলুন এখন বিএনপির অনেক নেতার ইমান ঠিক নেই। আর বিএনপির অনেকেই বলছেন দলে কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব করার পর্যায়েও সরকারের লোক আছে। কথাটা একেবারে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া গেলে ভালো ছিল। কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো সহজ উপায় নেই। কিছু না কিছু অবশ্যই আছে। তাই সিটি নির্বাচন নিয়ে নির্বাচনের পরই যা আলোচনা করার করব। ভোটারের উপস্থিতি খুব একটা সহজ হবে না, খুবই কঠিন হবে। আজ কদিন কালিহাতী-বহেরাতলী হয়ে সখীপুরে যাতায়াত করছি। কয়েক জায়গায় ভাঙাচোরা ছাড়া রাস্তাটি ভালোই। ভাঙা জায়গাগুলো না থাকলে যাতায়াত খুবই মসৃণ হতো। খারাপ থাকার কারণে আধঘণ্টা- চল্লিশ মিনিটের রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হয়Ñ তবু ভালো। কদিন থেকে চোখে পড়ছে বহেরাতলীর পশ্চিমে ঝপঝপিয়া খাল, নকিল বিল থেকে উত্তরে বংশাইয়ে গিয়ে মিশেছে। এখন মুখ খোলা আছে কিনা জানি না। খালটি বেশ কিছুদিন খনন করা হচ্ছে। যান্ত্রিক উপায়ে খননে এলাকার লোকজন তেমন লাভবান হচ্ছে না। খালটি ৩০-৩৫ ফুট, কোনো কোনো জায়গায় হয়তো ৪০ ফুট পাশ। নকিল বিল থেকে উত্তরে ডাবাইলের দিকে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার বেকু দিয়ে কাটা হয়েছে। খনন মানে দুই পাড়ে এক-দুই ফুট; কোথাও বা তিন ফুট উঁচু করে মাটি তুলে রাখা। একবার বৃষ্টি এলেই অর্ধেক মাটি আবার খালে যাবে আর বর্ষায় আবার যা ছিল তাই হবে। মানে সরকারি টাকা কয়েকজনের পকেটে তোলা! ১৫-২০ বছর আগে গ্রামীণ অবকাঠামোর এসব কাজ দৈনিক শ্রমিক দিয়ে করা হতো। শত শত মাটি কাটা লোকজন মাটি কাটত দেড় শ-দুই শ টাকা পেত। প্রতিদিন গ্রামেগঞ্জে টাকাগুলো ছড়িয়ে যেত। এখন একজন শ্রমিকের মজুরি সাড়ে তিন-চার শ টাকা। এক দিনে একটা বেকু যে কাজ করছে সে কাজ না হলেও হাজার-বারো শ শ্রমিক করত। যে কারণে আমি সংসদে থাকতে বেশ কয়েকবার প্রস্তাব তুলেছিলাম, বড় বড় রাস্তায় বড় বড় যন্ত্র ব্যবহার করা হয় হোক কিন্তু গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা অথবা ছোট খাল খননে কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি চলবে না। সরকারের উদ্দেশ্যই গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু টাকা গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। বর্তমান পদ্ধতিতে টাকাটা মোটেই ছড়িয়ে যাচ্ছে না, বরং অল্প কিছু মানুষের হাতে যাচ্ছে। ঠিকাদাররা এক-দেড়-দুই হাজার লোককে প্রতিদিন খাটানোর চাইতে একটা-দুইটা বা তিনটা বেকু খাটানোয় অনেক স্বচ্ছন্দবোধ করেন। ১ কোটি টাকার কোনো কাজ সাধারণ শ্রমিক দিয়ে করলে হয়তো এক মাস লাগত, শ্রমিক লাগত ২০-২৫ হাজার। সেখানে দুই বা তিনটি বেকু ১৫ দিনে করে ফেলছে। টাকা যাচ্ছে ঠিকাদার আর তিন বেকু মালিকের পকেটে। সরকারের যে উদ্দেশ্য তা এখানে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। সেজন্য আবারও বলছি, গ্রামীণ উন্নয়নে গ্রামের কাজকর্মে সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। বড় রাস্তা, গ্রামের এলজিআরডি পাকা রাস্তা সেগুলোয় যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়, করুক; কিন্তু কাঁচা রাস্তা, নদী এবং খাল খননে যত্রতত্র বেকু ব্যবহার করে গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান কমে এসেছে। সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। ধনীকে ধনী বানানোর জন্য সরকার নয়, গরিবের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের হেফাজতের জন্য সরকার। আজ হোক কাল হোক, একটা মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটবে। শহরবাসী অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু গ্রামগঞ্জের কেউ ভোলেনি। ব্রিটিশ আমলে মহাজনের ঋণে জর্জরিত কৃষক যখন একেবারে মরতে বসেছিল তখন গরিব-মেহনতি মানুষের মুক্তিদাতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঋণ সালিশি বোর্ড করেন। মহাজনের চক্রবৃদ্ধি সুদের কারবার বাতিল করেছিলেন। যে কারণে এখনো গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষ শেরেবাংলার কথা শুনলে কাঁদেন, তারা শেরেবাংলাকে তাদের মুক্তিদাতা মনে করেন। বর্তমান অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে এনজিও নেই, এনজিওর অর্থলগ্নি নেই। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে ঋণ। কোনো বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের কিস্তি নেই। সারা দিন কাজ করে সপ্তাহে কিস্তি শোধ করার জন্য। হাতে কিছু থাকে বলে মনে হয় না। বছর দুই আগে আমার ঢাকার বাসায় কয়েকজন কাজ করছিল। তাদের মধ্যে এক রডমিস্ত্রি ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে হাজারে ২৫ টাকা। লোকটা খুবই খুশি। সপ্তাহে হাজারে ২৫ টাকা, মাসে ১০০, বছরে ১২০০ টাকা। ১০০০ টাকা নিয়ে বছর শেষে ২ হাজার ২০০ টাকা শোধ করতে হচ্ছে। তবু খুশি। একবারও ভেবে দেখছেন না, তাকে যা দিয়েছে বছরে তার দ্বিগুণ দিতে হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণের সুদ শতকরা ১৩-১৪-১৫-১৬ টাকা। এ সুদে ঋণ নিয়েও কেউ সুস্থভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। অন্যদিকে হাজারে ২৫ টাকা সপ্তাহেÑ কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? কিন্তু আমরা ভেবে দেখছি না এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে গ্রামকে গ্রাম দেউলিয়া হয়ে যাবে। ঋণের বোঝায় শুধু বাড়িঘর বিক্রি করলে হয়তো চলবে না, বউ-পোলাপানও বিক্রি করতে হবে। যদিও এ দেশে ছাগল-ভেড়া-হাঁস-মুরগির একটা বাজারমূল্য আছে, সহজেই বিক্রি করা যায়। কিন্তু মানুষের তেমন বাজারমূল্য নেই। তাই মানুষ বিক্রি করা এক কঠিন কাজ। এখন কোনো কোনো স্থানে কাজের লোকের হাট বসে। আগে শুনতাম গরুর হাট, ছাগলের হাট, মহিষের হাট এখন মানুষের হাটও আছে। টাঙ্গাইলের করটিয়ায় প্রখ্যাত বা বিশাল মানুষের হাট। প্রতি উপজেলায় ধান বোনা ও কাটার সময় এ রকম হাট দেখা যায়। সেখানে উত্তরবঙ্গের মানুষই বেশি। কিন্তু এটা শুভ নয়। মানুষের হাট হবে কেন, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়। তার শ্রম-ঘাম বিক্রি হয়। ঠিক আছে তা হোক। সব মানুষের পরিশ্রম করে খাওয়া উচিত। কিন্তু তাদের যেখানে পাওয়া যাবে বা পাওয়া যায় সেটাকে হাট বলে উল্লেখ করা বা বলা মোটেই সম্মানজনক নয়। কিন্তু গত ২০-২৫ বছর আমাদের অঞ্চলে প্রায় সব জায়গায় শ্রমিক হাটি, লেবার হাটি বা মানুষের হাট বলে অনেক জায়গা প্রসিদ্ধি পেয়ে গেছে।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর