বুধবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বেহাল অবস্থায় মোদির ভারত

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বেহাল অবস্থায় মোদির ভারত

১ ফেব্রুয়ারি ভারতের লোকসভায় ২০২০-২১ সালের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। কিন্তু প্রাক-বাজেট নিয়ে কোনো সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী তাকে ডাকছেন না। এ নিয়ে সারা দেশে নানা জল্পনা-বিতর্ক চলছে। ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। মোদি সরকার গোটা ভারতকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।

মোদি সরকারের নোটবন্দী এবং একরকম জোর করেই মধ্যরাতের বিশেষ অধিবেশনে জিএসটি করব্যবস্থা চালু করে দেওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিং, রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজনসহ দেশের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এর ফলে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাবে। রীতিমতো পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছিলেন অন্তত ২ শতাংশ কমে যাবে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি। কিন্তু বাস্তবে যা হয়েছে তা আরও শোচনীয়। পরিসংখ্যান বলছে, অর্থনীতির অধোগতি সর্বনিম্নে এসে পৌঁছেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, যা একরকম অবধারিতই ছিল। এই বিশালসংখ্যক শিল্পে কর্মরত ছিলেন দেশের কর্মশক্তির সবচেয়ে বড় অংশটাই। আর বৃহৎ শিল্পে উৎপাদন কমেছে। ফলে সেখানেও থমকে গেছে বৃদ্ধি। একাধিক সম্মেলনে ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে শিল্পপতিরাও গোপন করেননি যে গোটা শিল্পব্যবস্থাই এক চরম অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। নতুন বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে (যা কিনা অর্থনৈতিক গতি বৃদ্ধির সূচক বলে ধরা হয়) শিল্পপতিরা রীতিমতো আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। এর পরও হুঁশ ফেরেনি মোদি সরকারের। তাদের আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে কোনোরকম পরিবর্তন তো দূরের কথা, দেশের বিরাট সংখ্যার শ্রমশক্তি ও কর্মচারীর অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায়নি সরকার।

ডিজেল-পেট্রল এবং রান্নার গ্যাসে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এ বছর। একই সঙ্গে রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিন তেলের মতো জ্বালানিতে ছাঁটাই করা হয়েছে ভর্তুকি। ফলে কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে গরিব ও মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনে। অথচ ধনী ও করপোরেটের জন্য করছাড় দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি তাদের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ মওকুফ করেছে ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বেহালদশা ধামাচাপা দিতে এ বছরই রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বেনজিরভাবে কেড়ে নিয়েছে তাদের গচ্ছিত মূলধন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে দেশত্যাগী ললিত মোদি ও নীরব মোদিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে যেতে পারেনি এ সরকার। অথচ মাত্র কয়েক হাজার টাকা কৃষিঋণ পরিশোধ করতে না পারলে আত্মহত্যা করতে হয় গরিব চাষিকে। প্রতি ৪৫ মিনিটে একজন চাষিকে আত্মহত্যা করতে হয় এ দেশে।

পশ্চিমবঙ্গে শিল্পক্ষেত্র তথা অর্থনীতির হাঁড়ির হাল আরও আগেই শুরু হয়েছে। মমতা ব্যানার্জির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নতুন শিল্প স্থাপন একেবারে স্তব্ধ। চালু কলকারখানাগুলোও একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক ক্ষেত্রে মমতা সরকারের একমাত্র বলার মতো বিষয় হলো পাহাড়প্রমাণ ঋণ, যা কিনা আসলে প্রত্যেক রাজ্যবাসীর মাথার ওপর ঝুলছে।

এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি তো বটেই, সাধারণ বুদ্ধিও বলে, কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে টিকে থাকাটাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে অন্যতম শর্ত। কিন্তু তাতেও বাদ সেধেছে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। পরিস্থিতি এমনই যে পিয়াজ ও আলুর মতো নিত্যব্যবহার্য সবজিও কিনতে পারছে না মানুষ। বাড়তে বাড়তে পিয়াজ দেশের দক্ষিণভাগে একসময় ২০০ টাকা কিলো হয়ে গিয়েছিল। এখন পশ্চিমবঙ্গসহ সারা দেশে তা দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা কিলো। শীতকালে আলুর দাম সাধারণত কমই থাকে। কিন্তু সেই আলুও ২৫ টাকা কিলো। অন্যান্য শাক-সজির মধ্যে বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাসিকের পিয়াজ চাষি তার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন ৫ থেকে ৮ টাকা কিলো দরে। কলকাতায় মানুষকে সেই পিয়াজ কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকা কিলোয়। কৃষক ও ক্রেতার মাঝখানে বসে লাভের গুড় লুটে নিয়ে যাওয়া ফড়িয়ারা বছরভর প্রশ্রয় পেয়ে গেছেন শাসক শ্রেণির কাছ থেকে। ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী এবং গুন্ডা কন্ট্রোল করা মুখ্যমন্ত্রী কেউই তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি।

কাজের বাজারের মন্দাদশা সামনে এসেছে একাধিক পরিসংখ্যানে। মোদি সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে ২ কোটি লোক চাকরি পাবেন। অথচ কোথাও না কোথাও কাজকর্ম করতেন এমন ২ কোটি লোক গত পাঁচ বছরে কাজ হারিয়েছেন। বাদের তালিকায় রাখা হয়েছে হাজার হাজার কর্মীকে। নতুন কোনো নিয়োগ নেই। একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ছাঁটাই প্রক্রিয়া চালিয়ে সেগুলোকে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছে মোদি সরকার। এ রাজ্যে কলকাতা পৌরসভায় ফাঁকা পড়ে রয়েছে ২৬ হাজার শূন্যপদ। কর্মসংস্থান ও রোজগারের প্রকৃত চিত্র হলো দিনে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা রোজগার। কারও একটু বেশি, অনেকের আরও কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই ছুটি, পেনশন, পিএফ, এইএসআইসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার ছিটেফোঁটাও। এ কাজের বাজারে আরও একটি নির্মম বাস্তবতা হলো, বাজারে বেকারের সংখ্যা যত বাড়ে মালিকের পক্ষে কম মজুরিতে বেশি খাটিয়ে নেওয়া তত সহজ হয়ে যায়।

দেশের আর্থিক অচলাবস্থা, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা দেশে লাগাতার আন্দোলন-বিক্ষোভ করেছেন বামপন্থিরা। এই একই দাবিতে গত ৮ জানুয়ারি দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাকও দেওয়া হয়। গত বছরের শেষ দিকে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে লংমার্চ করে বাম দলগুলো। দক্ষিণ ভারতে চিত্তরঞ্জন থেকে কলকাতা এবং উত্তরবঙ্গে একসঙ্গে তিনটি লংমার্চ করা হয়।

দেশের আর্থিক পরিস্থিতির এ দৈন্যদশা কোনো বিরোধী দলের অভিযোগ নয়, খোদ সরকারি দফতরগুলোই একের পর এক সমীক্ষায় তা স্বীকার করে নিয়েছে। এ ছাড়া একাধিক সমীক্ষা মোদি সরকার হয় স্বীকার করেনি আর না হয় তা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমনই একটি সমীক্ষায় (এনএসও) বলা হয়েছে, দেশের বেকারত্ব গত ৪৫ বছরের মধ্যে এমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছায়নি। আরও একটি সমীক্ষায় উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছিল, গ্রামবাসী জরুরি জিনিস কেনাকাটায়ও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই সমীক্ষাতেই উল্লেখ করা হয়েছিল জরুরি পণ্যের মধ্যেই নিত্যদিনের আহার্য ও বাড়ির ছেলেমেয়েদের শিক্ষাও পড়ে। অর্থাৎ মানুষ এখন খাওয়া-দাওয়া এবং শিক্ষা খাতেও সমঝোতা করতে শুরু করে দিয়েছে নেহায়েতই কোনোভাবে প্রাণটাকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে।

এর ওপর এই রাজ্যের বাড়তি সমস্যা হিসেবে রয়েছে ফড়িয়াদের খপ্পরে পড়ে কৃষকের প্রাণান্তকর অবস্থা। কৃষক উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে কৃষিকাজ ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে বন্ধ হয়ে রয়েছে রাজ্যের একের পর এক চা বাগান। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক স্থবিরতার ধ্রুপদী ছবি ফুটে উঠেছে কেন্দ্রে মোদি সরকার ও রাজ্যে দিদি সরকারের রাজত্বে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি এমনই যে ২০২০ সালেও যে এ অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবে, তারও কোনো লক্ষণ নেই।

 

                লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর