বুধবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

পরিবেশ সংরক্ষণ ইমানি দায়িত্ব

ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান

পরিবেশ সংরক্ষণ ইমানি দায়িত্ব

পরিবেশ সম্পর্কে দুনিয়ার সব জাতি আজ সচেতন হয়ে উঠছে। এ দিক থেকে শিল্পোন্নত আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপানের মতো উন্নত দেশ তো বটেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পর্যন্ত টনটনে মনোভাব পোষণ করে। তবে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার ক্ষেত্রে সম্ভবত বাংলাদেশই ব্যতিক্রম।

পরিবেশ দূষিত হতে পারে দুই ভাবে। প্রথমত, কলকারখানার ধোঁয়া বা বর্জ্য পদার্থের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে। একসময় বাংলাদেশ ছিল শিল্পক্ষেত্রে দুনিয়ার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর অন্যতম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশ দ্রুত শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও পরিবেশ সচেতনতার অভাব ইতিমধ্যে সমূহ সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এ দেশে আবাসিক এলাকাতেই গড়ে উঠছে কলকারখানা। এগুলোর ধোঁয়া বাতাস দূষিত করছে প্রতিনিয়ত। শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা কম। তা সত্ত্বেও শহরাঞ্চলে যানবাহনের ধোঁয়া প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। ত্রুটিযুক্ত গাড়ি এর জন্য দায়ী। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করে ধোঁয়া নির্গতকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালানো হয়। পরিবেশ দিবস উপলক্ষে কিছুটা বাড়াবাড়ির আশ্রয় নেওয়া হয়। বিশেষ দিবসটি কেটে গেলে সবকিছু পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ইটভাটার কালো ধোঁয়া। রাজধানীসহ মহানগরগুলোর ধারেকাছে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইটভাটা। এগুলো বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ বায়ুদূষণের নগরী হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত সচেতনতার অভাবে এ দেশে পরিবেশ দূষণ ঘটে বেশি। বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। এ দেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে ধর্মের প্রধানতম বিষয় ইমানের অপরিহার্য অঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ততটা কদর আছে বলে মনে হয় না। দেশের রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ সচরাচর চোখে পড়ে, তা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনায় আনাও কঠিন। মফস্বল শহরগুলোর নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, ড্রেন ইত্যাদির কথা বাদ দিলেও আমাদের রাজধানীতেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব সর্বত্র প্রকট। বস্তি এলাকায় যে নারকীয় অবস্থা বিরাজ করছে তাতে মানবসভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ও আমরা এখন পর্যন্ত অতিক্রম করতে পেরেছি কিনা সন্দেহ হয়।

রেলস্টেশন, স্টিমারঘাট, বাস টার্মিনাল ইত্যাদি স্থানের নোংরা পরিবেশ আমাদের রুচিবোধের সংকটকেই বারবার তুলে ধরছে। এ দেশে পাবলিক ল্যাট্রিন বা গণশৌচাগারে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের শামিল। একটি ধর্মপ্রাণ জাতি বিশেষত যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামে বিশ্বাসী সে দেশের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি এ অবহেলা নিঃসন্দেহে লজ্জা ও হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের ধর্মে ইমানের অংশ হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যে স্বীকৃতি রয়েছে, তার প্রয়োগে আমরা অভ্যস্ত নই। এটা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই অসম্মানজনক নয়, সভ্যতার বিচারেও আমাদের অবস্থানকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে এ বদনামের অবসানে সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাস্তাঘাটের আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। এতে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। কিন্তু নাগরিক সচেতনতা গড়ে না উঠলে, শুধু পৌর কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কোনো নগরীর রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। আমাদের ধারেকাছের বহু দেশে রাস্তাঘাটে আবর্জনা দূরের কথা, থুথু ফেলা পর্যন্ত দ-নীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। পরিবেশকে সুন্দর রাখার ব্যাপারে দুনিয়ার সব জাতিই আজ তৎপর। কে কত পরিচ্ছন্ন হতে পারে, বিশ্বজুড়ে তার প্রতিযোগিতা চলছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত হতাশাজনক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি আমরা ক্রমে অমনোযোগী হয়ে পড়ছি। একসময় খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি শহরকে ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর বলে ধরা হতো। আজ আমরা স্বাধীন জাতি। স্বাধীনতা মানুষের দায়িত্ব বাড়ায়। অথচ আমাদের মধ্যে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। সুন্দরকে অসুন্দর করতেই আমরা যেন বেশি তৎপর। নিজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য অনেকে দরিদ্রতার কথা বলেন। এ যুক্তির কিছুটা হয়তো সত্যি। কিন্তু সার্বিক অর্থে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য দরিদ্রতাই প্রধান সমস্যা নয়। এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। এখানে রুচি বা মননশীলতার প্রশ্নটাই বড়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের জন্যই এ দেশে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়া, চর্মরোগের প্রকোপ একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নোংরা পরিবেশ আরও অনেক রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার এখনো উচ্চপর্যায়ের। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমেই এ হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। ইসলামের প্রিয় নবী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। দুনিয়ার কোনো ধর্মে এ বিষয়টির প্রতি এত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যে অত্যন্ত সংবেদনশীল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ধর্মের এত বড় একটি নির্দেশের প্রতি আমাদের অবহেলা কেন? পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ জেনেও সে ইমানি দায়িত্ব সম্পর্কে জনগণকে তাগিদ দেওয়ার ব্যাপারে মসজিদের ইমাম ও খতিবদের কোনো ভূমিকা নেই কেন? আমাদের সমাজনেতারাও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদাসীন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নির্মল পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে কড়া আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাব্যতাও ভেবে দেখতে হবে।

সর্বশেষ খবর