রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে

গত ২৭ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপাচার্য কর্তৃক আমন্ত্রিত হওয়ার সুযোগে আমি উপস্থিত হতে পেরেছিলাম। বিকাল ৩টায় সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সভাপতির আসন অলংকৃত করবেন, সে চিন্তা মাথায় রেখে সকাল ১০টায় ঢাকা থেকে সড়কপথে রওনা দিই। কিন্তু একেবারেই যানজটমুক্ত থাকায়, লক্ষ্যমাত্রার অনেক আগেই কুমিল্লা সেনানিবাসের কাছে পৌঁছে যাই। কুমিল্লা সেনানিবাসের আগেই মাথায় এক ভূত চেপে বসল। অর্থাৎ কুমিল্লায় সেনাবাহিনী কর্তৃক যে মেডিকেল কলেজটি স্থাপিত হলো, সেটা কী অবস্থায় আছে দেখার জন্য অর্থাৎ পাঁচটি Div. Command যেখানে আছে, সেখানে একটি করে নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। সে ব্যাপারে সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়ার প্রস্তাবকে সে সময়ে আমি অত্যন্ত জোরেশোরে সমর্থন দিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর উপাচার্য হিসেবে। মেডিকেল কলেজ চত্বরে গেলাম কাউকে না জানিয়ে বাইরে থেকে, কিছু কর্মচারী ও ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করে মনে হলো খুবই যুগান্তকারী এবং সঠিক সিদ্ধান্তই আমরা নিয়েছিলাম। অন্যত্র ছাত্রদের মধ্যে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতার অভাব এবং ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত এ পাঁচটি নতুন মেডিকেল কলেজে এ সুযোগ নেই। ঢাকা শহরের বেসরকারি ও সরকারি মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্র নিয়মিত বাবা-মা কর্তৃক কলেজ ক্যাম্পাসে ৭টায় পৌঁছে দেওয়া হলেও তাদের ক্লাসে পাওয়া যায় না। পরীক্ষার সময় অনুপস্থিতির হার ২৫%-এর বেশি হয় বলে পরীক্ষার ফরম পূরণে ব্যর্থ হলে মা-বাবা এসে বলেন আমার সন্তান প্রতিদিনই কলেজে এসেছে, আমি নিজেই তাকে গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়েছি ইত্যাদি অনেক কথা। একই সঙ্গে আমার অত্যন্ত আপন পুত্রবৎ ডা. ক্যাপ্টেন ইমনকে দেখে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। কারণ সে ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে কাজ করছে। ১৯৬৯-৭০ সালে ওই ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে অনেক শুক্রবার গিয়েছিলাম এবং ওইখানে অনেক বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন, যাদের ৪৫ জন ১৯৭১-এর মার্চে শাহাদাতবরণ করেন। ধন্যবাদ বর্তমান সরকারকে, সেনা কর্তৃপক্ষকে অতিসুন্দরভাবে স্মৃতিবিজড়িত ওই স্থানটি সংরক্ষণ এবং ৪৫ জন শহীদের নাম শৈল্পিকভাবে স্থাপন করার জন্য। ক্যাপ্টেন ইমনের আতিথেয়তায় ওই জায়গাটা দেখে এলাম।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সুন্দর ও দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিলেন ছাত্রদের উদ্দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির একটা বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। সবার প্রতি দিকনির্দেশনার এক অনন্য বিশদ সময়োপযোগী ভাষণ দিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ। আমার বিশ্বাস, পুরো উপস্থিতির ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অনেকেই তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ছাত্রদের ত্রুটি, শিক্ষকদের যোগ্যতার এবং দায়িত্বের অভাব, গবেষণায় অনাকর্ষণ, যেখানে ছাত্রদের দিয়েই শিক্ষকরা অনেক গবেষণা কাজের মাঠ পর্যায়ের কাজগুলো করাতে পারেন ইত্যাদি অনেক কিছু। কুমিল্লার বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও ছয়-সাত জন এমপি উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে সীমান্ত এলাকার মুজিবুল হক, আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার ও আবদুল মতিন খসরু। ছিলেন চান্দিনা ও দাউদকান্দি অর্থাৎ মহাসড়কে অবস্থিত দুজন এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফ এবং মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূইয়া। আরও ছিলেন সংরক্ষিত আসনের এমপি সীমা খান।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১১। রাষ্ট্রপতি ছাত্রীদের প্রশংসা করে হাসি-তামাশার মাধ্যমে ছাত্রদের যে উপদেশ দিলেন তা গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। জানি না ছেলেরা তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন কিনা? তিনি একজন উকিল এবং বহুবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার এবং সর্বশেষ মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাঁর বক্তব্য ছিল অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-গরিমায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগে তাঁর কোনো সমাবর্তনের ভাষণ আমি শুনিনি, শুনেছি খ-িত অংশ টেলিভিশনের সংবাদের মাধ্যমে। যেহেতু আমি ফেসবুক বা ইউটিউব দেখি না, তাই শুনতে পারিনি। এবার সশরীরে উপস্থিত থেকে সামনে বসে তাঁর ভাষণ শোনা আমার জন্য এক চমকপ্রদ পাওনা এবং বিরাট অভিজ্ঞতা। ধন্যবাদ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীকে, আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি শুরুতে কুমিল্লার ইতিহাস বলতে ভোলেননি। কুমিল্লার জনপদ বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এ প্রাচীন জনপদ সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন প্রখ্যাত ব্যক্তির পদচারণে। এ ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী, হরদয়াল নাগ, মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, রায়বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায়, সৈয়দ আবদুল জব্বার, অখিলচন্দ্র দত্ত, খান বাহাদুর আবিদুর রেজা চৌধুরী, আবদুর রসুল, খান বাহাদুর আবদুল করিম, নওয়াব মোশাররফ হোসেন, বসন্ত কুমার মজুমদার, কামিনী কুমার দত্ত, শচীন দেববর্মণ, নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, নওয়াব সৈয়দ হোচ্ছাম হায়দার চৌধুরী, বিখ্যাত অনুবাদক লায়লা নুর, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহাস্থবির শীল ভদ্র, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। আজ এ মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁদের আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যৌবনের বিরাট একটা সময় এই কুমিল্লাতেই কাটিয়েছেন তাও উল্লেখ করেন। তারপর বৃহত্তর কুমিল্লার চারজন বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেননি এবং তারা কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে সাহায্য করতে পারেন তাও উপাচার্যকে বলে দিয়ে এলেন।

তিনি বলতে ভোলেননি, কুমিল্লার রসমালাই, গান্ধীজির খাদির ইতিহাস। তিনি সুধীমন্ডলীকে জানিয়ে দেন সপ্তম-বারো শতকের সময়কালে রাজা ভবদেব ও দেব বংশের তৈরি প্রাচীন শালবন বিহারের নিকটবর্তী লালমাই পাহাড়ের কোলঘেঁষে অবস্থিত দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এতদঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রতীক্ষার ফসল। এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১৮ সালে প্রাকৃতিক সুন্দর মনোরম পরিবেশে ২০০.২২ একর ভূমি অধিগ্রহণপূর্বক ১,৬৫৫.৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, যা বর্তমানে চলমান। এ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে তেমনি এ অঞ্চলের প্রভূত উন্নতি ও বিকাশ সাধিত হবে।

আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক উপাচার্যগণ, সিন্ডিকেটের সদস্যবৃন্দ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিআইজি সাহেব। সম্মানিত অতিথিদের সামনে তিনি তুলে ধরেন মাদক পাচারের এক অন্যতম রুট হিসেবে কুমিল্লাকে। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির এ উপলব্ধিকে অনেক বিরাট দিকনির্দেশনা হিসেবে দেখছি। আমার মতে বর্তমানে যেসব তরুণ জাতির ভবিষ্যৎ তারা শুধু ধ্বংস হবে মাদকের থাবায় যা অতীব সহজলভ্য হিসেবে তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা এবং পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকই অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন। গ্রামাঞ্চলে অনেকের নামের আগেই এ বিশেষণগুলো থাকে, যে রকম ১৫ থেকে ১৭টি মাদকদ্রব্যের নাম মহামান্য রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেছেন।

যেমন ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শুধু ছাত্রদের এই নেশা থেকে বিরত থাকতে বলেননি, বরং প্রশাসনকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এখনই সময়, সমূলে নির্মূল করুন। একজন ক্ষুদ্র চিকিৎসক হিসেবে আমার মতে মাদক সেবন এবং সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃক মিথ্যা বলার প্রবণতা, এবং বারবার একই মিথ্যা বলে, মিথ্যাকে সত্যি বলে প্রতিষ্ঠা করার যে অপচেষ্টা এ দুটো দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট। মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের শেষে আমি William Arthur Ward - এর Ten hallmarks of an educated Person -এর প্রথমটি নিবেদন করছি  Educated persons think clearly & logically, live honourably and courageously, Give willingly and generously, and forgive lovingly and graciously.

আসলে সমাজ এগিয়ে যায় তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, জনগণের কঠোর পরিশ্রম ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে। সমাজ অগ্রশীল মানুষের কাছে বিনীত নিবেদন করে, তা কখনো দৃশ্যমান, অধিকাংশ অদৃশ্য। ছাত্রছাত্রীরা সেই অদৃশ্য শক্তি ধারণ করে আর বড়রা পথ দেখায়। আমাদের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই আবেদন রাখব সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের পুরো দশটি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে এবং তাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর