সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

নাসায় ও গিরিগুহায়

আতাউর রহমান

নাসায় ও গিরিগুহায়

‘নাসা’ কথাটার তো মানে হচ্ছে (আমেরিকান) ন্যাশনাল এরোনটিক অ্যান্ড স্পেইস এডমিনিস্ট্রেশন। কিন্তু আমি যদি বলি ‘নাসা’ মানে হচ্ছে নট এগেইন সেভেন এস্ট্রনোটস, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? কেননা পর পর দু’বার ১৯৮৬ সালে একবার ও ২০০৩ সালে আরেকবার ৭ জন নভোচারীসহ দুটো আমেরিকার নভোযান চ্যালেঞ্জার ও কলোম্বিয়া মধ্যকাশে বিধ্বস্ত হওয়ায় মোট ১৪ জন নভোচারীর মৃত্যু ঘটে। চ্যালেঞ্জার যখন উৎক্ষেপিত হয় সে সময় আমি বিলেতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত। বিবিসি টেলিভিশনে সেটা লাইভ দেখাচ্ছিল এবং হঠাৎ দেখতে পেলাম আকাশে বিস্ফোরণ ও আগুনের গোলককু-। সে সময়টাতেই নাসা মানে নট এগেইন সেভেন এস্ট্রনোটস কথাটা খুব চালু হয়ে গিয়েছিল। তবে ২০১৬ সালে আত্মজের কল্যাণে আমি সস্ত্রীক আমেরিকার হিউস্টনস্থ নাসার জনসন স্পেইস সেন্টার পরিভ্রমণকালে দেখলাম, নিহত নভোচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞ দেশবাসী সেন্টারটির মধ্যখানে একটি সুরক্ষিত জায়গায় ওদের প্রত্যেকের নামে একটি করে বৃক্ষ রোপণ করে পরিচর্যা ও গোড়ায় তাম্রফলকে প্রত্যেকের নাম পরিচয় দিয়ে রেখেছেন। গাইডেড্ ট্যুর ওই জায়গায় চলমান ট্রামের গতি কমিয়ে দিয়ে গাইড যখন ওদের ব্যাপারে বলছিলেন তখন সত্যি বলতে কী, গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত আমাদের অনেকেরই চোখ ছলছল করছিল। যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) তার রম্যগ্রন্থ দৃষ্টিপাত-এর এক জায়গায় লিখেছেন, যুগে যুগে কিং এডওয়ার্ডরাই করেছে মিসেস সিম্পসনের জন্য রাজ্যবর্জন, প্রিন্সেস এলিজাবেথরা করেনি কোনো জনস্মিথ বা ম্যাকেঞ্জির জন্য সামান্যতম ত্যাগ। তার কথার খেই ধরে এস্থলে আমি বলতে চাই, যুগে যুগে মানব কল্যাণ ও অজানাকে জানার অদম্য স্পৃহায় বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন; আর বোধকরি এদের উদ্দেশ্যেই কবিগুরু লিখে গেছেনÑ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করেছে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’।

১৯৬৯ সালে নভোযান এপোলো-১১ বাহিত হয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী প্রথম আমেরিকান নভোচারী অধুনা প্রয়াত নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা দিয়ে যর্থাথই বলেছিলেন, ‘ওয়ান স্মল স্টেপ অব ম্যান ওয়ান জায়েন্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড- একজন মানুষের একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য একটি বিশাল লম্ফ’। আর নাসার বিশালকায় ভবনের অভ্যন্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ এপোলো-১৭ অভিযাত্রার কমান্ডার ইউজিন সারনেনের একটি উল্লেখযোগ্য উক্তি পাঠ করেও আমি আমার নোটবুকে টুকে নিয়ে এসেছিলাম: উই লিভ এজ উই কেইস অ্যান্ড, গড উইলিং উই শ্যাল রিটার্ন উইথ পিস অ্যান্ড হোপ ফর অল ম্যানকাইন্ড।

সে যাই হোক। সুধী পাঠক! হিউস্টনে না গেলে আমার তিনটি জিনিস জানাই হতো না : (ক) নাসার সদর দফতর ওয়াশিংটন ডি-সিতে, রকেট উৎক্ষেপণ করা হয় ফ্লোরিডার জন এফ কেনেডি স্পেইস সেন্টার থেকে আর উৎক্ষেপণের পরবর্তী মনিটরিং ও তৎপূর্ববর্তী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হিউস্টনের জনসন স্পেইস সেন্টার থেকে। (খ) মহাশূন্যে মাধ্যাকর্ষণহীন ওজনহীনতায় ভাসমান অবস্থায় নভোচারীরা কী কৌশলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেন; (গ) মহাশূন্যে নির্মাণাধীন আইএসএস তথা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র নির্মাণে আমেরিকা একা নয়, বিশ্বের আরও ১৪টি দেশ সম্পৃক্ত। আরও জানা হতো না নিম্নোক্ত মজার তথ্যাদি : (১) আইএসএস সম্পূর্ণ নির্মিত হলে ওটার ওজন হবে ৩৩০টি মোটরগাড়ির ওজনের চাইতে ভারী এবং সেটা হবে লম্বায় ৩৫৬ ফুট অর্থাৎ একটি ফুটবল মাঠ কিংবা বোয়িং ৭৪৭ বিমানের সমান। (২) বারংবার ব্যবহারযোগ্য খেয়া-নভোযানগুলো আইএসএস নির্মাণার্থে নিয়মিত ‘মিস্ত্রি ও মালমসলা পারাপারে নিয়োজিত, যেমন করে আমরা গ্রামে পাকা বাড়ি বানাতে শহর থেকে মিস্ত্রি ও ইট-কাঠ-পাথর নিয়ে যাই। (৩) আইএসএস একদিনে যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেটা পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়া-আসার সমান এবং প্রতি দেড় ঘণ্টায় ওটা একবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে বিধায় ক্রুরা প্রতি দেড় ঘণ্টায় একবার সূর্যোদয় দেখতে পান। (৪) নভোযানকে রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণকালে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, তা দিয়ে নাকি একটি প্রমাণ সাইজের সুইমিং পুলের পানি মাত্র ৩ মিনিটে নিষ্কাশন করা যেতে পারে।

জেনে আরও খুশি লাগল যে হিউস্টনের নাসায় বেশকজন বাঙালি বিজ্ঞানী কর্মরত। তা ওখানে এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি কৌতুক করার জন্য তাকে যখন বললাম যে বাংলাদেশে আমরা ২০২০ সাল নাগাদ ১০০ জন অভিযাত্রীসংবলিত একটি অভিযান সূর্যে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছি, তখন তিনি ‘সর্বনাশ সূর্যের কাছে পৌঁছার অনেক আগেই ওরা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে’ বলে আর্তচিৎকার করতেই আমি বলেছিলাম, ‘আমরা তো দিনের বেলায় পাঠাচ্ছি না, পাঠাব রাতের বেলায়’। হা হা হা।  এবার আমি আমেরিকায় গিরিগুহা অবলোকনের বর্ণনায়Ñ পবিত্র কোরআন শরিফে মহান আল্লাহতায়ালা ‘আল কাহাফ’ নামক সূরায় সাতজন ধর্মপ্রাণ যুবকের একটি গিরিগুহায় ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে কাটানোর কেচ্ছা বর্ণনা করেছেন; ওদের সঙ্গে ‘কিৎমির’ নামের একটি কুকুরও ছিল। অনুরূপভাবে হাদিস গ্রন্থেও বিশ্বনবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত তিনজন যুবকের ঝড়ের কবলে পড়ে গুহায় আটকা পড়া ও পরে উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা বর্ণিত আছে। অতি সম্প্র্রতি থাইল্যান্ডের একটি গিরিগুহায় একটি কিশোর ফুটবল দলের ১২ জন সদস্য ও তাদের কোচ আটকে পড়া এবং অতঃপর এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে তাদের উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা টিভিতে ও পত্রিকার পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, আদিকাল থেকেই মানুষের জীবনে গিরিগুহার একটা ভূমিকা আছে। শীতের প্রকোপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর হিংস্র জন্তুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য আদিম যুগে মানুষ বসবাস করত গিরিগুহায়। প্রাচীন গ্রিসের উপাখ্যানে গ্রিকদের দেবতা জিয়ুস প্রমুখের বাসস্থানও ছিল গিরিগুহায়, আর রোমানদের বিশ্বাস ছিল এই যে গুহায় বাস করেন জিন, পরী ও দানবেরা। প্রাচীন পারস্যবাসী নাকি গিরিকন্দরে বাসরত আলোর দেবতাকে পূজা করতেন। এ ছাড়াও গুহাভ্যন্তরের অপার্থিব সৌন্দর্য আর বৈজ্ঞানিক বিস্ময় বিভিন্ন যুগে মানুষের মনকে আকর্ষণ করেছে। একদল মানুষই আছেন যাদের প্রধানতম শখ হচ্ছে গিরিগুহা আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ করা। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয়Ñ স্পেলাঙ্কার ও এতদসংক্রান্ত বিদ্যাটির নাম স্পেলিওলজি।

সে যাই হোক। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটে নাকি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে মোট ৮৫টি গিরিগুহা। তন্মধ্যে একা টেক্সাস স্টেটেই আছে ৫টি; যেগুলো বৃহদায়তন ও গভীর সেগুলোকে কেইভ না বলে বলা হয় কেভান। এগুলোতে প্রায় সারা বছরই দেশি-বিদেশি প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়ে থাকে। আমি সস্ত্রীক দুই দফায় দুটি কেভার্ন দেখেছিÑ একটি টেক্সাসে অবস্থিত ইনার স্পেইস কেভার্ন ও অপরটি ভার্জিনিয়া স্টেটে অবস্থিত। ল্যুর কেভার্ন। প্রথমে ইনার স্পেইস কেভার্নের ব্যাপারেই বলা যাক।

টেক্সাসের রাজধানী অস্টিনের অদূরে জর্জটাউন নামক স্থানে অবস্থিত গুহাটির বয়স নাকি ১০ কোটি বছর, যেটার প্রমাণস্বরূপ গুহার ভিতরে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণী; যেমন বাদুড়, সাপ, মাকড়সা, শামুক বৃশ্চিক ইত্যাদির হাড়গোড়। ভিতরটা ভারি সুন্দর। কোথাও বা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ চুনাপাথরের নল ছাদ থেকে ঝুলে আছে, যেগুলোকে বিজ্ঞানের ভাষায় স্টেলেকটাইট বলে, আবার কোথাওবা মেঝে থেকে ঊর্ধ্বমুখী দ-ায়মান অনুরূপ চুনাপাথরের নল, যেগুলোকে বলা হয় স্টেলেকমাইট। এ দুয়ের সম্মিলিত সৌন্দর্যই হচ্ছে গুহাভ্যন্তরের উপভোগের বিষয় এবং এগুলো দেখলে বিশ্বস্রষ্টার প্রতি মাথাটা আপনা আপনিই নত হয়ে আসে।

তা গুহার ভিতর থেকে বেরোনোর পথে আমি কৌতুক করে ইংরেজিতে বলছিলামÑ আমার বুড়িকে তাহলে সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসে ভালোই করেছি। পাশে দাঁড়িয়ে এক শ্বেতকায় আমেরিকান যুবক তার গার্লফ্রেন্ডকে সোহাগ করছিল। সে মুখ ফিরিয়ে সহাস্যে বলে ওঠল, আপনি আপনার স্ত্রীকে বুড়ি বলেছেন। আজ রাতে আপনাকে বিছানার পরিবর্তে সোফায় শুয়ে কাটাতে হতে পারে। কানাকে যেমন কানা বলা যাবে না, তেমনিভাবে আমেরিকায় বুড়িকে বুড়ি ও মুটকিকে মুটকি বলা যাবে নাÑ এটা আমি ক্ষণকালের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। আমাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালাম।

আর, ইনার স্পেইস কেভার্নে নিয়ে গিয়েছিল আত্মজ; তৃতীয় দফার সফরে ল্যুরে কেভার্নে নিয়ে গেল ওয়াশিংটনবাসী ভ্রাতুষ্পুত্র ও তার পরিবার। উপভোগ ও অভিজ্ঞতা প্রায় একই ধরনের; তবে আমি সবচাইতে পুলকিত বোধ করেছি কেভার্নটির পায়ে হাঁটা পথের শেষ প্রান্তে এসে। ওখানটায় বিরাজমান একটি অগভীর কূপ, যেটাকে বলা হয়ে আসছে উইশিং উয়েল বা ইচ্ছা পূরণের কূপ। দর্শনার্থীরা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণার্থে কূপটাতে প্রচুর ধাতব মুদ্রা ফেলেন এবং ওগুলো কুড়িয়ে এনে বৎসরান্তে কোনো না কোনো জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়, যেটার বাৎসরিক পরিমাণও দেখলাম পার্শ্ববর্তী একটি বোর্ডে প্রদত্ত আছে। নেহায়েত আমাদের জন্য আমরাও কিছু রেজকি পয়সা তথা সেন্ট কূপের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়ে চলে এলাম। একই ধরনের ইচ্ছা পূরণ কূপ বিলেতে অবস্থানকালে আমি ওখানকার বাথ শহরে অবলোকন করেছি। আর ফ্রান্সে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালেও দেখেছি যুবক-যুবতীরা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য আইফেল টাওয়ারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সিন নদীর তীরবর্তী লোহার রেলিংয়ে তালা ঝুলিয়ে চাবিটা নদীতে ফেলে দেয়। তো পাশ্চাত্যের তুলনায় আমরা প্রাচ্যের লোকেরা অধিকতর সহজ বিশ্বাসী। এত দেশে মাথার মন্দিরের অভাব নেই। আমার দেশের সরকার জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থে যদি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতেন তাহলে বোধকরি ভালোই হতো।

পরিশিষ্ট : বিদেশ ভ্রমণ সবদিক দিয়ে উত্তম। পবিত্র কোরআনের ‘আলকাবুৎ’ শীর্ষক সূরায় স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বলেছেন, (হে নবী) বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ কীভাবে তিনি (আল্লাহ) সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন (আয়াত-২০)।

                লেখক : রম্য সাহিত্যিক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর