শিরোনাম
সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

চাই নির্ভুল মুক্তিযোদ্ধা তালিকা

মাজহারুল ইসলাম

চাই নির্ভুল মুক্তিযোদ্ধা তালিকা

মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা ইতিমধ্যে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ তালিকায় যারা বাদ পড়েছেন তাদের মধ্যে ৭০ হাজার আপিল এখন বিবেচনাধীন। এ আপিলের ভিত্তিতে প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত তালিকা। সম্প্রতি রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলেছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। রাজাকারদের তালিকায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কেন এলো, কীভাবে এলো, তা জাতি জানতে চায়।

এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের অনেক স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ শাসন করছে দীর্ঘ একটানা ১১ বছর। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ছয় বছর ধরে মন্ত্রণালয়টি চালাচ্ছেন। তারপরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করতে না পারা চরম ব্যর্থতাও বটে।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মাত্র ৩০০ টাকা সম্মানী ভাতা দিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ভাতা কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করা হতো। আমি তখন কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা। তৎকালীন নীতিমালার সীমাবদ্ধতার কারণে সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য সম্মানীভাতা চালু করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা সব মুক্তিযোদ্ধার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। একই সঙ্গে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সৃষ্টি হয়েছিল ২০০১ সালে। মন্ত্রণালয়টি সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধন। ইতিহাসের ‘দ্বৈত শাসন’ ব্যবস্থার মতো মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীভাতা কার্যক্রমটি এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বে আছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। ভাতা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদফতর। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক সভাপতি। পাশাপাশি উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, জেলা পর্যায়ে উপপরিচালক সমাজসেবা অধিদফতর কমিটির সদস্য সচিব।

১৯৯৬ সালে যখন প্রথম ভাতা কার্যক্রম চালু করা হয় তখন মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী, ভারতীয় তালিকা, কর্নেল ওসমানীর প্রদত্ত সনদ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রদত্ত সনদ, লাল ও নীল মুক্তিবার্তা যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধার সত্যতা যাচাই করা হতো। পরবর্তীতে যখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সৃষ্টি হলো তখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের ক্ষমতা গ্রহণ করে। এখানেই সৃষ্টি হয় জটিলতা। কারণ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের এখনো পর্যন্ত মাঠপর্যায়ের জনবল নেই।

১৯৭১ সালে সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যেটা ছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। যার নেতৃত্ব দিয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নবায়নের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে জাতিকে প্রতারিত করছে, পক্ষান্তরে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে।

আমি ২০০৯ সালে কোনো এক জেলায় কর্মরত। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবের স্বাক্ষরে কিছু নতুন মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা আমার অফিসে জমা হলো। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিবের বাড়ি সেই জেলাতে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেলাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকেই তার আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। অথচ সেই সচিব ছিলেন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার হাত দিয়ে যখন অমুক্তিযোদ্ধা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সেজে যান তখন গোটা প্রক্রিয়াই  জাতির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিরোধ কীভাবে সম্ভব?

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রাজাকারের তালিকা প্রকাশের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেন ড্রাইভের মাধ্যমে রাজাকারদের তালিকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় জাতির সামনে পেশ করল। যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরও নাম দেখতে পেলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করলে যে কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। প্রশ্ন হলো এর দায়ভার কে বহন করবে? বাংলাদেশের মানুষ এখন আর বোকা নেই। নতুন প্রজন্ম মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক। তারা ইতিমধ্যেই স্লোগান দিতে শিখেছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবেই তুমি বাংলাদেশ’।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা দ্রুত প্রণয়ন করা দরকার। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্ম সালেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা জাতির সামনে পেশ করা হবে এমনটি প্রত্যাশিত। বর্তমান সরকারের কাছে আমার নিবেদন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলই বর্তমানে ক্ষমতায়। এই সরকারের হাত দিয়েই একদিকে যেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে তেমনিভাবে প্রকৃত রাজাকার এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করে জাতিকে দায় মুক্ত করতে হবে। যাদের জনবল নেই, তাদের দ্বারা আর যাই হোক এই মহৎ কাজটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম সরদার’ না সেজে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত প্রয়োজনীয় লোকবল সংগ্রহ করা। প্রয়োজনে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেওয়া।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর