মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রিয় নসু! যেখানেই থাকো ভালো থাকো

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

প্রিয় নসু! যেখানেই থাকো ভালো থাকো

মনটা খুব খারাপ। জন্ম-মৃত্যু নিয়েই জীবন। তবু মৃত্যুর মিছিলের যেন শেষ নেই। বয়স হয়েছে তাই প্রতিদিন যখন কর্মীদের না-ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা শুনি বড় বেশি ঝাঁকুনি লাগে। তেমনই এক মৃত্যু নওশের আলী নসুর। নসু নামে কেউ এ জগতে ছিল তা জানতাম না, যদি না ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হতেন, যদি না প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তাহলে নসুর সঙ্গে কোনো পরিচয় হতো না। পৃথিবীজোড়া মানুষ আর মানুষ। সাত-সাড়ে সাত শ কোটি মানুষ। কজনকেই বা আমরা জানি-চিনি, কজনের সঙ্গেই বা সময় কাটে। অনেক মানুষ আছে যারা কারও খবর রাখে না, ছোট হোক বড় হোক গুরুত্ব দেয় না। আমার আবার ছোটকাল থেকেই দোষ বলুন আর গুণ বলুন, শত্রু-মিত্র পরিচিত কাউকে ভুলতে পারি না। আজ বেশ কদিন পায়ে ব্যথা। আমার ছোট বোনজামাই ডা. জহির খুবই ভালো ডাক্তার। ওকে দেখাতেই গিয়েছিলাম। অর্থোপেডিক হাসপাতালে পরিচালকের ঘরে বসেছিলাম। নতুন পরিচালক, অভাবনীয় মানুষ। কত কথা বললেন। আমি কী বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, আমার থেকে শতগুণ! আমি কবে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র দিয়েছি, অস্ত্র দেওয়ার আগে কী বলেছি, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন। ফুলের তোড়া বা মালা পেয়ে আমি খুব একটা খুশি হই না। খুব সম্ভবত ’৭১-এর ২০ ডিসেম্বর থেকে আমি সচেতনভাবে মালা নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বাসাইলের এক জনসভায় যাওয়ার পথে লাঙ্গুলিয়া খালের পাড়ে ৮০-৯০ বছরের এক জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধা নানা রঙের ফুল দিয়ে গাঁথা ছোট্ট একটি মালা আমার গলে পরিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধার শুকিয়ে যাওয়া কাঠ-চেহারা দেখে আমার বুকে নাড়া দিয়েছিল। যে দেশের মানুষ খেতে পায় না, পরতে পারে না, মাথার ওপর আশ্রয় নেই তাদের নেতা সেজে মালা নেওয়ার কি অধিকার আছে আমার? সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো মালা নিইনি। অনেক জায়গায় বাধ্য হয়ে হাতে নিয়েছি। ফুলের তোড়াও ঠিক তেমনই, খুব একটা নিই না। আমার মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য একটা ফুলদস্তা দিয়ে যে আনন্দ সেই ফুলদস্তার টাকাটা যে কোনো দুঃখী মানুষকে দিলে তার চাইতে অনেক বেশি আনন্দ। হঠাৎই অধ্যাপক মো. আবদুল গনি মোল্লা তার ফুলের তোড়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি নাকি আমাকে তার ফুল নেওয়ার কথা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পেরেছিলেন। হতেও পারে। একজন মানুষ যদি ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির হয় তাহলে তাকে তো মেরে কেটে বের করে দেওয়া যায় না। বড় ভালো লেগেছে মানুষটাকে। পায়ের ব্যথার জন্য একজন স্পেশালিস্ট দেখছিলেন। তারপর প্রেসক্রিপশন করছিলেন। তখনই ফোন আসে। ডা. ফরিদ যতক্ষণ প্রেসক্রিপশন করেন ততক্ষণই ফোনে কথা বলেন। বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি। পরে জানলাম যার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি আমার খুবই প্রিয় অধ্যাপক আমজাদ। ফোনটা আমাকেও দিয়েছিলেন। আমজাদের সঙ্গে আমিও কথা বলেছি। বড় ভালো মানুষ। ডা. গাস্ট আর আমজাদদের জন্যই স্বাধীনতার পরপর এই পুঙ্গু হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল। শেরেবাংলানগরের এই হাসপাতাল সে সময় প্রতিষ্ঠা না হলে কত মানুষ যে অচল হয়ে যেত বলা যাবে না। কারও হাত কারও পা কারও অন্য কিছু হারিয়ে চিরকালের জন্য চলনহীন হয়ে পড়ত। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়িতেই ছিলাম সারা দিন। সাড়ে ৫টায় বেরিয়েছিলাম আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে। গেটে গিয়ে শুনি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসবেন। তাই চলে এসেছিলাম। গতকাল দুপুরে কেবিন ব্লকের ৪১২ নম্বর রুমে তাকে দেখলাম। দেখা-সাক্ষাতে বড় বেশি কড়াকড়ি। কিন্তু আমাকে খুবই যত্ন ও সম্মান দেখিয়েছে। লিফটে সুনামগঞ্জের এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে দেখা। ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। এখন ওবায়দুল কাদের বেশ ভালো আছেন। দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।

লেখা শুরু করেছিলাম পরম প্রিয় কর্মী নওশের আলী নসুকে নিয়ে। কেন যে এদিক-ওদিক গেলাম বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর না জীবনের নিরাপত্তা ছিল, না কোনো স্বস্তি ছিল। জামালপুর থেকে হেঁটে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে মহেন্দ্রগঞ্জের তন্তর সীমান্তে গিয়েছিলাম। গিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের প্রথম শহীদ বগুড়া জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল খালেক খসরু। সেই প্রতিরোধ সংগ্রামে ’৭৬-এর শুরুতে ঢাকার একদল কর্মী অংশ নিয়েছিল। সেখানে যেমন নারায়ণগঞ্জের নাসিম, মঞ্জু ছিল তেমনই নরসিংদীর পিন্টু, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, জগলুল পাশা- এমনি আরও অনেকেই ছিল। সেখানে নসুও ছিল। নসুর মতো নিষ্ঠাবান অনুগত কর্মী খুব কম দেখেছি। আমরা জঙ্গলে ছনের ঘর বানিয়ে থেকেছি। শীত নিবারণের জন্য তেমন কোনো শীতবস্ত্র ছিল না। চার-পাঁচ ফুট করে মাটি খুঁড়ে সেখানে খড় বিছিয়ে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাত কাটিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ভারতে গেছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা সবাই মাসোহারা পেয়েছে। ’৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধে যেমন কাদেরিয়া বাহিনীর কোনো মাসোহারা ছিল না, ঠিক তেমনি ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও কোনো মাসোহারা ছিল না। সারা মাসে ১০ টাকার চা-বিস্কিট খাবার সুযোগ পেত। কি দুর্ভাগ্য আমাদের! মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, এখন তালিকাভুক্তি করতে গিয়ে সে যে কি মাদারীর খেল বলে বোঝানোর উপায় নেই। আমি পড়েছি মাইনকার চিপায়। কাদেরিয়া বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ’৭৫-এর পর ছিল জাতীয় শত্রু। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ছিল, কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিল এমন কেউ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে পারেনি, সাহস করেনি। অনেকেই ভেবেছে কাদের সিদ্দিকী দেশে ফিরলে তিনিই তালিকা করে দেবেন। দেশে ফেরার পরপরই এলো বিএনপি সরকার। এরপর এলো আওয়ামী লীগ সরকার। অনেকেই মনে করেন নেত্রীর সঙ্গে বিরোধের কারণে এখন তাদের তালিকা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে খুবই ভালো ছিলেন। সেদিনও এক টিভি চ্যানেলে পাকিস্তান হানাদারদের ‘পাক বাহিনী’ বলায় এত ঘৃণা জেগেছে যা বলে বোঝাতে পারব না। এ রকম অবস্থায় যুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি, ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীরাও ঠিক তেমনি পায়নি। নসু তাদের মধ্যে একজন। কদিন আগে হঠাৎই ওকে ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়েছিল। এক রাত ছিল সেখানে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হবে কিন্তু তাকে ছাড়া হবে না। একসময় যে নসুর ঢাকা শহরে ছিল দুর্দান্ত প্রতাপ। সিলভার সেলিমের মতো লোকেরা তার কথায় উঠত-বসত। সেই নসুকে ল্যাবএইড থেকে ছাড়া হবে না। এক রাতেই মনে হয় ৫০-৬০ হাজার নেওয়া হয়েছে। আমরা বলা-কওয়ায় শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেয় এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নেওয়া হয়। মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। এর মধ্যে আবার একদিন বাবর রোডের বাড়িতে এসেছিল। সেটাই আমার সঙ্গে শেষ দেখা, শেষ কথা। সেই আগের মতো নিবেদিত, চনমনে ছিল। বিয়ে করেছিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের এক অধ্যাপকের মেয়েকে। ’৭৫-এ প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে ফিরে জেল-জুলুম সহ্য করে মুক্তির পর বিয়ে করেছিল। ওর স্ত্রী প্রিয়াকে বেশ কয়েকবার দেখেছি। আমাকে বাবা এবং আমার স্ত্রীকে মায়ের মতোই দেখে। ওদের ছেলে বাপন ফ্রান্স না ইতালিতে থাকে। বাবার অসুখের সময় এসেছিল। কদিন ছিল। কিন্তু শেষমেশ ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হওয়ায় নসুকে মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি করে। আমি ছিলাম টাঙ্গাইলে। তাই দেখতে যেতে পারিনি। পরদিন হঠাৎই শুনলাম নসু মারা গেছে। আসমান ভেঙে পড়েছিল মাথার ওপর। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে ফেরার পর এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। হঠাৎ জার্মানি থেকে লাবলুর ফোন। আমি বুঝতে পারিনি। বলল, ‘কাদের ভাই! নসু ছিল আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু। সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে চলে গেল। আর আমি ৪০ বছর ধরে অসুস্থ। এখনো বেঁচে রইলাম।’ সত্যিই যাওয়ার কোনো সিরিয়াল নেই। কে কখন যাবে কেউ বলতে পারে না।

এই যে আমরা আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। যে প্রতিরোধ গড়ে না তুললে আমার বোন শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরতে পারতেন না। সে সময় আওয়ামী লীগের আরও হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে নিহত হতেন। মনে হয় একবারও তারা এ কথাটা মনে করেন না। যদি মনে করতেন তাহলে অমন অবহেলা নিয়ে নসু কেন না-ফেরার দেশে যাবে? কেন তার ভালো চিকিৎসা হবে না? জানি একদিন না একদিন জাতির কাছে এসবের জবাব অবশ্যই দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু যখন ঘাতকের হাতে নিহত হন তখন মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে জরুরি অবস্থা চলছিল। আগস্টের ২৯-৩০ তারিখ গভীর রাতে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি বেঁচে আছ আমরা খুশি হয়েছি। তোমাদের সম্মান রক্ষা করে যা করা দরকার ভারত সরকার তাই করবে। আমি তাই করব।’ শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম। সেখানে শরিক হয়েছিল নসু। সেই নসু চলে গেল। ’৭৭ সালে শ্রী মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমাদের ওপর যে স্টিমরোলার চালিয়েছেন, প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য চান্দভূই আমাদের ক্যাম্প চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। খাবার সরবরাহ ছিল না, ছিল না ওষুধপথ্য, বাইরে যাওয়ার অনুমতি। এসব মোকাবিলা করতে প্রথমে আমরা খাবারের পরিমাণ এক দিনেরটা দুই দিনে করেছিলাম। এক সপ্তাহ পর এক দিনের খাবার চার দিনে ভাগ করেছিলাম। সারা সীমান্তে চলছিল মাইকিং, দল ত্যাগ করলে নিরাপদ জীবন। কেউ আমাদের ক্যাম্প থেকে চলে গেলে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কিছু করা হবে না। নানা রকম সুযোগ-সুবিধা। এসব মাইকিং শুনে নসুর এক প্রিয় বন্ধু ঢাকার লুকু পালিয়েছিল। পালিয়েছিল আরও দু-চার জন। যে কারণে পিন্টু, সাবেক ডিজি সামীম আফজালসহ আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়েছিল। একসময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হয় যাদের তারা জিয়া সরকারের হাতে তুলে দেবেন তাদের জীবনহানি হবে না। তখন মাত্র কয়েকজনের সঙ্গে আমাকে আসামের পানবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর নিয়ম ছিল হেডকোয়ার্টারে প্রতিদিন কী হচ্ছে সবকিছু নোট রাখা। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে আমি কী করছি তা প্রতি মুহূর্তে লিখে রাখা। অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, যেদিন ভারতীয় বাহিনী আমাকে চান্দভূই থেকে তুলে আনে সেদিন সেই মুহূর্তে নোট করার দায়িত্ব ছিল এই নসুর। আমি যে টিলায় থাকতাম সেখান থেকে কীভাবে হেডকোয়ার্টারে এলাম, হেডকোয়ার্টারের সবার কাছ থেকে কীভাবে কী বলে বিদায় নিলাম, সেদিন অস্ত্রাগারের সামনে পাহারায় ছিল গাইবান্ধার রফিক, সে কীভাবে শেষ সালাম দিয়েছিল। আমি গাড়িতে ওঠার পর সে খাতাটা আমার হাতে তুলে দেয়। আমি পানবাড়ি এসে নোটবইটি খুলে পড়ে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। নসুর হাতের লেখা ভালো ছিল না। কিন্তু লেখায় কোনো ভুল ছিল না। তার নোটবইয়ের শেষ কথা ছিল- ‘এইমাত্র সর্বাধিনায়ক ভারতীয় বাহিনীর একটা জিপে উঠে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ জানেন।’ লেখাটা পড়ে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু নসুর মৃত্যুর সংবাদে তেমন কাঁদিনি। দিন যত যাচ্ছে জীবনের অর্থ বোঝার চেষ্টা করছি। যে মায়া-মমতা, যে দরদ ছিল আমাদের মধ্যে, যে দেশপ্রেম আমাদের ঘিরে রাখত আলোড়িত করত সারা জীবন, আজ সেই দেশপ্রেম যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। নসুর মৃত্যুতে আমার প্রতি পলে পলে এমনটাই মনে হচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে ফ্রীডম পার্টি যেদিন ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়িতে আক্রমণ করেছিল সেদিন এই নসু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিরোধ করেছিল। সে আজ কত নীরবে না-ফেরার দেশে চলে গেল। কেউ তার খবরটি পর্যন্ত নিল না। পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, দোষেগুণে মানুষ। মহান প্রভু যেন নসুর সব অপরাধ ক্ষমা করেন, তাকে বেহেশতবাসী করেন।

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভোট পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের চাইতেও বড় বিস্ময়। ১৫-১৬ শতাংশ ভোটে উত্তর-দক্ষিণের মেয়র। আমরা আমাদের সততা-মানবতা হারিয়ে না ফেললে একে ভোট হিসেবে গ্রহণ করতাম না। তা যাই হোক, ভোটের আগে যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছেÑ নির্বাচনে মানুষের আস্থা নেই। প্রধানত এমন আস্থাহীন নির্বাচন কমিশন আমরা এর আগে কখনো দেখিনি। সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় সরকারেরও একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সরকারি সমর্থক, বিএনপি সমর্থক কিছু ভোটার কেন্দ্রে গেছে, জনগণ একজনও যায়নি। যে নির্বাচনী রায় বাস্তবায়ন করার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, সেই গণতন্ত্র, ভোটাধিকার আজ গুরুত্বহীন, প্রশ্নবিদ্ধ। এর চাইতে হতাশার আর কী হতে পারে? নির্বাচন-পরবর্তী বিএনপির হরতালÑ  সেও এক প্রহসন। মানুষ যে রাজনৈতিক দলের গোলাম নয়, এ থেকেই বোঝা যায়। লাগাতার হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে ৩০৮ দিন ঘরের বাইরে ছিলাম। বলেছিলাম, ‘বেগম খালেদা জিয়া, আপনি হরতাল-অবরোধ বন্ধ করুন, প্রত্যাহার করুন।’ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বিএনপি তাদের লাগাতার হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের সুযোগ পায়নি। আরেকটি কথা ধ্রুব সত্য, তা হলো বিএনপির প্রতি জনগণ অনেকটাই আস্থা হারিয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পর তাদের আট সদস্যের শপথ গ্রহণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এতে বিএনপি প্রচন্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই হরতালে তেমন সাড়া মেলেনি। রাজনীতিতে মানুষকে আশার কথা শোনাতে না পারলে সাধারণ মানুষ পিছিয়ে যায়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে মনে রাখতে হবে, দেশবাসী কোনো দলের প্রজা বা গোলাম নয়। একদিন না একদিন সাধারণ মানুষকে মর্যাদা দিতেই হবেÑ এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর