মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বিদায় চট্টলা

হোসেন আবদুল মান্নান

বিগত প্রায় আড়াই বছর আমি বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম পদে দায়িত্ব পালন করেছি। দেশের মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ গৌরবময় এ পদটিতে আসীন হয়ে প্রথমেই লক্ষ্য করেছি ১৮২৯ সালে পদটি সৃষ্টির পর সুদীর্ঘ ১৯০ বছরে অনার বোর্ডে আমার ক্রমাবস্থান ৯০তম। একইভাবে ইতোপূর্বে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকালে গভীর কৌতূহল নিয়ে হিসাব করে দেখেছিলাম ব্রিটিশ কোম্পানির শাসনকালে অর্থাৎ ১৭৭২ সাল থেকে আমার ক্রমমান দাঁড়ায় ১৮৩তম। আর একই ব্যক্তির এ দুটো পদে কাজ করার সুযোগ হয় আমার আগে মাত্র তিনজনের। এর দুজন তদানীন্তন সিএসপি কর্মকর্তা। একজন বাংলাদেশ প্রজন্মের। আমিও স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের একজন সিভিল সার্ভেন্ট। আমাকে এমন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালি জাতির রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা অসাধারণ মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি এবং আমার পরিবারের ঋণ অপরিসীম।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমি চট্টগ্রামে দুবার যথাক্রমে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং কমিশনার, চট্টগ্রাম বিভাগ হিসেবে প্রজাতন্ত্রের সরকারি দায়িত্ব পালন করি। আমার ওপর অর্পিত সব দাফতরিক কর্তব্য ও কর্মসম্পাদনায় সততা-সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমবোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনা করেছি। সব সময় চেষ্টা করেছি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সম্পূর্ণ বিবেকতাড়িত হয়ে কাজ করতে। মনের গহিনে সর্বদা লালন ও ধারণ করেছি আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা, এই জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি এবং বাংলার আবহমান প্রকৃতিকে। কতটুকু পেরেছি তা সময়ই নৈর্ব্যক্তিকভাবে রায় দেবে। তথাপি আমি নিজে খানিকটা আত্মপ্রত্যয়ী যে, অনাগতকালের মাঠ প্রশাসন আমাকে পুরো বঞ্চিত করবে না। একদিন আমিও হয়তো ক্ষুদ্রতম বালিকণার সমান স্থান নিয়ে মহাকালের রথে চড়ার সামান্য সুযোগ পেয়ে যেতে পারি।

এ পর্বের আড়াই বছরে চট্টগ্রামের সমুদ্র-পাহাড়-পর্বত ঘেরা অপরূপ নিসর্গের মায়াবী ছায়ায় আমি নিজেকে প্রতিমুহূর্তে সংযত, সংশোধিত, পরিশীলিত ও ঋদ্ধ করার প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছি। সুযোগ পেলেই সময়ের লাগাম টেনে ধরে মাতৃভাষা ও আমার প্রিয় বর্ণমালার সঙ্গে নিরন্তর খেলা করে রচনা করেছি নানা ভাবনার মালা। এই সময়ে আমার একান্ত কিছু পাঠকও সৃষ্টি হয়েছে দেশে এবং দেশের বাইরে। তাদের নানা ব্যঞ্জনাময় বিশেষণমিশ্রিত অভিধা উৎসাহ ও প্রেরণা আমাকে বিশ্রাম থেকে বিরত রেখেছে বারবার। এমন সাময়িক ক্লান্তি ও নিঃসঙ্গতা যেন আমার কাছে বেদনার নয় বরং পরমানন্দের আরাধ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস

জানি, কালসিন্ধু তারে

নিয়ত তরঙ্গাঘাতে,

দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি।

আমি অকৃতি-অধম এক, এমন কোন ধৃষ্টতা প্রদর্শনপূর্বক বলতে পারি না যে, আমার অতিসাধারণ কিছু সৃষ্টি ভবিষ্যৎ পরম্পরায় বেঁচে থাকবে।

এ কথা সত্য, আড়াই বছর নানাবিধ কর্মযজ্ঞের ভিতর দিয়ে পেরিয়ে গেছে। এ সময় মানুষের ক্রমাগত সমর্থন ও ভালোবাসায় প্রতিনিয়তই যেন সিক্ত হয়েছি। এ বিভাগের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে অনেক মূল্য পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি, মর্যাদা পেয়েছি যা সম্পূর্ণ হয়তো আমার প্রাপ্য নয়। জেলা, উপজেলা বা পল্লীর নানা স্থানে নানা পরিবেশে ভাষণ-প্রভাষণ শেষে শ্রোতাদের প্রশংসাসূচক মন্তব্যও আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে অনেক বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলাগুলোর বান্দরবানের নীলগিরি-থানচি থেকে খাগড়াছড়ির সাজেক ও রাঙামাটির কাপ্তাই লেক আর দিগন্তছোঁয়া সবুজ নিসর্গ আমাকে অবলীলায় বলতে শিখিয়েছে, আঃ, এই তো আমার শতজনমের ভালোবাসার বাংলাদেশ। এই সময়ে এমডিজির অর্জন, দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ এবং মহাশূন্যে স্থান করে নেয় আমার মাতৃভূমি। মানবিক বাংলাদেশের বিনির্মাণ চলমান। এসব ইতিহাস উদ্যাপনকারী হওয়ারও সুযোগ পাই এই সময়ে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অপ্রত্যাশিত আগমন ও অবস্থান নিয়ে দেশে-বিদেশে দায়িত্ব পালন এবং অসংখ্য বিশ্বনেতার সংস্পর্শে এসে অনেক অজানাকে জানার প্রাণান্ত চেষ্টা করি। এ অম্লমধুর অভিজ্ঞতাগুলো স্মৃতির আয়নায় চিরকাল অমলিন থাকবে।

ভাবছি, আজ বীর চট্টলাকে বিদায় জানাতে হলে এ আমার মস্তবড় অপরাধ হবে। বরং এ পুণ্যভূমিকে বলতে চাই, লাখো-কোটি প্রাণ যারা অতীতে তোমার পবিত্র মাটিকে বিনম্র স্পর্শ করে ধন্য হয়েছে, তোমাকে আলিঙ্গন করে যারা জীবন্ত ও প্রাণময় ইতিহাস হয়ে উঠেছে, আমি কেবল তাদেরই দলে। তুমি আমাকে পুনর্বার আগমনের অনুমতি দিও। তুমি অবিনশ্বর, চিরসবুজ, চিরযৌবনা। পর্বতশৃঙ্গে বসে তুমি নিত্য মুচকি হেসে সাগরের তরঙ্গায়িত গর্জন শুনে যাচ্ছ অন্তহীন। জোয়ার-ভাটার মুগ্ধ খেলায় তুমি মত্ত অবিরাম। মহাকালকে তুমি বেঁধেছো আপন করোটিতে। তোমার কাছে বারবার ফিরে আসা ছাড়া জাতি হিসেবে আমাদের আর বিকল্প আছে কি? তোমার কাছে প্রকৃতই ঋণী হয়ে আছে বাঙালির আদি-ইতিহাস পর্বের বিচিত্র সব বিজয়গাথা। তোমার পরাভব, তোমার গ্লানি, তোমার বিষণœবদন এ জাতি কখনো অবলোকন করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী তোমাকে হরণ করে, তোমাকে আঘাত করে বা অবদমিত করেও বশে আনতে পারেনি আরব বেদুইন, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ-ডাচ্-ইংরেজ বেনিয়ারা। তুমি শির উঁচু করে তোমার সন্তানদের আগলে ধরে বরাভয় দান করেছ নিয়ত। তোমার ছায়ায় বেড়ে ওঠা এ জনপদকে বিধ্বস্ত, অশুভ, অশুচি করে কোনো দুর্বৃত্তই অস্তিত্ববান থাকতে পারেনি। জীবনযুদ্ধে, স্বাধীনতায়-ভাষায় সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে, প্রকৃতিপাঠে সবখানেই তোমার মহিমা, তোমার জয়গান। পেছনে তাকালে দেখি, কোথায় নেই তুমি- আমাদের বিপুল জলে তুমি, বিস্তীর্ণ স্থলে তুমি, সুনীল অন্তরিক্ষেও তুমি। তুমি যেন সর্বত্র বিরাজমান, সর্বদর্শী বীর চট্টলা। আমার অস্তিত্বের অনুভবে তোমার অদৃশ্য আলিঙ্গন আমাকে শিহরিত করবে, আমাকে উদ্বেলিত এবং স্মৃতিকাতর করবে অনন্তকাল। আজকের শেষ দিনাবসানে তোমাকে জানাই শত প্রণতি।

                কমিশনার বাংলো, চট্টগ্রাম, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর