শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য অমলিন বাঙালিত্ব আমার অহংকার

নূরে আলম সিদ্দিকী

ঐতিহ্য অমলিন বাঙালিত্ব আমার অহংকার

ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র- ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এবং নানাবিধ আচার অনুষ্ঠানের প্রত্যয়ী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ভারতবর্ষ। যে মননের যে মননশীলতার বৈচিত্র্য নিয়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, বোধ করি পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে এটি বিরল। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও মানসিকতার প্রচন্ড ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও কয়েক শ বছর ধরে ভারতবাসীর মধ্যে যে মননশীলতা গড়ে উঠেছে তার অদৃশ্য রাখীবন্ধন হলো গণতন্ত্র। অমলিন, অম্লান, নিষ্কলুষ ও নির্ভয় গণতান্ত্রিক চেতনায় ভারতবর্ষ উজ্জীবিত বলেই অবলীলাক্রমে এত বিভাজিত মানসিকতাকে একত্রে লালন করতে সক্ষম হয়েছে। বিস্ময়াভিভূত বিশ্বের কাছে সেটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও মননশীলতা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈনসহ মোটা দাগে প্রায় ২৬টি ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বসবাস ভারতে। এর মধ্যে হিন্দুধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আবার নানাবিধ স্তরবিন্যাস বা বিভাজন রয়েছে।। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- মূলত এই চার শ্রেণির জনগোষ্ঠী হলেও এর মধ্যে বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। এতদসত্ত্বেও তারা হিমাচলের মতো অটল, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তারা সূর্যস্নাত। দেশের প্রশ্নে, রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রশ্নে, নিজেদের ভারতীয় ভাবতেই তারা প্রত্যয়দৃঢ়। ধর্ম নিয়ে, বর্ণ ও গোত্র নিয়ে কখনো কখনো ছোটখাটো সংঘাত, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ যে হয় না তা নয়। তবে তা একান্তই ক্ষণস্থায়ী।

আপাতদৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হয় ভারতীয়দের ভাষা হয়তো হিন্দি, কিন্তু মূলত শতকরা ছয় ভাগ লোক হিন্দিতে কথা বলতে, লিখতে ও পড়তে পারে। প্রায় ৯০ ভাগের বেশি লোক হিন্দি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত নয়। শিক্ষিত ভারতীয়রা ক্ষেত্রবিশেষ ইংরেজিকেই ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। এখানে আমি যে কথাটা বলার চেষ্টা করছি, দীর্ঘদিনের ভারতীয় রাজনীতিতে তিলে তিলে যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা কেবল অনন্যসুন্দরই নয়, ভারতকে একটি অনবদ্য ঐক্যের দৃষ্টান্তে রূপান্তরিত করেছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান- এ উপমহাদেশকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার যে স্বপ্ন গান্ধীজির ছিল তা পূর্ণ হয়নি। প্রথমে ভারত ও পাকিস্তান এবং পরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৭ সালে মাউন্টব্যাটেনের হাত দিয়ে র‌্যাডক্লিফের পেন্সিলে এ উপমহাদেশের যে মানচিত্র অঙ্কিত হয়, তাতে বিস্তর গোঁজামিল রয়েছে, এটা বাস্তব। তিনটি দেশেরই সীমানা জলে-স্থলে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনটি দেশই অনড় ও প্রত্যয়দৃঢ়। ভারত ও পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত পাঞ্জাব ও সিন্ধু নিয়ে ৭০ বছর ধরে সহাবস্থান করছে নিবিঘ্নে।

বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষই বাঙালি। ভারতবর্ষের এ সুবিধা নেই। নানাবিধ ভাষা, সংস্কৃতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ভারতের মধ্যে বিদ্যমান। তবু মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী; এদিকে বাংলার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, শেরেবাংলা, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী- এরা সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ ভারতবর্ষেই জন্ম নেওয়া রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বগণ সমাজ সংস্কারক হিসেবে যুগান্তকারী ভূমিকা রেছেছেন। তবু বিস্ময়কর হলেও সত্য, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে ধরনের একাগ্রতা নিয়ে সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা তারা পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা বাদই দিলাম। তিনি রোহিণীকে পরপুরুষের প্রেমে অন্ধ হওয়ার কারণে গুলি করে মেরেছেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর কোনো নায়িকাকেই যেমন রাজলক্ষ্মী, গৃহদাহের অচলা, সাবিত্রী কাউকে কাউকে ঘর থেকে বের করে এনেছেন কিন্তু ঘর বাঁধার সুযোগ করে দিতে পারেননি। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র তার নায়িকাদের সমাজের রীতিনীতি ভাঙবার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েও তাদের দিয়ে কিছুই ভাঙতে পারেননি।

শরৎবাবুর গৃহদাহের অচলার শান্ত-স্নিগ্ধ স্বামী মহিম; অন্যদিকে খরস্রোতা নদীর মতো উথাল সুরেশের সঙ্গে ঘর ছাড়লেও ঘর বাঁধতে পারেননি। এক ঘরে দিনের পর দিন একাকী ও একান্তে বসবাস করার পরও শরৎবাবুর কোনো নায়ক নায়িকাকে দৈহিকভাবে মিলিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাদের আবেগাপ্লুত হৃদয়কে অতিসূক্ষ্মভাবে অবদমিত রেখেছেন। এখানে সংস্কার শরৎচন্দ্রকে অবমুক্ত বিমুক্ত হৃদয়ের প্রকাশ করতে দেয়নি। বাংলা সাহিত্যের এই দিকপালদের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, তিনিও সামাজিক সংস্কারের কাছে অবদমিত থেকেছেন। তার শেষের কবিতায় লাবণ্য কাছে থেকেও স্পর্শ তো দূরে থাক, যৌবনের স্বাভাবিক অধিকারকে অমিত গলা টিপে হত্যা করেছেন। অমিত ও লাবণ্যকে শেষের কবিতায় একটি বায়বীয় প্রেমের তাত্ত্বিক অভিনয় করতে রবীন্দ্রনাথ বাধ্য করেছেন। সংস্কার রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনাকে আড়ষ্ট রেখেছিল কিনা জানি না। তবে তার সৃষ্ট নায়ক-নায়িকার চরিত্রের আড়ষ্টতা, তাদের চালচলন, অনুভব-অনভূতির বহিঃপ্রকাশ জীবনের দাবিকে মানেনি, পাশ কাটিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। সে রবীন্দ্রনাথ বলুন আর শরৎবাবুই বলুন, আমি একজন অতিসামান্য পাঠক। তবে আজও বিস্ময়াভিভূত চিত্তে এই উদারমনের সাহিত্যিকদের সামাজিক সংস্কারের কাছে অবরুদ্ধ থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ তখনকার কোনো লেখককেই জীবনের স্বাভাবিক দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেয়নি।

সেই ভারতবর্ষকে- সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বোস, মোহাম্মদ আলী, শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল ইসলামের ভারতবর্ষকে খোলনলচেসহ পাল্টে দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদের কশাঘাতে জর্জরিত করার হিংস্র উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং তাদের চেলা-চামুন্ডারা ভারতবর্ষকে চরম হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ভারতবর্ষের নামকরণ হিন্দুস্থান করতে তারা প্রচন্ডভাবে উৎসাহী। এসব হিন্দুত্ববাদী নেতার মতামতের নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ হলো- যারা হিন্দুত্ববাদের সংস্কৃতি ও আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে এবং হিন্দুত্ববাদের আচার ও সংস্কৃতিকে যারা নির্দ্বিধায় বক্ষে লালন ও প্রকাশ্যে প্রতিপালন করতে পারবে, তাদেরই ভারতবর্ষে থাকার অধিকার থাকবে।

প্রায় ৭০ বছর ধরে ভারতের মাটিকে ভালোবেসে যেসব মুসলমান বংশানুক্রমে নিজেদের ধর্মীয় চেতনাকে আন্তরিক ও ঐকান্তিকভাবে প্রতিপালন করে ভারতবর্ষে বসবাস করেছেন, তাদের সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন- এ প্রশ্নে ১৯৪৭ সালেই সিদ্ধান্ত হয় গেছে। হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের বিভাজনের মধ্য দিয়ে। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা স্পষ্ট করেই বলেছেন, তারা ’৪৭ সালে পাকিস্তান চাননি। তাদের সাফ কথা- ভারতে থাকতে হলে হিন্দুধর্মের আচার অনুষ্ঠান অনেকটাই মেনে চলতে হবে। ইসলাম অনুশীলনে অন্য ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তবুু ভারতীয় মুসলমানরা ভারতের নাগরিক এবং ভারতের সংবিধান সুস্পষ্টভাবে সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ করে এবং সব ধর্মের অনুসারীদের স্ব স্ব ধর্ম প্রতিপালনের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের অঙ্গীকার ঘোষণা করে। মোদি এবারের নির্বাচনে বিজেপির সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় সংসদ সদস্য তার নেই। থাকলেও ভারতবর্ষকে হিন্দুস্থানে রূপান্তরিত করতে গেলে তারা পারতেন না। ভারত খ--বিখ- হয়ে যেত এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতকে ক্ষতবিক্ষত করত। মোদি-অমিত শাহের জন্য সাংগঠনিক পর্র্যায়ে এবং সংবিধানের অনুসরণে দেশ শাসন করাটাই শ্রেয়। এ ইস্যুতে ভারতবর্ষের রেফারেন্ডাম হলে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর ভরাডুবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধ ও সাধ্য থাকলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভারতবর্ষকে হিন্দুস্থান করা যাবে না, এটা অনুধাবন করে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে ভারতবর্ষব্যাপী যে তীব্র প্রতিবাদন্ড তাতে এ সত্যিই প্রমাণিত হয়। চীনের প্রাচীর ভাঙা যাবে, কিন্তু ভারতবর্ষকে হিন্দুস্থান করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সমুদ্রবক্ষে তিলে তিলে পলি জমে গড়ে ওঠা দ্বীপের মতো ভারতবর্ষের মননশীলতা গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্যসাধারণ পঙ্ক্তিতে বলেছেন-

‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ

বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ

তব শুভ নামে জাগে, তব আশিষ মাগে,

গাহে তব জয়গাথা।

জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা...’

মনন ও মানসিকতার কথা বাদ দিলেও মোদি ও অমিত শাহকে বিবেচনায় নিতে হবে ভারতে ৩০ কোটির ওপর মুসলমানের বসবাস। তাদের তাড়িয়ে দেবেন কোথায়? সামান্য ধর্মীয় অনুভূতির তাড়নায় যারা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে মোদিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আজ অনুতপ্ত। ভারতবর্ষব্যাপী একাংশ মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব আছে। সেটিকে নিংড়ে মুচড়ে নরেন্দ্র মোদি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন বিস্তীর্ণ নয়। আর তার বলেই মোদি-অমিত শাহকে তারা পিছু হটতে বাধ্য করেছে।

আমি গর্বিত এবং এটা আমার স্বতঃস্ফূর্ত প্রচ-। আমি বাঙালি এ গৌরবের অনুভূতি আমার চিত্তকে উদ্ভাসিত করে। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের জন্য শুরু করা লড়াইটা শুধু স্বাধীনতার যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্বর্ণসৈকতে আমাদের তরুণকে পৌঁছে দেয়। ফেব্রুয়ারি আমার বিশ্বাসকে তীক্ষè ক্ষুরধার করার মাস। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানে মাত্র তিন বছরের মাথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই সংগ্রাম শুরু হওয়া ও সফলতা অর্জন ছিল বিস্ময়কর। এর বিজয় শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বকে মুগ্ধ করে। বিশ্বমনন অভিভূত হয়ে বাঙালি জাতিকে গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেই জাতিসংঘে বাংলা দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতির অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করে। আমি যে কথাটি উল্লেখ করার জন্য এতখানি ভূমিকা প্রদান করলাম, সাত্ত্বিক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমরা অসাম্প্রদায়িক এবং অকুতোভয় বাঙালি। পৃথিবীর আর কোনো জাতি নেই যারা মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য রক্ত দিয়েছে। আবার বুকনিঃসৃত রক্তের চড়া মূল্যে বাংলা ভাষার অধিকার তো বটেই পরিশেষে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে। কিন্তু পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অনায়াসে হিন্দিসহ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা অনধিকার ও অনভিপ্রেত প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষায় বাংলার কোনো স্থান তো নেই-ই বরং পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় এক খিলি পান কিনতে চাইলেও হিন্দিতে চাইতে হয়। কি ট্যাক্সিওয়ালা, কি অভিজাত দোকানের বিক্রয়কর্মী সবাই হিন্দিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গর্ববোধ করেন কিনা জানি না। আমি নিজের কথা সততার সঙ্গে অনায়াসে বলতে পারি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কখনো হিন্দি বা উর্দু সিনেমা দেখিনি। ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনে কারও সঙ্গে উর্দু বা হিন্দিতে কথা বলিনি। সর্বক্ষণ সর্বাবস্থায় সর্বস্তরে বাংলায় কথোপকথন শুরু আমার সহজাত প্রবণতা ছিল না, আমার উদ্গত উদ্ধত হৃদয়ের প্রচ- গৌরবেরও বিষয় ছিল। আমি নিজে নিষ্ঠাবান মুসলমান, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কট্টর বাঙালিও। আমার চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতাই শুধু নয়, আমার রাজনীতিতে এমনকি নিবন্ধে প্রবন্ধে এ অনির্বাণ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত।

একটা কঠিন দেশপ্রেমের অনবদ্য বহিঃপ্রকাশ ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত দীর্ঘ পথপরিক্রমণ ও তার বিজয়। এই বাঙালির সংগ্রামী চেতনা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যে কোনো অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষে গর্জে উঠেছে। কিন্তু ব্যথিতচিত্তে অবলোকন করছি, সেই চেতনার কোথায় যেন অবলুপ্তি ঘটেছে। সেই প্রতিবাদমুখী সত্তাটি আজ মৃতপ্রায়। দৃপ্ত সংগ্রামী মননশীলতার মৃত্যু ঘটিয়ে যেন এক প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যাদের দৃষ্টি আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার দিকে। এই মানসিকতা হেমলক বিষের চাইতেও মারাত্মক। একটা জাতিকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। তাই পুনর্বার আমাদের আপন সত্তায় প্রজ্বলিত হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সামাজিক অনাচার, দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নিষ্কলুষ ও নির্ভীকচিত্তে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। অন্যায়, অবিচার ও প্রতিবাদের কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানের ২৩ বছরে সমস্ত অন্যায় ও অবিচারের আমরা প্রতিবাদ করছি। লাখ লাখ মানুষের মিছিলে মুষ্টিবদ্ধ উত্তোলিত হাত প্রত্যয়দৃঢ় স্লোগান দিয়েছে এবং তারই মাধ্যমে গড়ে ওঠা মানসিকতায় লালিত জনতার আত্মত্যাগের উদ্বেলিত সত্তার জন্ম হয়েছে। নিরস্ত্র জনতাকে এই সত্তায় বীভৎস পাশবিক হিংস্র পাকিস্তানি সৈন্যদের সশস্ত্র আক্রমণের শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কালের স্রোতধারায় সেটি মুক্তিযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহণ করে গোটা জাতিকে সাফল্যের স্বর্ণসৈকতে পৌঁছে দেয়। আর এ অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকে চেতনার প্রতীক ধরে যে বিস্তীর্ণ পথ পরিক্রমণ- তার একক নেতৃত্ব দিয়েছিল তখনকার ছাত্রলীগ। এই সংগ্রামী পথ পরিক্রমণের নীলনকশা তৈরি করে ছাত্রলীগ। যার ফলে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। যার সমগ্র প্রকাশ ছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর হয়ে যেটি তিনি বলতে পারতেন না, তাকেই বজ্রনিনাদে উচ্চারণ করার দায়িত্ব নিয়ে।

আজকে ছাত্রলীগের বিভাজন বিভক্তি অনৈতিক কার্যকলাপ এবং টেন্ডারবাজি ও আর্থিক প্রলোভনের দিকে রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি করতে দেখে সমস্ত হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এটা তারাই করে, যাদের কোনো অতীত নেই, কোনো ঐতিহ্য নেই কোনো গৌরবময় অর্জন নেই। কিন্তু ছাত্রলীগের সব আছে। সেদিন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য আর আজ তোমাদের লড়াই সেই স্বাধীনতাকে সুসংহত করার জন্য এবং তার জন্য প্রয়োজন তোমাদের নিষ্কলুষ চরিত্র বিনির্মাণ। জ্ঞানপিপাসু চিত্তে তোমরা নিজেদের ব্যাপৃত রাখবে জ্ঞানের সাধনায়। কারণ তোমরাই হবে আধুনিক বাংলাদেশের কারিগর। তোমাদের হাতেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো উন্নত দেশ। জীবন সায়াহ্নে এসে এর চাইতে আর কী প্রত্যাশা আমার থাকতে পারে।

 

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর