শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

কাশ্মীরি আপেলকুলে অসামান্য সাফল্য

শাইখ সিরাজ

কাশ্মীরি আপেলকুলে অসামান্য সাফল্য

গত বছর ফেব্রুয়ারিতেই ‘সফল সিরাজুল’ শিরোনামে আর্টিক্যালে লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার; যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মঠ মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ, যার বড় একটি অংশ পুরোপুরি বেকার। বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বেকারত্ব দূর করার কোনো বিকল্প নেই। যে করেই হোক বেকারত্ব দূর করতে হবে। বেকারত্বের অন্যতম কারণ আমাদের অধিকাংশ তরুণের উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস কম। সাহস করে পরিকল্পনামাফিক দৃঢ়চিত্তে উদ্যোগ নিতে পারলে সফলতা আসবেই। আর তারই প্রমাণ যশোরের চৌগাছার তরুণ সিরাজুল ইসলাম। বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। পড়াশোনা খুব একটা করা হয়নি, তাই নেই কোনো শিক্ষা সনদ। কিন্তু মাত্র চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে কাশ্মীরি আপেলকুল চাষ করে ১০ মাসে আয় করেছেন ৩৬ লাখ টাকা।’ সিরাজুলের কাশ্মীরি আপেলকুল নিয়ে প্রতিবেদনও প্রচার করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। এ প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার এক বছর পরই সিরাজুলের অনুপ্রেরণায় ফরিদপুরের আরেক তরুণ তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তার কৃষি উদ্যোগে। ফরিদপুরের হাটগোবিন্দপুর গ্রামের তরুণের নাম মফিজুর রহমান। আমি অবাক হয়ে যাই, তরুণ উদ্যোক্তাদের সফলতার চিত্র দেখে। আজকের দিনে কৃষিতে বাণিজ্যিক উদ্যোগের পেছনে সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হচ্ছে ‘সাহস’। তরুণ উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ সাহসিকতা নিয়ে কৃষিতে বিনিয়োগ করে অল্প দিনেই সফলতা দেখাতে পারছেন, এর পেছনের কারণ হলো সব বাণিজ্যের হিসাবই এখন সুষ্ঠু পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে। আমার ভালোলাগার জায়গাটি হচ্ছে, কয়েক বছর আগে একেকটি ছোট উদ্যোগ দেখে আশা করতাম, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, তরুণ উদ্যোক্তারা এসে কৃষি উৎপাদনে বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জে সাফল্যের সঙ্গে জয়লাভ করবেন। এই মফিজুর রহমানের খেতে এসে সে চিত্রই দেখছি।

সত্যিকার অর্থে মফিজুর রহমান যেন আমার কাছে আরেক রহিমুল্লাহ। কক্সবাজারের রহিমুল্লাহর কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে শুধু হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান দেখে কৃষিকাজ করে ভাগ্য গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। তারপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রচনা করেন নিজের সাফল্যের পথ। মফিজুর রহমানের গল্পটিও তেমন। ভাগ্য গড়ার অন্বেষণে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। অবশেষে স্বপ্নের নতুন পথ রচিত হয়েছে প্রবাসে বসে টেলিভিশনে দেশের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে। তার ভাষায়- সারা দিন কাজ করতেন, আর রাতে ইউটিউবে দেখতেন কৃষি প্রতিবেদন। স্বপ্ন বুনতেন দেশে ফিরে কৃষিতে ভাগ্য খুঁজবেন। সাত বছর বিদেশে থেকেও উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন ছিল না তার। সিদ্ধান্ত নিলেন দেশেই ফিরবেন। দেশে ফিরে ২২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করলেন মিশ্র ফলের চাষ। হৃদয়ে মাটি ও মানুষে দেখানো প্রতিবেদনগুলোর কৃষকের মাঠ তিনি ঘুরে দেখে এসে চাষ করলেন পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগন, পেঁপে। কিন্তু এসবের ফলন পেতে কমপক্ষে দুই বছর প্রয়োজন। এর মাঝে গত বছর সিরাজুলের কাশ্মীরি আপেলকুলের প্রতিবেদন দেখে আট বিঘায় শুরু করলেন কুলের চাষ। মফিজুর রহমান জীবনের অনেক পরীক্ষা শেষে এখানে এসে সবচেয়ে অল্প দিনে কৃতকার্য হয়েছেন বলা যায়। ১০ মাসে আট বিঘা জমিতে লাগানো ১ হাজার ৮৬০টি গাছের প্রতিটি ভরে উঠেছে আপেলের মতো লাল লাল কুলে। যেন গাছের পাতার চেয়ে ফল বেশি। ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে প্রতিটি ডাল।

সত্যিই বিস্ময়কর। স্বাদ ও মিষ্টতায় অসাধারণ অবিকল আপেলের মতো দেখতে এইকুল। মফিজুর যে হিসাব দিচ্ছেন, তা রীতিমতো কৃষি সাফল্যের এক নতুন গল্প। প্রতিটি গাছ থেকে কমপক্ষে ৫০ কেজি ফল পাবেন বলে আশা করছেন তিনি। সে হিসাবে ১ হাজার ৮৬০টি গাছ থেকে মিলবে প্রায় ৯০ হাজার কেজি কুল। বাগান থেকেই তিনি কুল বিক্রি করছেন ৭০ টাকা কেজি দরে। ফলে সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি এ ১০ মাসে কুল বিক্রি করেই পেতে যাচ্ছেন ৬৩ লাখ টাকা। আর খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আজকের কৃষি আর কোনোমতে বেঁচে থাকার উদ্যোগ নয়। আজকের কৃষির সঙ্গে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, বাজার সম্ভাবনা যাচাই, মুক্তবাজার ও বিশ্বায়ন সবই যুক্ত করার বিষয় রয়েছে। আজকের কৃষি মানেই বাণিজ্যিক এক চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়া। যা আগেকার ভাগ্যনির্ভর কৃষির সঙ্গে মেলে না। তাই মফিজুরের কৃষির স্বপ্ন ও উদ্যোগগুলো বাবা আক্কাস সর্দারের কাছে অন্যরকম। ছেলের হাতে কৃষির এমন পরিবর্তন বৃদ্ধ বয়সে তার চোখেমুখেও জে¦লে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা।

কাশ্মীরি আপেলকুলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনায় ইতিমধ্যে দৃষ্টি কেড়েছে দেশের বহু তরুণের। তারা অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য ঘুরছেন বাগানে বাগানে। এমন বেশ কয়েকজন উদ্যোগী যুবকের সঙ্গে এ বাগানে দেখা হলো। কথা হলো তাদের সঙ্গে। তারা জানালেন কৃষি নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা। দেশের কৃষিতে সৃষ্টি হওয়া জাগরণের এ দৃষ্টান্তগুলো আমার জন্য বড় এক অনুপ্রেরণা। আশার কথা, সারা দেশেই নতুন ও ব্যতিক্রমী কৃষি উদ্যোগের সঙ্গে শিক্ষিত তরুণরা যুক্ত হচ্ছেন। তাদের এ সংযুক্তির পেছনে রয়েছে নানামুখী উৎসাহ; যা তার মনোজগৎকে পাল্টে দিতে পারে। উসকে দিতে পারে ভিতরের সৃজনশীলতা।

যা হোক, বলছিলাম মফিজুরের কথা। কুলের পাশেই রয়েছে নয় বিঘার পেয়ারাবাগান। বছরে তিনবার ফল দেয়। এখানেও যথেষ্ট লাভের মুখ দেখেছেন মফিজুর। রয়েছে ড্রাগনের বাগান। ফল এখনো ধরেনি। তবে ড্রাগন নিয়ে তিনি আশাবাদী। বারোমাসি আম, বারি-১ আম, লেবু, কমলাও রোপণ করেছেন তিনি। সব মিলে ১০ বিঘা নিজের আর বাকি জমি লিজ নেওয়া। এ বছর এখন পর্যন্ত ১১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগের তুলনায় প্রাপ্তির আশা বেশ বড়। মফিজুরের এ সাহসী উদ্যোগ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এলাকাবাসীকেও; যাদের কাছেও এখন গতানুগতিক চাষব্যবস্থার বদলে নতুন ফল ফসলের চাষাবাদ হাতছানি দিচ্ছে।

কৃষক পর্যায়ে অর্থ, সময়, প্রযুক্তি সব বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের আবাদ করে অনেকেই সফল। তবে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মৌসুমি ফল চাষিদের অনেকের অভিযোগ, ভরা মৌসুম শুরুর আগেই এলসির মাধ্যমে ওই ফলই আমদানি করা হয়। ফলে অসম বাজার প্রতিযোগিতায় কৃষক বারবার পরাজিত হচ্ছে। তাই দেশীয় ফল-ফসল উৎপাদনের মৌসুমকে হিসাবে রেখে সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। কৃষক ও উদ্যোক্তার সাহসী উদ্যোগকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে বাজারকে আরও অনুকূল করা দরকার।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর