রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশকে মানসিকভাবে আঘাত করা হচ্ছে

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

বাংলাদেশকে মানসিকভাবে আঘাত করা হচ্ছে

ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নতুন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ)  নিয়ে আমাদের সরকারের কর্তারা বলছেন এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে সরকার তো পিঠ বাঁচাতে পারছে না। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু ভারত করবে না। বিষয়টি নিয়ে সংসদে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে, মন্ত্রিপরিষদে খোলামেলা আলোচনা দরকার। ইস্যুটি টেবিলের ওপর না এনে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হলে তা হবে আত্মঘাতী। ইস্যুটি নিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি না করে রাষ্ট্রের স্বার্থে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

ভারত দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যায় আক্রান্ত ছিল যা সমাধান করতে পারছিল না। ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদ দমন করতে বছরের পর বছর হিমশিম খাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দেন বাংলাদেশের মাটি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে ব্যবহার করতে দেবেন না। তিনি এটি করে ভারতকে ঋণী করেছেন, স্বস্তি দিয়েছেন। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে পর্যন্ত গ্রেফতার করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সুপ্রতিবেশীসুলভ রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নিয়ে ভারতের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের এ সদিচ্ছাকে মানসিকভাবে আঘাত হেনেছে ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটিতে ধর্মীয় বিভাজনের কালো ছায়া থাকায় উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত। ভারতের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মধ্যে নাগরিকত্বহীন হওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তার দলের নির্বাচনী ইশতেহার রূপায়ণের কথা বলেছেন। আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চালু করতে গিয়ে সেই ফাঁদে আটকে পড়েছেন প্রায় ১৯ লাখ মানুষ, যার মধ্যে ১২ লাখ মানুষ ধর্মাচরণে হিন্দু। এ বিশালসংখ্যক হিন্দুর ‘নাগরিকত্ব’ ফিরিয়ে দেওয়ার ‘মহান ব্রত’ নিয়ে অতঃপর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পাস করা হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এ আইন অনুযায়ী ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় হিংসার কারণে ভারতে আসতে বাধ্য হওয়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিস্টান হলে তিনি ‘অবৈধ অভিবাসী’ গণ্য না হয়ে ‘শরণার্থী’ বিবেচিত হবেন। শুধু তাই নয়, শরণার্থী হিসেবে মাত্র ছয় বছর ওই দেশে থাকার পরে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে।

আইন পাস হওয়া মাত্রই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন না। তারা আপাতত শরণার্থী হিসেবে ভারতে থাকার আইনি সুরক্ষাটুকু পাবেন। কিন্তু সে দেশের নাগরিক হতে গেলে তাদের দুটো শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, তাদের স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় হিংসার কারণে তারা ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন এবং তারা ভারতের নাগরিকত্ব চান। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা দেখা দেবে তা হলো, এ নতুন আইনের এক খোঁচায় তারা ‘নাগরিক’ থেকে ‘শরণার্থী’ হবেন। সে দেশে এত দিন বাস করার সুবাদে বাড়ি-গাড়ি, জমি-জমা, চাকরি-বাকরি, টাকা-পয়সা যা যা জমিয়েছিলেন তার সবটাই সরকার বাজেয়াপ্ত করবে।

দ্বিতীয়ত, তারা যে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণেই ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন তার প্রমাণও ‘আবেদন’-এর সঙ্গে দাখিল করতে হবে। কিন্তু কোনো হিন্দু যিনি হয়তো প্রকৃতই প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছেন তার পক্ষে আবার প্রতিবেশী দেশ থেকে সন্ত্রাসের প্রমাণ আনা এক প্রকার অসম্ভব। সর্বোপরি, এই গরিব প্রান্তিক মানুষগুলোর অন্য দেশে গিয়ে কাগজপত্র জোগাড় করার অর্থনৈতিক ক্ষমতাও নেই। ফলে এত দিন যে সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি কাগজের সাহায্যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু পাচ্ছিলেন এবারে তাদের ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। নিজভূমে পরবাসী হবেন তারা, প্রত্যেকে রাতারাতি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবেন।

সময়টা একেবারেই সুখের নয়। আগুন শেষ পর্যন্ত আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার দিন থেকেই আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে তার লেলিহান শিখা আমরা দেখেছি। দিল্লিসহ ভারতের অন্য অনেক রাজ্যেও পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। উন্মত্ত উত্তেজনার আঁচ থেকে বাদ নেই পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও ঘটছে অবাঞ্ছিত ঘটনা।

ভারতের বুদ্ধিজীবীরা অসিয়ত করছেন, অগ্নিতে ঘৃতাহুতি না দিয়ে দলমতনির্বিশেষে সবার উচিত হাতে হাত মিলিয়ে আগুনের শেষ ফুলকিটুকুও নিভিয়ে দেওয়া। যারা দেশের দশের নেতা বলে পরিচিত এখন তাদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। বুঝতে এবং বোঝাতে হবে, প্রতিবাদ মানে উন্মত্ত তা-ব নয়। অশান্তির আগুনে কেউ বাঁচে না। যারা তা বুঝবেন না, ইতিহাস ও মনুষ্যত্ব তাদের ক্ষমা করবে না।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে বিল পাস করানো, আর অগণিত সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করার মধ্যে যে কত ফারাক, অমিত শাহেরা তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। অন্যান্য রাজ্যের কথা না হয় বাদই দিলাম। আসাম, ত্রিপুরা তো অমিত শাহদের জবরদখলে। বিপুল জনসমর্থনে সেখানে বিজেপির সরকার চলছে। ধরে নেওয়া সংগত, সেখানকার অধিকাংশ মানুষ বিজেপির মত ও পথে আস্থাশীল। অথচ ক্ষোভের আগুন প্রথম জ্বলেছে ওই দুই রাজ্যে। উত্তর-পূর্বের এই ক্রোধের পেছনে আর্থ-সামাজিক কারণ খোঁজা হচ্ছে। বিজেপিকে যারা ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তারাই নিজেদের সমর্থনপুষ্ট দলের কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। নয়া আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তাই উন্মত্ত চেহারা নিয়েছে।

আসামের নাগরিকপঞ্জিতে নাম বাদ যাওয়া ১৯ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১২ লাখই যে হিন্দু তা দেখে অমিত শাহদের হিসাব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। তাই শারদীয় দুর্গাপুজোর আগে কলকাতায় সভা করতে এসে তিনি দলকে জানিয়ে যান, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু হওয়ার আগে নাগরিকপঞ্জি হবে না।

ভারতে সংবিধানের মর্মবাণীকে কার্যত নস্যাৎ করে এবং ধর্মীয় বিভাজনকে ঘুরপথে সিলমোহর দিয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল আইনে পরিণত করা হয়েছে। ফলে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার রাস্তাও অবারিত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে বসে অমিত শাহ ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছেন, গোটা দেশে এবার এনআরসি শুরু হবে। এনআরসি নিয়ে চাপের জায়গাটি ব্যাপক, যার পরিধি ও শঙ্কা দুই-ই অনেক বড়। প্রকৃতপক্ষে ভারতে বংশানুক্রমে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আপাতভাবে খুব একটা কাজে লাগার কথা নয়। কারণ বলা হয়েছে- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে সংখ্যালঘু অর্থাৎ অমুসলিমরা এ দেশে চলে এলে ‘শরণার্থী’ হিসেবে পাঁচ বছর থাকার পরে যাতে খুব সহজে নাগরিকত্ব পেতে পারেন সে লক্ষ্যে ওই আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হলো।

একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, কিছুদিন আগেও এ রকম আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল বড়জোর ৩২ হাজার। এখন হয়তো তা কিছুটা বাড়বে। তবে নাগরিকপঞ্জির হুমকি মাথায় নিয়ে ভারতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা মানুষদের অবস্থান আরও কঠিন। সেখানে হিন্দু-মুসলিম-জনজাতি কোনো ভেদ নেই। আর সেখানেই নয়া নাগরিকত্ব আইনের ভূমিকা যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

কেন, তা বুঝতে হবে। এনআরসির পরিণাম কত নিদারুণ হতে পারে, কীভাবে লাখ লাখ বাসিন্দার নাম নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, আসাম তার টাটকা প্রমাণ। রাষ্ট্র মনে করেছে, সেখানকার ১৯ লাখ বসবাসকারীর কাছে নিজেদের ভারতীয় হিসেবে ‘প্রমাণ’ করার মতো যথেষ্ট নথিপত্র নেই। নিজের দেশে বাপ-ঠাকুরদা-চৌদ্দ পুরুষের ‘অস্তিত্বের কাগজপত্র’ তারা দাখিল করতে পারেননি। তাই জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে তাদের নাম উঠল না! সোজা কথায়, যাদের নথিপত্র সরকারের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ বা ‘যথেষ্ট’ বলে মনে হবে না, তারা বংশপরম্পরায় এ দেশে বসবাসকারী হলেও পার পাবেন না। আসাম তা বুঝিয়ে দিয়েছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বক্তৃতা করতে উঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হঠাৎ সত্তর বছরের পুরনো, ১৯৫০ সালে সই হওয়া নেহরু-লিয়াকত চুক্তির কথা উল্লেখ করলেন। তার মতে, পাকিস্তান এ চুক্তিকে যথাযথ মান্যতা দেয়নি। সেখানে সংখ্যালঘুরা ক্রমাগত নিপীড়িত হয়ে এসেছে। তাই মহানুভব ভারত সরকার এত দিনে সেই নিপীড়িত হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈনদের নাগরিকত্ব দিতে উদ্যোগী হয়েছে এ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে। ভারতের এক কলামিস্ট লিখেছেন, ইতিহাসকে ইচ্ছামতো বিকৃত করে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মোদি সরকারের পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত। তিনি মনে করেন, তাই মাঝেমধ্যে ইতিহাস ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ভারতকে রাতারাতি হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ১৪ ডিসেম্বর বিক্ষোভ শুরু হয়েছে দিল্লির জামিয়া-মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদের মওলানা আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি মুম্বাইসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ অশান্ত সময়ে আমাদের ভরসা দিচ্ছে কবি শঙ্খ ঘোষের পঙ্ক্তি- ‘কিছুই কোথাও যদি নেই/তবু তো ক’জন আছে বাকি/আয় আরও হাতে হাত রেখে/আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।’

ভারতের নতুন আইনের চাপে সেখানকার নাগরিকহীনরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করলে তা মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে তো? আমাদের একমাত্র ভরসা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর