মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সিটির সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের তুলনা কাম্য নয়

মোশাররফ হোসেন মুসা

সিটির সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের তুলনা কাম্য নয়

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভা-সেমিনার ও টক-শোয় সিটি করপোরেশনের সীমাবদ্ধতা ও সীমিত ক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কেউ কেউ স্থানীয় সরকারের রুগ্নাবস্থা দেখে হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছেন, ঢাকা সিটি মেয়রের চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বেশি। তারা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন- ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অধীনে অন্তত গ্রাম আদালত ও গ্রামপুলিশ রয়েছে; কিন্তু সিটি মেয়রের হাতে ড্রেন পরিষ্কার ও মশা নিধন ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা নেই। এ রকম তুলনা করে মেয়রের অবস্থান খাটো না করে সমাধানের কথা বলাই হবে অধিক যুক্তিযুক্ত। বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশে একটি মাত্র সরকারব্যবস্থা রয়েছে, তা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। স্থানীয় সরকার নামে এ দেশে আলাদা কোনো সরকার নেই। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক বিভাগের একটি শাখা হিসেবে কাজ করে। অনেকে মনে করেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের হাতে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া আছে, তারা যদি সেটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে, তাহলে বহু কিছু করা সম্ভব। যেমন- ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক ও রাজশাহী সিটি মেয়র খায়রুজ্জমান লিটনের কাজ উদাহরণ হতে পারে। তাদের যদি প্রশ্ন করা যায় দুই মেয়র যদি বিরোধী দলের সদস্য হতেন তাহলে কি তারা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারতেন? এখানে উল্লেখ্য, ঢাকা দুই সিটির আয়তনের মধ্যে সাতটি মন্ত্রণালয় আর ৫৪টি সংস্থার কাজ রয়েছে। যেমন- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে ট্রাফিক পুলিশ যানবাহনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করে আর যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান করে বিআরটিএ। রমনা পার্ক তত্ত্বাবধান করে পূর্ত মন্ত্রণালয়। আবার জাতীয় ঈদগাহের সাজসজ্জার কাজ ধর্ম মন্ত্রণালয়, পূর্ত মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে সম্পন্ন করে। নগরীর প্রধান কতকগুলো সুবিধার মধ্যে আবাসন, পানি ও যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। অথচ এগুলো রাজউক, ওয়াসা ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হয়। সেদিক থেকে পৌরসভা অধিক ক্ষমতাশালী। বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদন ও পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা পৌরসভার হাতে ন্যস্ত রয়েছে। পৌরসভাগুলোকে সরাসরি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদগুলো বহু কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে  (যেমন উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইত্যাদি)। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের কোনো স্তরই স্বাধীন নয়। বলা হয়, একাধিক কর্তৃপক্ষ কোনো কর্তৃপক্ষ নয় এবং দূরবর্তী কর্তৃপক্ষও কোনো কর্তৃপক্ষ নয়। প্রয়োজন একক ও নিকটবর্তী কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকায় স্থানীয় সব কাজই জাতীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রতিনিধিদের যোগ্যতার মাপকাঠি এখন কাজ নয়, কোন দল করেন সেটাই বিবেচ্য বিষয়। অথচ কার্যকর স্থানীয় সরকার ছাড়া গণতন্ত্র অচল। জনগণ স্থানীয় কাজে অংশগ্রহণ করে নাগরিক বোধসম্পন্ন (সিভিক সেন্স) মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। ইউরোপিয়ান দেশসমূহে স্থানীয় সরকার থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে উঠেছে। সেখানে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা এখনো আগের মতোই রয়েছে। সেখানে কাজের পৃথক্করণ তত্ত্ব বহু আগে থেকেই চর্চায় রয়েছে। অর্থাৎ স্থানীয় কাজ স্থানীয় প্রতিনিধিদের জন্য এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট। তাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল তথা রাজনৈতিক মনোভাব সেভাবেই গড়ে উঠেছে। এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কয়েকজন এমপি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে কোপেনহেগেনের মেয়রকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তার নগরের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেন। অর্থাৎ সেখানে মেয়রের হাতে প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী জনৈক এমপি কয়েকদিন পর ঢাকায় এক সম্মেলনে বলেন, ঢাকার রাস্তাঘাট উন্নয়নের কাজ এমপিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা জেনেশুনেই কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার পক্ষে। এর বিপরীতে জনগণের মধ্যে স্থানীয় সরকারের জন্য একটি আকাক্সক্ষা দীর্ঘকাল আগে থেকেই বিরাজমান রয়েছে। বর্তমানে সিটির সমস্যা সমাধানের জন্য নগর সরকারের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু নগর সরকারের রূপরেখার কথা কেউ বলছে না। ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে- এ দেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় নিলে দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থাই সমাধানযোগ্য। তথা কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। সে ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হবে জেলা সরকার। জেলা সরকারের অধীনে ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার পরিচালিত হবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।

email : [email protected] 

সর্বশেষ খবর