বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

দাসসুলভ মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে

আবুসালেহ সেকেন্দার

দাসসুলভ মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে

শিক্ষকতার কয়েকটি স্তর আছে, এর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর বা ধাপ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। মর্যাদার দিক দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা সবার ওপরে। রাজনীতিবিদসহ সব পেশাজীবী এখনো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সম্মান করেন। দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা প্রচলিত অর্থের শিক্ষক নন। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের দুটি সত্তা রয়েছে- প্রথমত তারা গবেষক। দ্বিতীয়ত তারা শিক্ষক। অর্থাৎ তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক যিনি একই সঙ্গে গবেষক ও শিক্ষক। অন্য স্তরে যারা শিক্ষকতা করেন তাদের ওই গবেষণার সত্তা না থাকলেও চলে। কিন্তু গবেষণার সত্তা নেই এমন কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্থাৎ নতুন জ্ঞান আহরণ, উৎপাদন ও বিতরণ করা তার মূল কান্ডারি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। অর্থাৎ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নিযুক্ত আছেন কিন্তু নতুন জ্ঞান উৎপাদনে তার কোনো ভূমিকা নেই তিনি যতই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদ ধারণ করে বেতন-ভাতাদি নিন না কেন প্রকৃতপক্ষে তিনি কতটুকু বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করাই বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য স্তরের শিক্ষকদের পার্থক্য করে দেয়।

নতুন চিন্তা তখনই জ্ঞানের স্তরে পড়ে যখন ওই চিন্তা সর্বজনীন মানুষের কল্যাণের জন্য করা হয়। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর জন্য যে চিন্তা করা হয় তাকে মূলত মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা ভালো। বর্তমান বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চার চেয়ে ওই মতাদর্শের চর্চা বেশি হয়। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি দলে বিভক্ত শিক্ষকরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মতাদর্শের চর্চা করেন। তাই বিজ্ঞান, কৃষি বা প্রকৌশল শাখার অনেক শিক্ষকই তাদের নিজস্ব বিষয়ে গবেষণা বাদ দিয়ে নানা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির নিমিত্ত বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বা বই প্রকাশ করে ওই রাজনৈতিক দলের নেকনজর পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। অবশ্যই তিনি যদি তার স্ববিষয়ে গবেষণা করতেন তাহলে একদিক যেমন দেশের মানুষ উপকৃত হতেন, অন্যদিকে তিনি শুধু ওই রাজনৈতিক দলের কাছে নয়, সারা দেশের মানুষের কাছে অথবা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিতি লাভ করতেন। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের মধ্যেই এমন দূরদর্শী চিন্তার অভাব রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের রাজনৈতিক মত থাকতে পারে। অথবা তিনি যদি কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের সঙ্গে একমত পোষণ করেন অথবা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী হন তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক রাজনৈতিক দলের পান্ডা হতে পারেন না। রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের কাজ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক ও রাজনৈতিক দলের কর্মীকে পার্থক্য করা যায় না। চিন্তা, কথা, কর্মে তারা আজ এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছেন। সে কারণে সরকার সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা সরকারের সব কাজের প্রশংসা করেন। আর সরকারবিরোধী বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা সরকারের সব কাজের সমালোচনা করেন। কিন্তু একজন চিন্তক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের কাজ ছিল সরকার ও সরকারবিরোধী দলগুলোর ভালো কাজের প্রশংসা করা এবং মন্দ কাজের সমালোচনা করা। তারা সরকার ও বিরোধী উভয় দলের জন্য লাইট হাউস হিসেবে কাজ করতে পারতেন। তাতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা, ভুল-ত্রুটি উপলব্ধি করতে পারত। দেশ, জাতি ও সমাজ উপকৃত হতো।

অবশ্যই আমার অনেক সহকর্মী প্লেটোর দোহাই দিয়ে দাবি করবেন যে, যদি সৎ শিক্ষিত লোকেরা রাজনীতিতে যুক্ত না হয় তাহলে রাজনীতি মন্দ লোকের দখলে চলে যাবে। ভালো ও সৎ লোকদের ওই মন্দ লোকদের দ্বারা শাসিত হতে হবে। উপরোক্ত ওই বক্তব্যের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। কিন্তু উপরোক্ত বক্তব্য মোটেও একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা ও রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে কাজ করার স্বীকৃতি হতে পারে না। বরং কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক যদি উপলব্ধি করেন তিনি সৎ ও শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে তার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত, তাহলে তার উচিত হবে তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে কাজ করা। কিন্তু ‘হাফ শিক্ষক’ ও ‘হাফ রাজনীতিবিদ’ হয়ে এক হাত দিয়ে ঘরেরটা খাওয়া এবং অন্য হাত দিয়ে উঠানেরটা কুড়ানোর চিন্তা করা আর যাই হোক সৎ শিক্ষিত লোকের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক হবেন একজন রাজনৈতিক চিন্তক। রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সৃষ্টিপর্বে অধ্যাপক রাজ্জাক ছয় দফাসহ স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই বলে তিনি ছয় দফার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন না। অন্যদিকে তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদসহ অন্যদেরও ছয় দফাসহ স্বাধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু তারা কেউ অধ্যাপক রাজ্জাকের মতো চিন্তক ছিলেন না। তারা ছিলেন রাজনৈতিক দলের কর্মী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক অধ্যাপক রাজ্জাকের মতো চিন্তক হতে চান না। তারা রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন।

অবশ্যই বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক দলের কথিত পান্ডা শিক্ষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে দাসের মতো জীবনযাপন করেন। ফলে তাদের পক্ষে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষকই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শিক্ষক গ্রুপের সদস্য। ওই গ্রুপের বাইরে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেই তাকে নানাভাবে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হয়রানি করা হয়। ফলে বাধ্য হয়ে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করার সাহস দেখান না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক গ্রুপ আবার গোপন ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকরা কী ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করবেন, কীভাবে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তা ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে বলে দেওয়া হয়। ওর বাইরে একচুলও চিন্তা বা নতুন কিছু প্রকাশ করার অধিকার নেই। অনেকটা পুতুলনাচের পাপেটের মতো অবস্থা। আগেকার দাসব্যবস্থার সঙ্গেও একে তুলনা করা যায়। দাসরা শ্রম দিলেও যেমন তাদের মস্তিষ্ক বন্ধক ছিল দাসের মালিকের কাছে, বর্তমান বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের অবস্থা সেই রকম। তাদের মস্তিষ্ক তারা বন্ধক রেখেছেন বা রাখতে বাধ্য হয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক দলের পান্ডা শিক্ষকের কাছে। তাই সব দেখেশুনে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘দাস বিদ্যালয়’ মনে হয়।

পরিশেষে, উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে চাইলে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দাসব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের মধ্যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও মত প্রকাশের বোধ জাগ্রত করতে হবে। সেই জাগ্রত করার দায় সরকার বা রাজনৈতিক দলের যেমন রয়েছে, তেমন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের নিজেদেরও জাগতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা না জাগলে কেমনে সকাল হবে।

               

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

   [email protected]

 

সর্বশেষ খবর