গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। দিন যতই গড়াচ্ছে জমে উঠছে মেলা। মেলাজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বইপ্রেমীরা। বই ঘেঁটে দেখছেন। বই হাতে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। বইয়ের কারবারিরা বলছেন, বেচাকেনা ভালোই হচ্ছে এবারের মেলায়। বইমেলা আমাদের সর্বজনীন উৎসব। লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মিলনমেলা। একসময় বই-ই ছিল মানুষের বড় বন্ধু। অবসর সময়টা বই পড়ে কাটত। দীর্ঘ যাত্রায় বই ছিল সঙ্গী। নানা উপলক্ষে বই উপহার দেওয়া হতো। আমাদের ছোটকালে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বাইরের বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন। বাইরের বই বলতে ক্ল্যাসিক বা চিরায়ত সাহিত্য যা ‘গল্পের বই’ নামে বেশি পরিচিত ছিল। এখন আমাদের বই পড়ার সময় হয় না। টেলিভিশন আর স্মার্টফোন হয়ে উঠেছে আমাদের বিনোদনের উপকরণ। সর্বত্র স্মার্টফোনের দাপট। টিভির সিরিয়ালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকেন অনেকে। কাল্পনিক সব চরিত্র। অবাস্তব কাহিনি। তাতেই সই। পরিবারকেন্দ্রিক নাটকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস। একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। অষ্টপ্রহর ঝগড়া করছে। চরিত্রগুলো আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। কিন্তু তাতে কী! সময় তো কাটে। আমাদের আচার-আচরণে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা তা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ চলতেই পারে। আমরা ক্রমে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠছি। টিভি সিরিয়ালে ডুবে থাকা মা-বাবার পাশে বসে শিশু সন্তানরা কী শিখছে? অপরিণত বয়সে তাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে পারিবারিক নানা জটিল বিষয়। শিশুরা একে স্বাভাবিক বলেই শিখছে।
আজকের শিশুর শৈশব বলে কিছু নেই। পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতের সঙ্গে তার পরিচয় হচ্ছে না। এ পরিচয় থাকাটা জরুরি। তাহলে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ হবে তার। এই ডিজিটাল যুগে আঙ্গুলের স্পর্শেই তথ্যের ভা-ার উন্মুক্ত হয়ে যায়। ভালো-মন্দ সব কিছুতেই তার সহজ প্রবেশাধিকার। সুযোগ পেলেই ইন্টারনেটে গেম খেলছে শিশু-কিশোররা। শত্রু নিধন খেলা। এটাই শিখছে। কিশোর বয়সে নানা হিংস্র ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। তুচ্ছ ঘটনায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হচ্ছে। কয়েক বন্ধু মিলে বান্ধবীকে ধর্ষণের পর খুন করছে। ওদের দোষ দিয়ে কী হবে! নির্মল বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ওদের খেলার সাথী নেই। খেলার মাঠ নেই। সূর্যাস্ত নেই। মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ নেই। দেশ-বিদেশের রূপকথা শোনানোর কেউ নেই। পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার নেই। আছে শুধু পরীক্ষায় ভালো করার চাপ। দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। আমাদের সন্তানরা রক্তমাংসের মানুষ, রোবট নয়Ñ এ বোধটা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। জিপিএ-৫ শেষ কথা নয়। এটা বহুল চর্চিত বিষয়। কিন্তু এত চর্চার পরও পরিস্থিতি বদলায় না কেন? ‘বই কেনা মানে বই পড়া নয়’। অনেকে বই কিনে বুক শেলফে সাজিয়ে রাখেন। কিছু পাঠক আছেন যারা বইয়ের কিছুটা অংশ পড়ে রেখে দেন। আর হয়তো পড়ার সময়-সুযোগই হয় না। অধুনা আমাদের বই পড়ার অভ্যাসে ফাটল ধরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ই-বুকের বিক্রি কমেছে গত কয়েক বছরে। আমাদের বই পড়ার অভ্যাসটা হারিয়ে যাচ্ছে, এটা কোনো সুলক্ষণ নয়। বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণেই যুবসমাজ অপরাধজগতে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি এখন বই কেনেন না, আবার সংগ্রহে থাকার পরও বই পড়েন না। সবাইকে বই কেনা ও পড়ার আহ্বান জানান তিনি।
বইমেলার পরিধি ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। এবার ৫৬০টি প্রকাশনা সংস্থা মেলায় অংশ নিচ্ছে। মেলা উপলক্ষে প্রতি বছর ৪-৫ হাজার বই প্রকাশিত হয়। গত বছর প্রায় ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে মেলায়। বইয়ের প্রচ্ছদে নানা রঙের ছটা। ঝকঝকে ছাপা। সুন্দর বাঁধাই। শিশুদের জন্য ফোর কালার বা চাররঙা বই। কিন্তু মেলায় প্রকাশিত অধিকাংশ বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাজারো বইয়ের ভিড়ে পাঠক ভালো বই খুঁজে পাবেন কীভাবে? এর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। হাতে গোনা কয়েকটি নামজাদা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে সম্পাদনা পরিষদ আছে। বাদবাকি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো সম্পাদনা বা ফিল্টারিং ছাড়াই বই প্রকাশ করছে। এ নিয়ে প্রতি বছর অনেক কথা হয়। কিন্তু কাজ হয় না। বই ছাপানোর জন্য অধিকাংশ লেখক প্রকাশককে অগ্রিম অর্থ দেন এবং প্রকাশকের কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে নির্দিষ্ট -সংখ্যক বই কিনে নেন। এভাবে কি আর বইয়ের মান নিশ্চিত করা যায়? বইয়ের মূল্য সাধারণের সাধ্যের মধ্যে থাকা দরকার। বুক স্টোর থেকে অল্প পয়সা দিয়ে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পড়ে ফেরত দেওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বই-ই পারে মানুষকে সুস্থ জীবনের সন্ধান দিতে। শিশুরা গল্প শুনতে পছন্দ করে। বই পড়ে শোনাতে হবে শিশুদের। মনীষীদের জীবনী ও শিক্ষামূলক বই পড়তে হবে বেশি করে। জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য পড়তে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে মেধা ও মননে সমৃদ্ধ করতে বই পড়ার বিকল্প নেই। ফিরে আসুক আমাদের বই পড়ার অভ্যাস। বই হোক নির্মল আনন্দের উৎস।
লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।