রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি : অসার ট্রাম্পের বাজে তর্জন

তুষার কণা খোন্দকার

মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি : অসার ট্রাম্পের বাজে তর্জন

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সমস্যার শুরু। একটার পর একটা যুদ্ধ ইসরায়েলকে শক্তিশালী করেছে আর প্যালেস্টাইনিদের উপহার দিয়েছে মৃত্যু এবং উদ্বাস্তু হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। বিভিন্ন আরব দেশে বিশেষ করে লেবাননের উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর-জীবন যাপনকারী প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুরা ইতিমধ্যে তৃতীয় চতুর্থ প্রজন্মে প্রবেশ করেছে। এই শরণার্থী শিশুরা পৃথিবীতে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হিসেবে জন্মেছে। ইসরায়েলের চরম আগ্রাসনের শিকার হয়ে প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুদের অনেকে রাষ্ট্রহীন পরিচয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। প্যালেস্টাইনের আদিবাসিন্দার অনেকে জানে না আদিনিবাস থেকে কেন তাদের বিতাড়িত হতে হলো। প্যালেস্টাইনিদের আদিনিবাস কেমন করে কোন জাদুমন্ত্রবলে হঠাৎ ইহুদিদের একার রাষ্ট্র হয়ে গেল আর কেমন করেই বা আরবীয়দের বসতভিটা, ফসলি জমি সব ইহুদি মালিকানায় চলে গেল। আরবরা জানে, ইউরোপ ও আমেরিকা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলিদের সব অন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার শক্তি-সাহস, অর্থ-অস্ত্রের জোগান পেয়ে ইসরায়েলিরা আরবভূমিতে নির্বিচার গণহত্যা এবং মানুষকে বাস্তুহীন করার দুঃসাহস দেখিয়ে যাচ্ছে। প্যালেস্টাইনি ও আরব দুনিয়ার সাধারণ মানুষ কি জানে না আরব রাজ্যগুলোর শাসকরা পশ্চিমা দুনিয়ার পোষ্য বলেই ইসরায়েল এত অনাচার করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। অথবা আরবরা তাদের স্বৈরাচারী রাজা কিংবা শাসকদের স্বার্থপরতার অসহায় বলি। পশ্চিমা দুনিয়া মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে এক ধরনের ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে অবস্থান নেয়। পশ্চিমা দুনিয়ার হরেক শঠতার কথা ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে আমি পাঠকের সামনে অনেকবার পেশ করেছি। প্রায় এক শতাব্দী ধরে যুদ্ধংদেহী ইসরায়েলের হাত থেকে জানমাল রক্ষার জন্য প্যালেস্টাইনিরা যা করেছে সেগুলো নেহাত শিশুর খেলা। তারা জেরুজালেমের রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সৈন্যদের মারণাস্ত্রের গুলিতে প্রাণ দেওয়া ছাড়া কার্যকর কিছুই করতে পারেনি। ইসরায়েল দশকের পর দশক ধরে প্যালেস্টাইনি জনগণের ভূমি কেড়ে নিয়ে ইহুদি বসতি গড়ে তুলেছে। লাখ লাখ প্যালেস্টাইনি তাদের জীবন-জীবিকার অবলম্বন হারিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে উদ্বাস্তু হয়ে বেঁচে আছে। আরব দুনিয়ার একনায়ক শাসকরা প্যালেস্টাইনিদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় পশ্চিমা দুনিয়ার সুরে সুর মিলিয়ে শান্তি শান্তি বলে নাকিকান্না কাঁদা ছাড়া আদতে আজ পর্যন্ত কার্যকর কিছুই করেনি।

১৯৬৭ সালে মিসর-ইসরায়েল যুদ্ধের পর জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিল যে রেজুলেশন গ্রহণ করেছিল তা পরবর্তীকালে প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে সব শান্তি আলোচনার ভিত্তি বলে মেনে নেওয়া হয়। সেই রেজুলেশন অনুযায়ী পশ্চিমতীর ও গাজায় প্যালেস্টাইনের দাবি স্বীকৃত ছিল। কথা ছিল, প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে উভয় দেশের সীমানা নির্ধারণ করে নেবে। সেই সঙ্গে ইসরায়েল ইহুদি বসতি নির্মাণের নামে প্যালেস্টাইনিদের উচ্ছেদ করে যত ভূমি দখল করেছে সেগুলো তাদের ফেরত দিয়ে দেবে যাতে প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুরা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। পরবর্তী সময় ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলি সরকার ও প্যালেস্টাইনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর মধ্যে অসলো চুক্তি সই করা হয়েছিল। অসলো চুক্তি সই করার ঐতিহাসিক দিক হচ্ছে এই প্রথম ইসরায়েল পিএলওকে প্যালেস্টাইনি জনগণের প্রতিনিধি বলে অফিশিয়ালি মেনে নিল। একই সঙ্গে পিএলও ইসরায়েলকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছিল। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের করমর্দনের ছবি দেখে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভেবেছিলামÑ মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের হয়তো অবসান হলো। বাস্তবে দুনিয়াবাসীর শান্তির স্বপ্ন বাতাসে মিলিয়ে যেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ পক্ষ ১৯৯৫ সালে তাদের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছিল। আইজ্যাক রবিনের হত্যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনার কার্যত ইতি ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে তার ইহুদি জামাই ইয়ারেদ কুশনারকে বললেন তুমি মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বনে যাও এবং মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটা জুতসই সমাধান উপহার দাও। ফুলবাবু জামাই বাবাজি কুশনার একা মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার আওবাও বুঝে ওঠার সামর্থ্য রাখে না এই সত্য ট্রাম্প সাহেবও ভালো করে জানেন। কাজেই উনি বুদ্ধি করে তার একসময়ের উকিল জ্যাসন গ্রিনব্ল্যাটকে জামাইয়ের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে প্যালেস্টাইন-ইসরায়েলের শতাব্দীপ্রাচীন সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জামাই কুশনার ও উকিল জ্যাসন তিন বছর ধরে একটি শান্তিচুক্তির মুসাবিদা করেছেন। কুশনার ও জ্যাসন আদতে কোনো চুক্তির মুসাবিদা করেছেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তথাকথিত শান্তিচুক্তির দলিল উপস্থাপনার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হয়েছে অপগ- কুশনার ও উকিল জ্যাসন চুক্তি মুসাবিদার ভান করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আসল চুক্তির দলিল তেলআবিবে তৈরি হয়েছে এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু তা পকেট থেকে বের করে ট্রাম্পের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমরা জানি, শান্তিচুক্তি মানে চুক্তির পক্ষগুলো এক টেবিলে আলোচনায় বসবে। তাতে মধ্যস্থতাকারী উপস্থিত থাকবে। পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তারিত আলোচনা শেষে উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এরপর পক্ষসমূহ একযোগে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির সারমর্ম দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরবে।  ট্রাম্প সাহেবের শান্তিচুক্তির উপস্থাপনা ছিল টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো উপস্থপনার মতো যা একসময় ট্রাম্প সাহেবের পেশা ছিল। শান্তিচুক্তি প্রকাশ করার সময় হোয়াইট হাউসের বারান্দায় ট্রাম্পের পাশে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হোয়াইট হাউসের অনুষ্ঠানে ইসরায়েল পক্ষের উপস্থিতি থাকলেও প্যালেস্টাইন পক্ষের কেউ হোয়াইট হাউসের ধারেকাছেও ছিলেন না। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি ট্রাম্প সাহেব হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে পাশে দাঁড় করিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তার থলে থেকে শান্তি নামের কালো বিড়াল অবমুক্ত করলেন। ট্রাম্পের শান্তিচুক্তি কতখানি হাস্যকর তার প্রমাণ জানার জন্য আরব দুনিয়ায় যাওয়ার দরকার নেই। শান্তিচুক্তির নমুনা দেখে তার নিজ দেশের নেতৃস্থানীয় পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এডিটোরিয়াল বোর্ড তার মতামত কলামে বলেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করেছেন তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন। অর্থাৎ প্যালেস্টাইনিদের কাছে এ শান্তিচুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সে প্রশ্ন নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। শান্তিচুক্তির নমুনা দেখে তারা নিজেরা এ চুক্তির প্রস্তাবকে সিরিয়াসলি নিতে পারছে না সে কথাই শুরুতে তারা ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘ বলেছে, শান্তিচুক্তি একপেশে। এতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি ইহুদিরা তুষ্ট হবে কিন্তু আরব দুনিয়ায় শান্তি আসবে না।

শান্তিচুক্তিতে ট্রাম্পের ইহুদি জামাই বাবাজি প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের জন্য দারুণ একখানি মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। ওতে দেখা যাচ্ছে, ইহুদিদের জবরদখল করা তাবৎ ভূমি ইসরায়েলের দখলে থাকবে। ওতে জবরদখলকৃত জর্ডান ভ্যালিও ইসরায়েলে মৌরসি পাট্টা। পশ্চিমতীরের উত্তর-দক্ষিণ উভয় অঞ্চলে জবরদস্তি করে বসানো ইহুদি বসতিও ইসরায়েলের স্থায়ী সম্পত্তি। ট্রাম্প সুন্দর কথা দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের তাবৎ জবরদখলকে হালাল করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে প্যালেস্টাইনিদের বলছেন, এটি গ্রহণ কর তাহলে তোমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ট্রাম্প বলছেন, আমি আর আমার জামাই যে শান্তিচুক্তি প্রস্তাব করেছি তা ঐতিহাসিক এবং আগের সব প্রস্তাব থেকে আদ্যোপান্ত আলাদা। আমরাও বলি, সত্যি এটি ঐতিহাসিক কারণ প্যালেস্টাইনিদের সঙ্গে এত বাজে রসিকতা আগে আর কেউ করেনি। এ শান্তি প্রস্তাব অন্যদের থেকে আদ্যোপান্ত আলাদা কারণ প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রÑ এ সত্য ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনিরা মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শান্তি আলোচনার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে দুই রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করে একসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যাবে এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ছিল। জাতিসংঘের রেজুলেশন ও অসলো শান্তিচুক্তিতে স্বীকৃত দুই রাষ্ট্র প্রস্তাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যকে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার মরতবা দেখিয়েছেন। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে পাশে দাঁড় করিয়ে হোয়াইট হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিগি¦জয়ী ভঙ্গি করতে পারেন তবে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি না এলে দুনিয়াব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক-বেসামরিক বেশুমার স্থাপনা কোনো দিন শান্তিতে থিতু হতে পারবে না এ সত্য বোঝার মতো বুদ্ধি ট্রাম্পের আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। বড় কথা, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনায় কোনো ভূমিকা রাখতে অক্ষম এটি আমরা সবাই বুঝি। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আজগুবি শান্তি প্রস্তাব তৈরি করে ট্রাম্প রাজনীতির দুনিয়ায় নিজের গুরুত্ব বাড়াতে গিয়ে নিজেকে আরও খেলো করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, অসার শান্তিচুক্তির খসড়া তৈরি করে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সক্ষমতার শূন্য ঝুলি উদাম করে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিলেন যা মার্কিনিদের জন্য স্থায়ী ক্ষতি তৈরি করল। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সক্ষমতা কোন তলানিতে ঠেকলে কুশনার শান্তিপ্রস্তাব লিখতে বসে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে এখন তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

অসলো শান্তিচুক্তির মূল উদ্যোক্তা ইসরায়েলি রাজনীতিক ইয়োসি বেলিন নব্বই দশকে পর্দার আড়ালে থেকে দারুণ দক্ষতার সঙ্গে চিরশত্রু প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তির পথ খুলতে চেয়েছিলেন। ইসরায়েলি রাজনীতিক ইয়োসি বেলিন এখনো বেঁচে আছেন। ট্রাম্পের জামাই কুশনারের শান্তিচুক্তির নমুনা দেখে বেলিন হাসছেন নাকি কাঁদছেন কে জানে!

                লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর