শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুফতি এহসানুল হক জিলানী পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলামে দাওয়াত ও তাবলিগ তথা দীন প্রচারের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহারের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইসলামের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন ভাষা চর্চায় দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে ও বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-গুণী হতে হলে মাতৃভাষা সম্পর্কে ব্যাপক অনুশীলন করা উচিত। আল কোরআনের বাণী থেকে মাতৃভাষা চর্চার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ মানবজাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য ইসলাম প্রচার ও প্রসারে দুনিয়ায় অসংখ্য নবী-রসুল পাঠিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহর অমিয় বাণী মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে যেসব অঞ্চলে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন তাঁদের সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন এবং নবী-রসুলদের নিজস্ব মাতৃভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করে তাদের ভাষাকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর বাণী সহজ, সুন্দর, সাবলীল ও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সংশ্লিষ্ট জাতির ভাষাভাষী করে নবী-রসুলদের পাঠানো সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি প্রত্যেক রসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ সূরা ইবরাহিম, আয়াত ৪। প্রত্যেক জাতির ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ভাষাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমানভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। সব ভাষা আল্লাহর দান। আল্লাহর কাছে সব ভাষাই গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ সব ভাষাভাষী মানুষের কথা শোনেন ও বোঝেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, তা অন্য কোনো ভাষায় তত সহজে যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মুসা (আ)-এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু ভাষায়, হজরত ইসা (আ)-এর প্রতি ‘ইনজিল’ সুরিয়ানি ভাষায়, হজরত দাউদ (আ)-এর প্রতি ‘জবুর’ ইউনানি ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ‘আল-কোরআন’ আরবি ভাষায় নাজিল হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাঁর কাছে মানবজাতির দিশারি ও সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে সর্বশেষ আসমানি কিতাব ‘আল কোরআন’ অবতীর্ণ হয়। এ ঐশী গ্রন্থের ভাষা আরবি। বিশ্বনবীর মাতৃভাষায় কোরআন নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ ঘোষণা করছেন, ‘আমি কোরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দিয়ে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার।’ সূরা মারিয়াম, আয়াত ৯৭। ইসলামের দাওয়াত সফলভাবে পৌঁছাতে হলে মুবাল্লিগদের জন্য প্রতি জনপদের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় দীনের প্রচারকাজ চালানো দরকার। প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান না থাকলে সফলভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ নয়। তাই মানুষের কাছে তার মাতৃভাষায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো কোরআনে বর্ণিত হিকমাহ বা বুদ্ধিমত্তার অংশ। আল্লাহ কোরআনে হিকমাহ তথা বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম বাক্য দ্বারা দীনের প্রচারের আহ্বান জানিয়ে ইরশাদ করেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে হিকমত (বিজ্ঞানসম্মত) ও সদুপদেশ দ্বারা আহ্বান কর এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা কর।’ সূরা আন-নাহল, আয়াত ১২৫। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের ভাষা বোঝা ও তাদের কাছে নিজস্ব ভাষায় ইসলামের দাওয়াত প্রদানে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য জাতির মাতৃভাষা শেখার জন্য সাহাবায়ে কিরামকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সাহাবিদের মধ্যে অনেকেই আরবি ভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা যেমন পারস্য, মিসরীয়, রোমান ও আফ্রিকান ভাষা জানতেন এবং সে ভাষায় উত্তম বক্তৃতা পরিবেশনে পারদর্শী ছিলেন। পরবর্তী যুগেও  মুবাল্লিগরা পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করতে গিয়েছেন তাদের মাতৃভাষায় আল কোরআন অনুবাদ করে অনুসারীদের কোরআন-হাদিসের জ্ঞান দান করেছেন এবং ইসলামের বিধিবিধান ও নিয়মন্ডকানুন শিক্ষা দিয়েছেন। দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মাতৃভাষা চর্চার ওপর ইসলাম অত্যধিক গুরুত্বারোপ করায় ইসলাম প্রচারক মুবাল্লিগদের মননে মাতৃভাষা-প্রীতি ব্যাপকভাবে সঞ্চারিত হয়েছে নিঃসন্দেহে। মোট কথা, ইসলাম প্রচার-প্রসারের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মাতৃভাষার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। সে হিসেবে প্রত্যেক মুসলমান, বিশেষ করে আলেমন্ডওলামাদের কর্তব্য হলো মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হওয়া। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর