রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

এ অবক্ষয় ঠেকাতে হবে

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ

এ অবক্ষয় ঠেকাতে হবে

অপরাধপ্রবণরা এখন এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না। মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ও ঘটেছে ব্যাপকভাবে। সামান্য স্বার্থের কারণে অন্যকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। মানুষ কেন এত বেপরোয়া হয়ে উঠছে, কেনই-বা ঘটছে তার নৈতিক অবক্ষয়? প্রশ্নগুলোর সদুত্তর খোঁজা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্তুত ভোগবাদ এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে, অর্থের নেশায় অনেকেই বিবেকবর্জিত হয়ে পড়ছে। নীতিবহির্ভূতভাবে অর্থপ্রাপ্তিকে তারা তেমন কিছু মনে করছে না। গুম বা অপহরণের সঙ্গে যুক্তরা নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। অনৈতিক সম্পর্কের জেরে যারা শিশু হত্যা করছে, তারা যে মনোবৈকল্যে ভুগছে, তাতে আর সন্দেহ কি! প্রকৃতপক্ষে অর্থের নেশা, নৈতিকতার অবক্ষয়, মনোবৈকল্য ইত্যাদি সমাজে তৈরি করছে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি। এ থেকে পেতেই হবে উদ্ধার। ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ বলে দাবি তুলেছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক-রাজনীতিক নির্মল সেন। আজ সেই দাবিই বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এদিকে, পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের সিরিজ খবর। শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ কেউই বাদ যাচ্ছে না ধর্ষণের শিকার থেকে। কখনো কখনো মেরেও ফেলা হচ্ছে ধর্ষণের শিকারকে। কল্পনাতীত ধর্ষণ ও ধর্ষণপ্রবণতার বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে এখন বড় ধরনের সামাজিক গবেষণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কেন এতটা বেপরোয়াভাবে যৌনতাড়িত হয়ে পড়েছে, কেনই-বা ধর্ষণপ্রবণদের মধ্যে কাজ করছে না কোনো ধরনের ভয়ভীতি- তা এক বড় প্রশ্ন। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজে যখন শাসন-বারণের শৈথিল্য, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা নেতিবাচক দিক মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, বিচারহীনতা, খুন, ধর্ষণ, মান্যগণ্য-হীনতা দেখা দেয়। দুর্বৃত্তের আস্ফালন বৃদ্ধি ও সমাজকাঠামো ভেঙে পড়ে। সময়ের সঙ্গে জীবন-যাপন ও আচার-আচরণের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা সমাজের মূল ছকের মধ্যে থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আমাদের পরিবার ও সমাজের যে হাজার বছরের মূল্যবোধ, তা সারা বিশ্বেই প্রশংসিত, অনুকরণীয়। দুঃখের বিষয়, যতই দিন যাচ্ছে তা নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। ধর্ষণ, খুনের মতো নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বৃদ্ধি তারই ইঙ্গিতবহ।

এমনও দেখা যায়, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে, সমাজের সুকুমার বৃত্তিসম্পন্ন বিবেকবানদের নীরবতা ও ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। তারা তাদের নিজ দায়িত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন। এ ধরনের মানসিকতার কারণে অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে আরও দোর্দ- প্রতাপশালী হয়ে উঠছে। এদের প্রভাবের দ্বারাই অনেক সময় আইনের গতিপথ নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গুম, খুন, ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব। কারণ ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত, প্রায় সব ক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যোজাত জাতির ৪৮ বছরের অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হার কমানো ও দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।

মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপযুক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতিসহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবিলায় সক্ষমই শুধু হয়নি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৭ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথ ধারার বিপরীতে আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ঋণ পরিশোধে সক্ষমতার মানদন্ডে  ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের সমকক্ষতা অর্জিত হয়েছে। দেশের মানুষের কল্যাণে এখন সরকারের উচিত হবে অনুরাগ-বিরাগ তথা দলকানা মনোভাব বর্জন এবং ন্যায়ের চেতনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ আইনের শাসনের বিকল্পও আইনের শাসনই।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর