মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বিজেপি ও মমতার আঁতাত

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিজেপি ও মমতার আঁতাত

ভারতবর্ষের বিপন্ন গণতন্ত্রকে এনআরসি ও সিএএ নামে ভাঙতে দেওয়া হবে না। বিজেপি ও আরএসএসের এ উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য সারা দেশের যুবসমাজ ও ছাত্রছাত্রীরা এখন তৈরি। তিন দিনের কলকাতা সফরে এসে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় সভা করে এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করে গেছেন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ। ঐশী প্রতিটি সভায় বলে গেছেন, ‘আমি এই বাংলায় জন্মেছি, আমি মাতঙ্গিনী হাজরা ও ক্ষুদিরাম বোসের দেশাত্মবোধের ইতিহাস জানি।’ তার সভাগুলোর পেছনে কংগ্রেস ও বামপন্থি নেতারা পদযাত্রা করেছেন। মমতা সরকার তার সমস্ত কর্মসূচির পুলিশি অনুমতি দেয়নি কিন্তু এই ২৩ বছর বয়স্ক তেজস্বিনী ছাত্রী বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, জাত-পাতের নামে ভারতকে আর ভাগ করতে দেওয়া হবে না। বাঙালি বললে ভুল হবে ইনি আসলে ‘বাঙাল’। বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার গাভা গ্রামে তার পূর্বপুরুষের বাস। মেধাবী ছাত্রী মমতাকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনি আমার ঠাকুমা বা দিদিমার বয়সী। আপনি আমাকে সভা করতে বাধা দেওয়া একটি অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা, আপনি ক্ষমতার দম্ভে ছাত্র-রাজনীতি আটকাতে পারেন না। এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে।’ কলকাতার যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহ্য আছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে আরম্ভ করে ভারতের স্বদেশি আন্দোলনের বাঘা বাঘা নেতা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ঐশীর উষ্মা, তার সভা করার অনুমতি না দিয়ে মমতা আরএসএস ও বিজেপির হাত শক্ত করছেন। ‘গোটা দেশ থেকে আরএসএস ও বিজেপিকে হটানোই আমাদের প্রতিজ্ঞা, আর সে উদ্দেশ্যেই আমরা লড়াই করছি। এ লড়াই চলবে, যত দিন না দেশ থেকে বিজেপি ও আরএসএসকে তাড়াতে পারব।’ ২৩ বছরের এই একরত্তি মেয়ের সাহস, উদ্দীপনা দেখে সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজ আরও উজ্জীবিত হয়েছে।

ঐশী মমতা ও বিজেপির মধ্যে যে আঁতাত আছে তা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তার সভাগুলোয় বাধা দেওয়ার জন্য। দিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু করেছেন তা একই কায়দায় অমিত শাহ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ঐশী এবং বহু ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে মোদি সরকার দিল্লিতে একাধিক মামলা দায়ের করেছে। ছাত্র আন্দোলন করা ছাত্রদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নানা বিষয় নিয়ে আন্দোলন করেছে, করবে। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ঐশীর বক্তব্য ছিল এরূপ : ‘বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা ও তর্ক-বিতর্কের জায়গা। সেটা যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা হয়।’ ওই ছাত্রনেত্রী জানান, দেশের এই সময় পক্ষ বেছে নিতেই হবে। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পর্যুদস্ত করতেই হবে। গেটের বাইরে আয়োজিত সভায় ঐশী বলেন, ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের নামে দেশভাগ করার চেষ্টা চলছে। আগে কখনো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও আজহার উদ্দিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়নি। আজ তা হতে চলেছে। সময় এসেছে, বিজেপি, আরএসএসের চোখে চোখ রেখে বলতে হবে, তোমাদের রাজনীতি আমরা মানছি না, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে আর বাংলাকে ভাগ হতে দেব না।’

প্রসঙ্গত, দিল্লি থেকেই বার্তা নিয়ে নিজের রাজ্যে এসেছেন ঐশী। দেশের রাজধানীতে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে নিগৃহীত হয়েছেন তিনি। কিন্তু পড়–য়াদের অদম্য জেদের কাছে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে বেপরোয়া দুষ্কৃতর দল। এর আগে বিক্ষিপ্তভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সমাজের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মিছিল-মিটিং করেছেন, কিন্তু জেএনইউতে যেভাবে পড়–য়াদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আক্রমণ নেমে আসে তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তবে সে সবই ঠান্ডা মাথায় সামলেছেন ঐশী। তা দেখে তাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এর সঙ্গেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবসমাজ ফের কালাকানুন থেকে শুরু করে শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো মনোবল ফের ফিরে পেয়েছে মানুষ; যা একমাত্র একরত্তি মেয়ে ঐশীর জোরেই সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া শিবপুর আইআইইইএসটি থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত ঐশীকে নিয়ে বামপন্থি দলগুলোর ছাত্র সংগঠন একটি মহামিছিল করেছে। সেখানে পড়–য়াদের উদ্দেশে একইভাবে সম্মিলিত লড়াইয়ের ডাক দেন জেএনইউর ছাত্র সভানেত্রী। ঐশী বলেন, দিল্লিতে সিএএ, এনআরসি, এনপিআরের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত। নিজের রাজ্যের মানুষ যেভাবে আন্দোলন চালাচ্ছে তা দেখেও খুশি তিনি। শুধু দিল্লির একটা শাহিনবাগ নয়, এ রাজ্যের নয়া নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই যে তার এ রাজ্যে আসার প্রধান কারণ তাও জানালেন ঐশী ঘোষ। শুধু জেএনইউ বা জামিয়ার লড়াই এটা নয়, দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হয়ে উঠুক বলে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিজেপি এবং আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হয়েছে তা অনভিপ্রেত। এতে রাজ্য সরকার আরএসএসকেই সুযোগ দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন জেএনইউর সভানেত্রী ঐশী ঘোষ। রাজনৈতিক দলগুলোকে মতবিরোধ ভুলে আরএসএস এবং বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এখন নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে অন্য প্রোগ্রেসিভ দল লড়াই করতে চাইলেও কোথাও একটা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই সময় মতবিরোধ ভুলে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া দরকার। আর তা না হলে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মনবিবাদের সুযোগে আরএসএস ও বিজেপির আগ্রাসী শাসন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হবে না। সাধারণ মানুষ তা দূর অস্ত সংঘবদ্ধ লড়াই না করলে পরবর্তী সময় কোনো রাজনৈতিক দলকে মতপ্রকাশের সুযোগ দেবে না বিজেপি এবং আরএসএস। ভারতের বর্তমান রাজনীতির অবস্থা দেখে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন- বিজেপি ও আরএসএসের এই বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যে কাজ করেছে তিনটি প্রদেশের তিনটি আঞ্চলিক দলের তিন নেত্রী। প্রথমেই ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে বিজেপি জোটে শরিক হওয়ার সময় বহুদর্শী প্রবাদপ্রতিম জ্যোতি বসু মন্তব্য করেছিলেন- বিজেপি একটি বর্বর দল। মমতা এ দলকে পশ্চিমবঙ্গে টেনে আনার ফল হবে ভয়ঙ্কর। জ্যোতি বাবুর আশঙ্কা বাঙালিরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বিজেপির সঙ্গে তার আঁতাত সেই সময় থেকে। সেই সময়ই শুরু হয় সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান বিভেদ। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মমতার মদদে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এমনকি বাজপেয়ি সরকারের মন্ত্রী থাকার সময় মমতা বলেছিলেন, আরএসএস একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজনৈতিক দল। দিল্লিতে আরএসএসের একটি অফিস উদ্বোধন করতে গিয়ে মমতার এ উক্তি সারা দেশের সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের খুব একটা প্রভাব ছিল না। মমতার বদৌলতে তারা হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে আর সেই বিষবৃক্ষের ফল আজ পশ্চিমবঙ্গবাসীকে ভোগ করতে হচ্ছে। দ্বিতীয় জন হলেন উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজপার্টি দলের নেত্রী মায়াবতী। বিগত শতকের নয়ের দশক থেকেই কংগ্রেসকে হারানোর জন্য বিজেপির সঙ্গে দুবার জোট সরকার গঠন করেন তিনি। তবে ক্ষমতার বাড়াবাড়িতে সেই জোট বেশি দিন টেকেনি। মায়াবতী একজন দলিত নেত্রী তার উত্তর প্রদেশের বিজেপি হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী। রাম-ই তাদের আদর্শ, সেদিন বিজেপির মতোই মায়াবতীর গলার সুর ছিল ‘জয়শ্রীরাম’। মায়াবতীকে কিছুদিন একলাও চলতে দেখা যায়। ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি যে আকাশছোঁয়া দুর্নীতি করেছিলেন বিজেপি এখন সেসব দুর্নীতির জুজু দেখিয়ে তাকে দাবিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি মায়াবতী বিজেপির সমালোচনা শুরু করতেই তার ভাইয়ের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট সিবিআইকে দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে নগদ দেড়শ কোটি টাকা উদ্ধার করে। আর এরপরই মায়াবতী নীরব, এনআরসি, এনআরপি ও সিএএর বিরোধিতা করে ২২ মুসলমান মহিলাকে উত্তর প্রদেশ বিজেপি সরকার গুলি করে হত্যা করেছে। বিশিষ্ট লেখিকা ফারহা নাগমী একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছেন, অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। উত্তর প্রদেশের আরএসএসের যোগী আদিত্যনাথ এ অভিযোগের কোনো উত্তর এখনো দেননি, সুতরাং দেখা যাচ্ছে মায়াবতীর লোভ-লালসায় উত্তর প্রদেশের মতো ভারতের একটি বৃহৎ অঙ্গরাজ্যের বিপুল ক্ষতি হলো, আর এ জন্য যে মায়াবতী দায়ী সে কথা উল্লেখ করেছেন উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। অখিলেশের আরও অভিযোগ, ২০১৯-এ মায়াবতী বিজেপির সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেছিল যার সুফলটা পেয়েছে বিজেপি।

এবার ধরা যাক ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরের আর এক নেতার কথা। তিনি হলেন মুফতি মুহাম্মদ সাইদ। ক্ষমতা ও অর্থের লোভে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী হন। বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী, বিভেদকামী দলকে কাশ্মীরে টেনে নেওয়ার জন্য তিনিও মমতার মতো দায়ী, ২০১৬-১৭ সালে তিনি বিজেপির সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেন। তখন তাকে বারবার নিষেধ করেছিলেন কাশ্মীরি নেতা ড. করণ সিং, ড. ফারুক আবদুল্লাহ, ওমর আবদুল্লাহ, কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ ও সোনিয়া গান্ধী। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই হলো মুসলমান। সেদিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন আরও একজন কংগ্রেস নেতা মইফউদ্দিন মোরস। কারোর কথাই তিনি শোনেননি। তিনি শুধু শুনেছিলেন মোদি-অমিত শাহর কথা। ছয় মাসের মধ্যেই শুরু হয় ক্ষমতার ভাগাভাগি। আরএসএসের দাপটে ডাল লেক হয়ে যায় রক্তাক্ত। শেষ পর্যন্ত মোদি ও অমিত শাহর চালে সরকার ভেঙে দিয়ে প্রেসিডেন্টের শাসন চালু করা হয়। মোদি-অমিত শাহরা সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা ৩৫ (ক) ধারা অবলুপ্ত করে ক্ষমতা দিল্লির হাতে নিয়ে নেন। কাশ্মীরকে ভাগ করে দেওয়া হয় তিনটি রাজ্যে- জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ। দেখা যাক, তারপর কী হলো। মুফতির ক্ষমতার লোভের জন্যই ড. ফারুক আবদুল্লাহ, আর এক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও মুফতি নিজে জেলবন্দী হয়ে আছেন। সম্প্রতি বিনা বিচারে কোন আইনে তাদের আটক রাখা হয়েছে তা নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে একটি মামলা রুজু হয়েছে। জম্মু, কাশ্মীর কি ভারতের অঙ্গরাজ্য হবে নাকি আরএসএসের স্বর্গরাজ্য হবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।

            লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর