রবিবার, ১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ

নঈম নিজাম

করোনার চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ

ইউটিউব দেখছিলাম। হুইল চেয়ারে বসে আছেন, এন্ড্রু কিশোর। গাইছেন, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও, যা কিছু বলার যাও বলে যাও, পাবে না সময় আর হয়তো।’ আহারে! অসাধারণ এই শিল্পী ভালো নেই। শরীরে ভয়াবহ রোগ বাসা বেঁধেছে। অনেক দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন সিঙ্গাপুরে। দেশবাসীর প্রার্থনাকে সঙ্গে নিয়ে লড়ছেন কঠিন অসুখের সঙ্গে। এর মাঝে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যান কিছুক্ষণের জন্য একটি অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠানের আয়োজনও কিশোরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এ অনুষ্ঠানেই হুইল চেয়ারে বসে গাইলেন গানটির কিছু অংশ। ভিডিওটি দেখার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এন্ড্রু কিশোরের সুস্থতা কামনা করছি। আশা করছি, তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। সৃষ্টিশীল মানুষেরা চলে যান বড্ড আগে। হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়াও ছিল বড্ড তাড়াতাড়ি। বিদায়ের আগে শেষ মুহূর্তের একটি ভিডিও আছে হুমায়ূনেরও। ওয়াশিংটনের একটি বাড়িতে শাওন গাইছেন, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়রে জাদুধন... মরিলে কান্দিস না আমার দায়, সূরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়... যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়...।’ হুমায়ূনের দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। তিনি কাঁদছেন। এর কিছুদিন পরই চলে গেলেন হুমায়ূন। চলে যাওয়ার আগে কি সবাই টের পান? মৃত্যুর আগে জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে দেখতে গিয়েছিলাম মগবাজারের বাসায়। মুন্নী ভাবী অনেক রান্নাবান্না করলেন। টিংকু ভাই ও নুরুল ফজল বুলবুল ভাই ছাত্রজীবন থেকেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে দারুণ আয়েশি। বুলবুল ভাইদের টিকাটুলির বাড়িতে অনেক গেছি। তার মা ছিলেন অসাধারণ। আমাদের তুলে খাওয়াতেন। আর টিংকু ভাইয়ের আড্ডা ছিল অন্যরকম। আশির দশকে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের মিলনমেলা ছিল তার বাড়ি। টিংকুর ভাই আমাদের সঙ্গে জমিয়ে তোলেন। ভাবখানা এমন- আমরা রোগী না, আগের মতো আড্ডা দিতেই গেছি। আমাদের পেয়ে তিনিও ভুলে গেছেন শরীর খারাপের কথা। একবার বললেন চট্টগ্রামের রাউজান আওয়ামী লীগের কিছু সমস্যার কথা, তারপর বললেন দলের একজন নেতাকে তোমাদের কাছে পাঠাব। ভীষণ সমস্যায় আছে। পারলে একটু তুলে ধইরো। একসঙ্গে খেলাম। গল্প করলাম। সবাই ভাব ধরলাম সব ঠিক আছে। না, কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। আমরা জানতাম টিংকু ভাই কিছুদিন পর চলে যাবেন। তিনিও জানতেন। তার পরও কিছু সময়ের জন্য সব ভুলে থাকা। এ দুনিয়ায় আমরা দুই দিনের অতিথি। কিছুদিনের জন্য এসে চলে যাই।

মৃত্যুচিন্তা আমাদের সবার মাঝেই কাজ করে। কিন্তু আমরা কোনো কিছুই আমলে নিই না। বুঝতে চাই না দুনিয়ায় মানুষ একা আসে, একা চলে যায়। সঙ্গে কোনো কিছুই নিয়ে যায় না। তার পরও সমাজে চলছে অদ্ভুত একটা প্রতিযোগিতা। দীপ নিভে গেলে আর কোনো কিছুই থাকে না। সব শেষ হয়ে যায়। কেউ বুঝি না। বুঝতে চাইও না। মাঝে মাঝে ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। বেদনারা আঘাত করে হৃদয়ের গহিনে। মনে হয়, কোথায় ছিলাম, কোথায় যাচ্ছি। প্রতি এক শ বছর পর একবার মহামারীতে পড়ে বিশ্ব। প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। পৃথিবীর মানুষগুলোর অনেক কা-কীর্তিই প্রকৃতি একটা পর্যায়ে আর সহ্য করে না। তাই কখনো মহামারী, কখনো যুদ্ধ-বিগ্রহে দুনিয়া তছনছ হয়ে যায়। করোনা আতঙ্ক চলছে দুনিয়ার সবখানে। এ রোগের মেডিসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। আর করোনার মতোই ভয়াবহ সামাজিক অপরাধ ভর করেছে এখন বাংলাদেশে। প্রভাবশালীরা রাজনীতির নামে জড়িয়ে পড়ছে ক্যাসিনো, টেন্ডার-বাণিজ্য, মাদক, মানব পাচার, পতিতাবৃত্তির বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপরাধে। এক বন্ধু বললেন, আমাদের দেশে করোনা ছড়ালে কী হবে? বললাম, আরেকটা কেয়ামত নেমে আসবে। এমনিতে আমরা নীতিহীন এক সমাজের ভ্রষ্ট জীবনযাত্রার ভাইরাসে আক্রান্ত। এখন সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করছে। আর বাবা-মা হত্যা করছে সন্তানকে। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, দুই সন্তান আর স্ত্রীকে হত্যা করে এক লোক উধাও। আশুলিয়ায় সৎ মাকে খুন করল এক মেয়ে। স্বামীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এক মা দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হন। কয়েক বছর আগে স্ত্রী-সন্তানরা আত্মহননের আগে দেয়ালে লিখে গেছে এক বাবার অনৈতিক কা-কীর্তির কথা। ঐশীর হাতে বাবা-মা খুনের পর চমকে ওঠে এ সমাজ। বুয়েটের ঘটনার পর থমকে যায় গোটা সমাজ। আমরা কোথায় যাচ্ছি? ফেসবুকে ছবি দিতে সেলফি তুলতে গিয়ে মারা গেল দুই তরুণ। হামেশা এমন খবর প্রকাশ করি। প্রতারণা, বাটপাড়ি এখন ঘরে ঘরে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যা খুশি তা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের চেয়েও সামাজিক, রাজনৈতিক অপরাধের ভয়াবহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এ দেশে।

উত্তরণের পথ কি ভাবনাও কাজ করে। কিন্তু চারপাশের সব দেখে হতাশার কালো মেঘ ঘিরে ধরে আমাকেও। কী শিক্ষা দিচ্ছি আমাদের সন্তানদের? বুয়েটে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করলেন সহপাঠীরা। আসামিদের আদালতে তোলার ছবি দেখছি কিছুদিন আগে টিভিতে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই তরুণদের কী শিখিয়েছিলেন বাবা-মা? আর কী শিখিয়েছেন শিক্ষকরা? রাজনৈতিক ও সামাজিক এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শেষ করে দিচ্ছে সবকিছু। শিক্ষক, ছাত্র, পরিবার সবাই ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থলিপ্সা। রাজনীতি নামের ক্ষমতার সোনার হাঁস একবার পেলেই হলো। তারপর শুধুই ডিম পাড়বে। বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা, হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থবিত্তের লোভ-লালসায় কোথাও কোনো স্বাভাবিকতা নেই। অসুস্থতার সঙ্গে বসবাস। হিপোক্রেসি বাড়ছে। মানুষে মানুষে প্রতিহিংসা বাড়ছে। বড় বড় গাড়িতে চড়লেন, ব্র্যান্ডের কাপড় পরলেন, কিন্তু রক্ষা করতে পারলেন না নিজের সংসার, পরিবার, সন্তান। কী হবে এত প্রাচুর্য দিয়ে? সমাজে আপনি নিজেকে যতই জাহির করুন, আড়ালে মানুষ আপনাকে ঋণখেলাপি, ব্যাংক লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়ক হিসেবে গালি দেয়। সামনে কিছু মানুষের হয়তো সালাম পান। কিন্তু আড়ালের গালাগালির কথা একবারও কি ভাববেন না? কী জবাব দেবেন এ দুনিয়ায়? কী জবাব দেবেন আখেরাতে? রাজনীতির নামে এখন কেউ সাজেন পতিতার সর্দারনি, আবার কেউ কেন্দ্রে বসে দেন আশ্রয়-প্রশয়, মানুষ সবার আমলনামারই খোঁজ রাখে। লোভের একটা সীমা আছে। পাপিয়া পিউদের আশ্রয়দাতাদেরও বিচার হতে হবে। বড় বড় নেতা-নেত্রী সেজে টকশোয় যাবেন, লম্বা লম্বা কথা বলবেন, সমাজে দাপটের জাল বিস্তার করবেন। চলবে না বেশি দিন। লুৎফুজ্জামান বাবর, তার সময়ের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সবাই জেলে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। লাগামহীনদের উচিত সতর্ক হয়ে চলা। রাজনীতির নামে যা খুশি তা করা যাবে না। অন্যথায় এর কঠোর খেসারত দিতে হবে দুনিয়া ও আখেরাতে।

আমাকে একজন শুভাকাক্সক্ষী বললেন, আপনি এত কথা কেন বলেন? জবাবে তাকে শোনালাম জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ লাইনটি, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ কেউই চায় না। আমিও চাই না। তার পরও হৃদয় খুঁড়ে বেদনারা বেরিয়ে আসে। সত্যিকারে ভালোবাসা থাকলেই কষ্ট থাকে। এ ভালোবাসা দলের প্রতি, দেশের প্রতি, জীবন ও সংসারের প্রতি। ভালোবাসা মানে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার গোপন সাতকাহন নয়। ছোট্ট একটা জীবনে কত কিছুই জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনে। অনেক কিছুই প্রকাশ হয় না। থেকে যায় আড়ালে। তাই তো জীবনানন্দ দাশ আরও লিখেছেন, ‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে!’ মনের কষ্ট কতক্ষণ আটকে রাখা যায়? তাই নিজের অজান্তেই মানুষ অবলীলায় অনেক কিছু বলে দেয়। একজন ক্যাসিনোকান্ডের ব্রাদার্সের এত টাকা, আর পাপিয়ার পাপ নিয়ে সবখানে আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ গণমানুষের একটি রাজনৈতিক দল। এ দলটিকে ঘিরে সুবিধাবাদীরা ঘরবসতি গড়ে তুলেছে। নষ্টরা করছে অবৈধ বাণিজ্য। কিন্তু এই দিন সব সময় থাকবে না। এই নষ্টরা একদিন থাকবে না। আর ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের দায় একটি দল কেন নেবে? মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে উন্নয়ন আছে, আবার আইনের শাসনও আছে। রাজনীতির নামে যা খুশি তা করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে। বুঝতে হবে, হঠাৎ করে আজকের অবস্থানে আওয়ামী লীগ আসেনি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ দলটিকে এ অবস্থানে আসতে হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, দুঃসময়ের মানুষদের তিল তিল শ্রম, মেধা, ঘাম। যদিও এখন আর কেউ সেসব ইতিহাস মনে রাখেনি। অবশ্য ক্ষমতার রাজনীতিতে রাখার দরকারও নেই। এখন চারদিকে তাকালেই কলকাকলি পিউ পাপিয়াদের। ক্যাসিনো ভাইদের বাড়িতে টাকার গোডাউন। রাজনীতিকে সবাই ব্যবহার করছে অবৈধ টাকা উপার্জনের উৎস হিসেবে। সিনেমা, টিভির নায়ক-নায়িকারা এখন আর অভিনয় করেন না। তারা নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে পছন্দ করছেন। নেতারা সেলফি তুলছেন হেসে হেসে। এত হাসি দুঃসময়ের কর্মীদের জন্য কারও নেই। নাটক, সিনেমা লাটে উঠেছে। এই অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জিয়াউর রহমানের মাজারে যেতেন। তারেক রহমানের সঙ্গে ছবি তুলতেন। অনুষ্ঠানে যেতেন। এখন তারাও আওয়ামী লীগার! চিরদিন এমন যাবে না।

সমাজের সবখানেই কেন জানি একটা ঝামেলা চলছে। ইউটিউবে কিছু ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। আজকাল অনেকে ইনবক্স করে অনেক কিছু পাঠান। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি পাপিয়ার পাপের ভিডিও। ভয়ঙ্কর। আমাদের রাজনীতির নোংরামির শেষটা দেখতে হলো। আর ওয়াজের ভিডিও দেখে আরও হতাশ হলাম। একজনকে দেখলাম চিৎকার করছেনÑ ওরে বাটপাড়, ওরে বাটপাড়। বুঝলাম, আরেক মাওলানাকে তিনি গালাগাল করছেন। আরেকজনকে দেখলাম চিৎকার করে গান করছেন। অন্য একজন মুখে ফেনা তুলতে তুলতে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। ইউটিউবের ওয়াজগুলোয় নিজের বড়াই আর গালাগাল ছাড়া কিছুই নেই। আমার এক চাচা ছিলেন মাওলানা, আরেকজন মৌলভি। তারাও ওয়াজ করতেন একটা শালীনতা নিয়ে, সম্মান নিয়ে। ধর্মের বয়ান করতেন, আল্লাহ-রসুলের কথা বলতেন। কাউকে গালাগাল করতে দেখিনি। ওলি-আউলিয়ার দেশ বাংলাদেশ। এভাবে আলেমসমাজ একজন নিজেকে বড় করতে গিয়ে আরেকজনকে নিয়ে নোংরামি কেন করবেন? আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ছোটবেলা থেকে নিজেও ওয়াজ-মাহফিলে যাই। কয়েক শ ওয়াজে অতিথিও ছিলাম। বক্তব্য রেখেছি। নিজে শুনেছি। এখনো ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজকরা অতিথি করে আমন্ত্রণ জানান। সময়ের অভাবে যেতে পারি না। কিন্তু ধর্মীয় ওয়াজের এমন হাল জীবনেও দেখিনি। সময়টা বড্ড খারাপ সবখানে। ধর্ম-কর্ম সবকিছুতে বিবাদের আগুন। হিংসার আগুনে পড়ে সবাই সবার বারোটা বাজাচ্ছে। এ সংস্কৃতি দীর্ঘমেয়াদে সবার জন্যই ক্ষতিকর। দিল্লির সাম্প্রদায়িক আগুন দেখে একজন বললেন, প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন ধরলে তার ধোঁয়া আপনার ঘরও আচ্ছন্ন করবে। ধর্মের আগুন আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে বারবার। তবে বর্তমান বাস্তবতায় একটি কথাই বলছি, সহনশীল ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। এ দৃষ্টান্ত আগামীর দুনিয়াকে আরও আলোকিত করবে। নিশ্চিহ্ন করবে অন্ধকারকে। আমরা আলোর পথযাত্রী হয়ে থাকতে চাই। সবখানে দৃষ্টান্ত রাখতে চাই সহনশীলতার।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর