মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

শ্রুতিহীনতা বা শ্রুতিক্ষীণতা

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

শ্রুতিহীনতা বা শ্রুতিক্ষীণতা

মানবসভ্যতার ইতিহাস যখন শুরু তখনই বধিরতার জন্ম। বলা চলে, বধিরতা নতুন কিংবা অপরিচিত বিষয় নয়। কানের মাধ্যমে মানুষ অন্যের কথা শোনে, শব্দ শুনতে পায়। মানবদেহের এ অঙ্গ বেশ স্পর্শকাতর ও অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সুতরাং এ অঙ্গের বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি। ২০১৭ সালের WHA 70.13 সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রবণেন্দ্রিয়ের যত্ন নেওয়া ও শ্রুতিক্ষীণতা বা শ্রুতিহীনতাকে জনস্বাস্থ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত ঘোষণার আলোকে জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে ৩ মার্চ বিশ্ব শ্রুতি দিবস পালন ও যথারীতি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানায়। এবারের বিশ্ব শ্রুতি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- Hearing for life : don’t let hearing loss limit you. অর্থাৎ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যায়িত জীবনের জন্য শুনানি। শ্রুতিহীনতা বা শ্রতিক্ষীণতার জন্য জীবনের গতিকে থামতে দিও না, শ্রুতিহীনতা বা শ্রতিক্ষীণতাকে জয় করে এগিয়ে চল।

২০১৩ সালের থিম ছিল- Healthy Hearing, Happy LifeÑ Hearing Health Care for Ageing. যেখানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রতি সাহায্যের ও শ্রদ্ধার হাত বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল। ২০১৪ সালের স্লোগান ছিল- Ear care can avoid hearing loss. দুর্ভাগ্য হলেও সত্য- জনস্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে, আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার পর্যায়ে এখনো তা শুরু করতে পারিনি। যদি পারতাম তাহলে শ্রবণেন্দ্রিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, রাস্তাঘাটে, পার্কে, বাস বা রেলস্টেশনে একজন অশিক্ষিত লোকের হাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সঁপে দিতে পারতাম না। শিক্ষক ছাত্রের কানে, স্বামী স্ত্রীর কানে কখনো আঘাত করে মূল্যবান পর্দাটা ফাটিয়ে দিতেন না। অযথা কটন-বাড বা তুলা, শলা, কাঠি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করতাম না। ২০১৫ সালের থিম ছিল- শুনানিকে নিরাপদে রাখুন। এ সেøাগানের মাধ্যমে যুবসমাজের প্রতি বিশেষভাবে শব্দদূষণ থেকে দূরে থাকা ও শব্দদূষণ প্রতিহত করার নির্দেশনা ছিল। এমনকি শব্দদূষণ যে কত মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতি করতে পারে তা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমেই শিক্ষা দিতে হবে। ২০১৬ সালের থিম ছিল জন্মের পর থেকেই শিশুর শুনানি নিরূপণ ও প্রয়োজনীয়  তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এ প্রতিপাদ্য বিষয়টি কিন্তু আমাদের দেশের জন্য, আমাদের সবার জন্য। এসব থিমের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের অনন্য আবিষ্কার জন্মের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই শিশুর শুনানি পরীক্ষা করে, শিশু শ্রুতিক্ষীণতা বা শ্রুতিহীনতায় ভুগছে কিনা, তা নিরূপণ করা সম্ভব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে শতকরা ৬০ ভাগ নিরাময় করে তোলা যেতে পারে। জন্মগত বধিরতা ও জন্মের অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে যে ধরনের বধিরতার সৃষ্টি হয় সেগুলো প্রায়ই তীব্র শ্রুতিহীনতা বা ক্ষীণতা বংশানুক্রমিক হতে পারে। অন্যদিকে বংশের ধারাবাহিকতায় নাও হতে পারে। গর্ভাবস্থার জটিলতা অথবা প্রসবকালীন অব্যবস্থাপনা দুটিই শ্রুতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

গর্ভকালীন অবস্থায় মায়ের Rubella, Syphillis, Toxoplasmosis, Cytomegalovirus, Herpes Virus জাতীয় প্রদাহ বধিরতার জন্ম দিতে পারে। তা ছাড়া Premature শিশুর জন্ম, জন্মের পরে শ্বাস নিতে ব্যর্থ হয়ে Asphyxia (জন্মের সময়ে অথবা জন্মের অব্যবহিত পরে অক্সিজেনের অভাব প্রতিটিই বধিরতার সৃষ্টি করতে পারে।)

গর্ভকালীন অবস্থায় কিছু কিছু ওষুধের ব্যবহার ও ভ্রুণের বৃদ্ধির সময়ে কানের যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ : জন্মের পরপরই অনেক শিশুর জন্ডিস হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু কখনো যদি জন্ডিসের মাত্রা অর্থাৎ বিলিরুবিন অতিরিক্ত বেড়ে যায় তাহলেও শুনানি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জন্মের পরে বধিরতার কারণগুলো যেমন- সংক্রামক ব্যাধির মেনিনজাইটিস, মিসল্স, মাম্পস, মধ্যকর্ণের প্রদাহ, মধ্যকর্ণে পানি জমে থাকা, শ্রবণেন্দ্রিয়ের ওপর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এমন সব ওষুধের অপব্যবহার অর্থাৎ সদ্যোজাত শিশুর প্রদাহে বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, ম্যালেরিয়ার ওষুধ ব্যবহার, টিবি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধ এবং ক্যান্সার নিরাময়ের ওষুধগুলো। মাথা এবং কানে আঘাত : এতক্ষণ পর্যন্ত যা বর্ণিত হলো সামান্য সতর্কতা ও যথেষ্ট যত্নে শতকরা ৬০ ভাগের মতো বধিরতাকে নিরাময় করে তুলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য ২০ মাচর্, ২০১৯ বধিরতার এক ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরেছে। পৃথিবীতে বর্তমানে ৪৬৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা শ্রুতি-প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে; যার ৩৪ মিলিয়ন শিশু। হিসাবে ধরা হচ্ছে ২০৫০ সালে এ সংখ্যা ৯০০ মিলয়নে পৌঁছবে। শতকরা ৬০ ভাগ শ্রুতিপ্রতিবন্ধী উপযুক্ত সময়ে রোগ নির্ণয় করে অথবা উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে নিরাময় করা যেতে পারে। অথবা প্রতিরোধযোগ্য গবেষণায় অর্থাৎ ডেমোগ্রাফি বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়েছে, শুধু শব্দদূষণের কারণে ১.১ বিলিয়ন লোক যাদের বয়স ১২ থেকে ৩৫, শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগবে। এসব সমস্যার সমাধানে পৃথিবীজুড়ে বার্ষিক ব্যয় হবে ৭৫০ বিলিয়ন ইউএস ডলার।

সুতরাং মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার দেওয়া শ্রুতি সিস্টেম কানকে স্বাভাবিক রাখা জরুরি। অর্থাৎ কানের ওপর কোনো আঘাত করা যাবে না। অন্যদিকে শব্দদূষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। যত্ন নিতে হবে। নিরাপদ শুনানির মানুষ তার জীবনকে সুরক্ষা করতে পারে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর