শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

কাতার সবুজায়নে করিমের উদ্যোগ

শাইখ সিরাজ

কাতার সবুজায়নে করিমের উদ্যোগ

কাতার মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির একটি দেশ। কাজের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার আমার কাতারে যেতে হয়েছে। কাতারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাংলাদেশ প্রবাসী বদরুল সাহেব আমার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি। কাতারে গেলেই সফর সময়ের মধ্যে একবার হলেও বদরুল সাহেবের বাসায় যেতে হবে।  আমার পুরো টিমের সঙ্গেই তার পরিবারের একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বদরুল সাহেবের স্ত্রী আফরোজা বেগম অসম্ভব অতিথিপরায়ণ একজন মানুষ। আমার মেজ বোন হেনার সঙ্গে বদরুল সাহেবের স্ত্রী আফরোজা বেগমের অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে। চেহারায় তো বটেই, কথাবার্তা, চলনে-বলনেÑ এত মিল থাকতে পারে! দেখে আমি বিস্মিত হই। উনার সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ মনে হয় হেনাই আমার সঙ্গে কথা বলছে। যাই হোক, তার আমন্ত্রণে মাসদুয়েক আগেও কাতার ঘুরে এলাম। খনিজ তেলে সমৃদ্ধ কাতার মরুভূমির দেশ হলেও কৃষিতে বেশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রচার করেছি চ্যানেল আইয়ের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে, নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। কাতারের দোহা শহরটি এমনিতে চকচকে ঝকঝকে, তারপর এখন প্রস্তুতি চলছে বিশ^কাপ ফুটবল-২০২২-এর জন্য। ইতিমধ্যে আপনারা সবাই জেনে গেছেন আগামী বিশ^কাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে কাতারে। আর এরই ছাপ পড়েছে কাতারের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিপণিবিতান, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ প্রতিটি জায়গায়। আরও উজ্জ্বল, আরও সবুজ করে তোলা হচ্ছে কাতারকে। এ মহাকর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রবাসীরাও। দোহা, রুক্ষ বালুকা ও কাঁকরময় মরুভূমিতে যেন উদ্ভিদের এক স্বর্গরাজ্য। ভৌগোলিকভাবেই শুষ্ক ও বৈরী প্রকৃতি গাছের জন্য প্রতিকূল। এখানে প্রকৃতি ও গাছের স্বভাব পরস্পরের বিপরীত। তাই প্রতিটি গাছকে টিকিয়ে রাখার জন্য আলাদা করে যত্ন ও ভালোবাসা দিতে হয়। আগেই বলেছি তেলের কল্যাণে কাতার অর্থ ও বিত্তবিলাশে এখন বহু অগ্রসর। এখানকার জনগোষ্ঠী এই মরুতে এখন রচনা করতে চায় সবুজ নিসর্গ। তাই এক্ষেত্রে তাদের অর্থ খরচে কোনো কার্পণ্য নেই। কখনো কখনো একটি গাছের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে, তারপরও প্রকৃতির এই আবেশ জড়িয়ে থাকতে এখন দারুণ আগ্রহী এখানকার অধিবাসীরা। আর এ ক্ষেত্রটিকে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য ও সেবার জন্য জায়গা করে নিয়েছেন তরুণ করিম মিয়া।

করিম মিয়াকে নিয়ে এর আগেও আমি লিখেছি। ২০১৬ সালে যখন আমি দোহার অন্যতম বৃহৎ নার্সারি শিল্প-প্রতিষ্ঠান হলান্ডির ওপর প্রতিবেদন নির্মাণ করতে আসি, তখন হলান্ডির ম্যানেজার হিসেবে পেয়েছিলাম তাকে। তখন তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, বাণিজ্যিক তৎপরতায় বিস্মিত হয়েছিলাম। ১৯৯৯ সালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার লেওয়াইরা গ্রামের রইস মিয়ার ছেলে করিম মিয়া কাতারে এসে এক নার্সারিতে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারপর যুক্ত হলেন হলান্ডি নামক নার্সারির সঙ্গে। কাতারে ২০ বছরের সংগ্রামী জীবন তার। বাংলাদেশের এমন তরুণরাই দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে সংগ্রাম করে চলেছে। তারা শুধু ব্যক্তি সাফল্যের নজির গড়ছেন তাই নয়, তারা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ জোগানদার।

করিম এখন কাতার সরকার তথা স্থানীয় নাগরিকদের সবুজের অভিযানে একজন সহায়ক। হলান্ডির চাকরি ছেড়ে নিজেই জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব নার্সারি। তার মালিকানাধীন নার্সারির নাম ওয়াশিংটনিয়া। দোহা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের মাইজা এলাকার এই নার্সারিতে ঢুকতেই লম্বা লম্বা এক ধরনের গাছ চোখে পড়ে, গাছটির নাম ওয়াশিংটনিয়া। গাছগুলোর যেমন চাহিদা তেমন মূল্য। এ গাছের নামেই করিম তার নার্সারির নাম রেখেছেন ওয়াশিংটনিয়া।

২০২২-এর বিশ^কাপ ফুটবলকে সামনে রেখে কাতারকে নানাভাবে সাজানো হচ্ছে। এই সাজসজ্জায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ উদ্ভিদ। সেই বাণিজ্যে শামিল হয়েছে ওয়াশিংটনিয়া নার্সারি। উদ্যোক্তা করিম মিয়া বলেছেন, মোট চাহিদার তুলনায় তাদের ব্যবসা অতি সামান্য। তাও সাফল্যের সঙ্গে করতে পারলে অনেক পয়সা। দশ মাসেই করিমের নার্সারির অর্থনৈতিক মূল্যমান ৭ মিলিয়ন রিয়াল অর্থাৎ ১৭ থেকে ১৮ কোটি টাকার। করিম জানালেন, তার নার্সারিতে ওয়াশিংটনিয়া, লিলিংটনিয়া, বোহেনিয়া, বিভিন্ন জাতের সাইট্রাস, ফুলের গাছ আছে। এগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন থাইল্যান্ড, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা, ইতালি, স্পেন প্রভৃতি দেশ থেকে। আগ্রহ থেকেই জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ আপনি, বাংলাদেশ থেকে কেন কোনো গাছ আনেননি? প্রশ্ন শুনেই কষ্টের একটা ছাপ ভেসে ওঠে তার মুখে। জানালেন, বাংলাদেশ থেকে ফলের চারা নেওয়ার চেষ্টা ছিল তার। কিন্তু বিদেশে রপ্তানি করার মতো নার্সারি শিল্প গড়ে ওঠেনি বাংলাদেশে। তার মতে, এ বিষয়টিতে সরকার যেমন গুরুত্ব দেয়নি, বেসরকারিভাবেও কেউ উদ্যোগ নেয়নি। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। উদাহরণ হিসেবে বললেন, ‘কাতারে নার্সারি পণ্যের বাজার ইতালির দখলে ছিল। তুরস্ক এসে সে বাজারে ভাগ নিয়েছে। স্পেনও নিয়েছে। স্পেনের রাষ্ট্রদূত নার্সারি মালিকদের দশ দিনের ট্যুরে নিয়ে গিয়ে স্পেনের নার্সারি শিল্প ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন। সব ধরনের খরচ ওরা বহন করেছে। এটা তাদের ইনভেস্টমেন্ট। তাদের শিল্পকেও তারা সেভাবে তৈরি করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এভাবে চিন্তা করে না। অথচ চাইলেই আমরা কৃষিজ পণ্যের বাজার তৈরি করে নিতে পারতাম। বাজার তৈরি করতে হলে সম্পর্ক উন্নয়নও জরুরি। গত চার মাসে আমরা ২৫টি দেশ থেকে গাছ নিয়ে এসেছি। চার মিলিয়ন রিয়েলের (কাতারের মুদ্রা) গাছ এনেছি থাইল্যান্ড থেকে আর বাকি ২৪টি দেশ থেকে এনেছি ২.৫ মিলিয়ন রিয়েলের গাছ। থাইল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়ার তো মিল আছে। আমরা চাইলেই পারি, কিন্তু চেষ্টা করছি না।’

করিমের নার্সারিতে একজন ক্রেতার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি মহাসড়কের পাশে সবুজায়নের কাজে নিয়োজিত একজন ঠিকাদার। নাম মোহাম্মদ ফৌজি। অনেকগুলো ঠিকাদার কোম্পানির একটি তাদের। কথা হলো তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, করিমের নার্সারি থেকে ৯ হাজার গাছ কিনবেন। ২০২২ সালের বিশ^কাপ ফুটবলের আয়োজন উপলক্ষে কাতারকে সবুজ করার উদ্যোগ হিসেবে তারা কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন আল কুড় মহাসড়কের দুই ধারে গাছ লাগানোর। চার কন্ট্রাক্টর কাজটি পেয়েছেন। তিনি ৩৩ কিলোমিটার রাস্তার জন্য ৯ হাজার গাছ কিনছেন। করিম মিয়া অন্য প্রতিষ্ঠানে যখন চাকরি করেছেন তখন কাজগুলো অতিযত্নে আপন মনেই করেছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে ছিল তার গভীর সখ্য। এ কারণে, তিনি যখন সাফল্যের সঙ্গে প্লাজা হলান্ডির দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ করে নিজেই একটি বাণিজ্যিক নার্সারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখন আগের প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মীই তার সঙ্গে চলে এসেছেন। বিশ^ব্যাপীই বাংলাদেশের তরুণরা তাদের কর্মদক্ষতা, বিনয়, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখছেন। এর মাধ্যমেই তারা অর্জন করছেন বাণিজ্যিক সাফল্য। করিম মিয়া তার এই নতুন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করেছেন ৩০ জন নিয়মিত কর্মী। যারা এক কথায় ভালো আছেন বলে জানালেন।

পৃথিবীর ২৫টি দেশ থেকে গাছ, গাছের কলম ও চারা এনে সবুজ নিসর্গ গড়ে তোলা হয়েছে। এই নিসর্গ দেখেই ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়। নার্সারিটি এখনো কেবল গড়ে ওঠার পর্যায়ে আছে। তাই অনেক কাজ বাকি। তারপরও এর কোনো কোনো অংশ দেখলে মনে হয় রীতিমতো অরণ্য, কোনো কোনো জায়গা পার্কের মতো। দৃষ্টিনন্দন, প্রাকৃতিক গাছ ও তার সজ্জা দেখলে অবাক হতে হয়। সেখানে ল্যান্ডস্কেপের উপযোগী ছোট ছোট গাছ উৎপাদনের জন্য গ্রিন হাউজ তৈরির কাজ চলছে। করিম মরুভূমিতে বাণিজ্যিক আমবাগান গড়ে দেবেন। একটি কাতারির রয়্যাল ফ্যামেলির এই চাহিদা পূরণের জন্য রীতিমতো আমবাগান গড়ে তুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ভারতের হায়দরাবাদ থেকে নিয়ে গেছেন ৯০টি আমের চারা। সব ঠিকঠাক থাকলে ২২ হাজার গাছের আমবাগান তৈরি করে দেবেন তিনি।

সব মিলিয়ে অসাধারণ এক উদ্যোগ। বাংলাদেশের তৃণমূল কৃষক পরিবারের সন্তান করিম কাতার প্রবাসে আছে ২০ বছর। এই সময়ের মধ্যে অসাধারণ সাফল্য তার। ২০ বছরের অভিজ্ঞতার মাত্র ১০ মাস প্রয়োগ করেছে এখানে। আগামী পাঁচ বছরে বিপুল সাফল্য ও সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছে সে। পৃথিবীর দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহুমুখী সাফল্যজনক কর্মতৎপরতা শুধু আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেই ভূমিকা রাখছে না, ভূমিকা রাখছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা ও কল্যাণে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কৃষির নানান খাতে রপ্তানি আয়ের সমূহ সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও রেহাই পেতে পারে আমাদের তরুণ সমাজ।  এ বিষয়টি নিয়ে সরকার গভীরভাবে ভেবে দেখবে বলে আমার প্রত্যাশা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর