শনিবার, ৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা

এম এ মান্নান

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা

মধ্যযুগে চিকিৎসা শাস্ত্রের দিকপাল হিসেবে ভাবা হয় ইবনে সিনাকে। ইউরোপে তিনি পরিচিত আভি সিনা হিসেবে। চিকিৎসা শাস্ত্রের এই মহাপন্ডিতের পুরো নাম আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা।  ইবনে সিনা উজবেকিস্তানের খার্মাতায়েন জেলার আফসানা নামক স্থানে ৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মতান্তরে আগস্টে জন্মগ্রহণ করেন। আরবি পঞ্জিকা অনুসারে ৩৭০ হিজরি সনে। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ, মাতার নাম সিতারা। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফারসি। সমকালীন অন্যদের মতো তিনিও আরবি ভাষাকে জ্ঞান প্রকাশের মূল বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। ইবনে সিনার পিতা বুখারার সামানীয় সম্রাটের অধীনে একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। জন্মের পর ইবনে সিনা সপরিবারে আফসানায় বাস করছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় ভাইয়ের জন্মের পর বাবা-মা বুখারায় চলে আসেন। তাঁদের শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। সিনা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ধর্ম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে চিন্তা করতেন। এতে তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষক সবাই বিস্মিত হতেন। ইবনে সিনার বাবা আবদুল্লাহ সেখানকার এক মেওয়া বিক্রেতার কথা জানতেন। এই বিক্রেতা ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাবা আবদুল্লাহ সিনাকে মেওয়া বিক্রেতার কাছে গণিত শেখার ব্যবস্থা করে দেন। মেওয়া বিক্রেতা এর আগে কাউকে তাঁর জ্ঞান বিতরণের সুযোগ পাননি। এ সুযোগে তিনি সিনাকে সানন্দে শিক্ষা দিতে থাকেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় গণিতের অনেক বিষয় তাঁর আয়ত্তে এসে যায়। এরপর তাঁকে অধ্যয়ন করতে হয় ইসমাইলি শাস্ত্রের আইন অধ্যায়। এতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। এর মাঝে আর একজন যোগ্য শিক্ষকের সন্ধান পান সিনার পিতা। তিনি ছিলেন তৎকালীন অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব আল নাতেলি। বিস্মিত হয়ে তিনি আবদুল্লাহকে বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলে একদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে। দেখবেন, ওর পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত যেন না ঘটে।’ ইরানে যাওয়ার পথে ইবনে সিনা তাঁর সে সময়কার কবি ফেরদৌসির জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগর পরিদর্শন করেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী ও ঐতিহাসিক এ নগরটিকে ভালো লেগে গিয়েছিল সিনার। এখানে অনেক দিন ছিলেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও হয়েছিল। তাই মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। হামাদানে তিনি এ প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীরস্থির মনে চিন্তা করার সময়-সুযোগ লাভ করেন। হামাদানের সম্রাট তাঁর থাকা-খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি এখানে চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা উপার্জন করতেন। এর সঙ্গে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ কিতাব আল শিফা রচনা করেন।

ইবনে সিনা ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বসেরা চিকিৎসক। হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবনে সিনা তাঁর চিকিৎসা করেন এবং তিনি আরোগ্য লাভ করেন। খুশি হয়ে সুলতান তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে ইবনে সিনা ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এই পদপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তা ছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবনে সিনাকে সহ্য করতে পারছিল না। তাদের সঙ্গে ইবনে সিনার বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেনাধ্যক্ষ সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সুলতানের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন। সেনাবাহিনী প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সুলতানের ছিল না। তাই তিনি ইবনে সিনাকে নির্বাসনদ- দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রাখেন। তা না হলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাঁদের সহায়তায় সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগর ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান। হামাদান থেকে ইবনে সিনার পলায়নের কিছু দিন পরই ইস্পাহানে এক ছদ্মবেশী সাধুর আবির্ভাব হয়েছিল। ইস্পাহানের সুলতান জানতে পারেন যে এই সাধু আসলে ইবনে সিনা। তিনি সসম্মানে ইবনে সিনাকে নিজ দরবারে নিয়ে আসেন এবং রাজসভায় আশ্রয় দান করেন। ইবনে সিনা ইস্পাহানে বেশ কিছুকাল শান্তিতে দিনাতিপাত করেন। এখানে বসেই তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কিতাব আল ইশারাত রচনা করেন। কিন্তু এখানেও বেশি দিন শান্তিতে থাকতে পারেননি সিনা। অচিরেই হামাদান ও ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ইস্পাহানের সুলতান হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এ সময় সুলতান চিকিৎসাসেবা প্রদানে ইবনে সিনাকে সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সুলতানের অনুরোধে ইবনে সিনা ইস্পাহানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামাদানের পথে রওনা হন। হামাদানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।  তাঁর এ অসুখ আর সারেনি।  হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে (৪২৮ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন।

সর্বশেষ খবর