শিরোনাম
রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশ ও জাতির উন্নয়নে নারীর ভূমিকা

ফাতিমা পারভীন

দেশ ও জাতির উন্নয়নে নারীর ভূমিকা

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এক সময় এ দিবসের নাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’। বিশ্বব্যাপী নারীরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় জানাতে এই দিবস উদযাপন করেন। বিশ্বের একেক প্রান্তে নারী দিবস উদযাপনের লক্ষ্য একেক প্রকার। কোথাও নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। সৃষ্টির প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে ক্ষুদ্র একটি নাম ‘নারী’ যার বিশ্লেষণ বর্ণনাতীত। মেঘের মতো মানব জীবনে ছায়া হয়ে থাকে ওই নামটি। ওই শব্দটি অনেক গভীর থেকে প্রোথিত। যদি প্রশ্ন করা হয়, স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা কী? তবে নিঃসন্দেহে উত্তর হবে ‘মা’, ‘স্ত্রী’, ‘বোন’ এবং ‘কন্যা’। অজানা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কিছু অনুভূতি জড়িয়ে আছে আরেকটি শব্দে আর তা হলো ‘নেত্রী’। আর ওই নেত্রীর নাম বলতে গেলে আজ প্রথমে যে সফল নারী নেত্রীর নাম নিতে হবে তার নাম এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সফল এক রাজনীতিকের নাম হিসেবে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাই এ মুহূর্তে একজন সফল নারী নেত্রীর নাম লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে আর তিনি হলেন, জননেত্রী ‘শেখ হাসিনা’। তিনি শুধু বাংলাদেশে দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রীই নন, প্রভাবশালী নারী প্রশাসক হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। টানা ৩৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগের হাল ধরে আছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথটা খুববেশি নিষ্কণ্টক ছিল না বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য। জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েই বিভক্ত আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেছেন তিনি। শুধু তাই নয় তিনি প্রিয় দেশবাসী ও বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন করে চমক সৃষ্টি করেছেন। এখন আর মানুষ মঙ্গাপীড়িত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অথবা নিম্নগতি হলেও মানুষের মধ্যে এখন আর হাহাকার নেই। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এসব অর্জন প্রত্যাশার তুলনায় নগণ্য। কেননা জাতীয় পর্যায়ে এর অগ্রগতি হলেও তৃণমূলের নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়নি। তৃণমূলের ক্ষমতা প্রাপ্তি ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের এখনো বড় ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়নে বৈশ্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিষয় হলো নারী-পুরুষের সমতা, অথচ বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর ও মর্মস্পর্শী। প্রকৃতির আলো নিভে আসলে নারী ও কিশোরীদের পড়তে হয় চরম বিপাকে, চলন্ত বাসে দেখা যায় হেলপারের অশনিসংকেত। ‘সিট খালি নেই’ বলেই সহজ উপায়ে বাসের গতি আরও দ্রুত বাড়িয়ে চলে যায় অথচ ভাবেই না ওই নারী, কিশোরী ও শিক্ষার্থীর বাড়ি ফেরা কতটা অনিশ্চিত। এখানে তাদের সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে একজন পুরুষকে নামিয়ে নারী বা শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কেননা একজন পুরুষের ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নারীর মতো প্রকৃতিগতভাবেই ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। যদি পরিবারের দিকে তাকাই তবে আরও ভয়ঙ্কর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হয়। পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নারীর অবস্থান খুব কাছ থেকে দেখেছি। এটি এতটাই দুঃখজনক যে, শুধু লিখে প্রকাশ করা যায় না। একজন নারীর গ্রামীণ সালিশ বিচারের কাছে ধরনা ধরতে হয় দিনের পর দিন। এখানেও আছে গ্রাম্য রাজনীতি। নারী ঘরের কোনে আবদ্ধ আর পুরুষ বাইরের জগতের বা নেতৃত্বে শক্ত অবস্থানে আছে বিধায় অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি তাদের দিকে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। সম্পত্তি পতিত হোক আর নাই হোক অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক কম মূল্যে ভাইদের কাছেই বিক্রি করে যেতে হয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিধবা নারীর অসহায়ত্বের কথা ভেবে সবচেয়ে পতিত জমিতেই ভোগ দখলের ঠাঁই মিলে। পরবর্তীতে ভাইসহ পরিবারের সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। শুধু তাই নয় ওইসব মূর্খ প্রাকটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আজ পরিণত হয়েছে, দেশের আনাচে কানাচে নারীর প্রতি উপেক্ষা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘উত্তরাধিকার উন্মুক্ত হওয়ার পূর্বে মৃত ব্যক্তির কোনো ছেলে কিংবা মেয়ের মৃত্যু ঘটিলে যদি উত্তরাধিকার উন্মুক্ত হওয়ার সময় ওইরূপ ছেলে কিংবা মেয়ের সন্তানাদি জীবিত থাকে তবে উক্ত মৃত ছেলে কিংবা মেয়ে উত্তরাধিকার উন্মুক্ত হওয়ার সময় জীবিত থাকিলে যে অংশ পাইত তাহারা সমষ্টিগতভাবে ঠিক সেই অংশ পাইবে।’ অথচ দেখা যায় ওই মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা ওয়ারিশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় বঞ্চিত হয়। ওয়ারিশ সনদ থেকে তাদের পুরোপুরি বাতিলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, এখানে চরম একটি ব্যাড প্রাকটিস যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পুরুষের বেলায় আইন আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সহজ হলেও নারী ওয়ারিশদের ক্ষেত্রে আকাশ কুসুম কল্পনা। জন্মসূত্রে পৈতৃক সম্পত্তি আর ভাগ্যে জোটে না। এ সমস্যা আইনগত সমাধানে সবার এগিয়ে আসা উচিত। নতুন আইন প্রণয়ন করা উচিত, নতুবা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে মুখ থুবড়ে পড়বে। ধর্ম, রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা এবং মানব জাতির বিকাশে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি নারী ও কিশোরীরাও আমাদের সবার জীবনের ওপর পুরোপুরি প্রভাব ফেলতে পারে, সেই নীতি, পরিষেবা ও অবকাঠামোর আকার রাষ্ট্রকে মজবুত করে দিতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে যে নারী ও কিশোরীরা এখনো পিছিয়ে আছে সবার জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে সব বাধা ভেঙে, তাদের সমর্থনে আসুন পাশে দাঁড়াই।

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর