সোমবার, ৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মরছে হিন্দু? মুসলমান? নাকি মানুষ?

রণেশ মৈত্র

মরছে হিন্দু? মুসলমান? নাকি মানুষ?

বিশ্বের ‘গণতন্ত্রের মহানায়ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সস্ত্রীক ভারত সফর করে গেলেন। দুই দিনব্যাপী এ সফরে ভারতকে বিপুল পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রের সরবরাহের চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো ভারতকে এশিয়ার সামরিক-প্রধান বানানোর লক্ষ্যে। যদিও এশিয়ায় ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী পাকিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ বাধার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যা যা বললেন তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো ‘ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধে উভয় দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেশ কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও এ সফর উপলক্ষে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এ সফর উপলক্ষে ভারত সরকার, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারি তহবিল থেকে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তা নজিরবিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। ওই বিপুল ব্যয় যে উদ্দেশ্যমূলক তার প্রমাণও হাতেনাতেই পাওয়া গেল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণায়।

অপরপক্ষে এ সফর উপলক্ষে দিল্লির মানুষও হয়ে ওঠেন সরব। তারা হাজারে হাজারে রাস্তায় নামে সিএএ বা সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নামক মোদি সরকার কর্তৃক ও পাসকৃত এক ঘোর সাম্প্রদায়িক আইনের বিরুদ্ধে। সবারই জানা, ওই সংবিধান সংশোধনী পাসের লক্ষ্য হলো বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে তাদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা। এমন একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার-বিরোধী আইন প্রণয়নের কথা আজকের সভ্য দুনিয়া কল্পনাতেও আনতে পারে না।

আইনটি গতবার যখন প্রণীত হয় তখন থেকেই তার বিরুদ্ধে ভারতের সব প্রান্তের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ, ভারতের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র সমাজ, যুবসমাজ ওই সংশোধনী বাতিলের দাবিতে পথে নামেন। সেই আন্দোলন চলেছে ভারতজুড়ে। একের পর এক রাজ্য বিগত কয়েক মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপিকে ‘না’ বলেছে বিজেপিবিরোধী শক্তিসমূহকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। অতি সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজেপি শত চেষ্টা সত্ত্বেও গোহারা হেরে যায়। নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের দল পায় মাত্র ৭টি আসন-আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল বাকি ৬৩টি আসনে বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয়ী হয়ে তৃতীয় দফার মতো সরকার গঠন করেছে। রাজধানী দিল্লিতে অবস্থানরত মোদি সরকার প্রত্যাখ্যাত হলো খোদ দিল্লিতেই।

তার ওপর আবার ভারতে অর্থনীতির ক্রমাবনতি। দক্ষিণ-ভারতে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন বহু কৃষকের আত্মাহুতি। সর্বত্র মানুষের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান। হিন্দুত্বের স্লোগান আর যেন মানুষকে আকৃষ্ট করছে না। ভাতের দাবি, কাজের দাবি মুখ্য দাবিতে পরিণত হচ্ছে। বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের অনুকূলে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণাতেও ভারতের মানুষের মনে কোনো উল্লাস দেখা যায়নি। ওই সময় কলকাতায় ছিলাম-চেষ্টা করেছিলাম মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে। কিন্তু না। যা ভেবেছিলাম তা আদৌ ঘটল না।

বিজেপির তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল প্রভাবশালী কোনো দেশের সার্টিফিকেট আদায়ের। সেই কাজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরকে ব্যবহারের মতলব থেকেই তার সংবর্ধনার এহেন আয়োজন। ট্রাম্প-মেলানিয়া উভয়েই পরিতুষ্ট। ট্রাম্প-মোদির আন্তরিকতাপূর্ণ গদ গদ আলিঙ্গনের ছবি দেখে তেমনটাই মনে হয়।

এর পটভূমিতে সমরাস্ত্র ক্রয়ের বিশাল চুক্তি। সবাইকে দেখানো ভারত একটি শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে অর্থবহ ঘোষণা উভয় দেশ ইসলামী সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করবে। অর্থাৎ ওই কাজে আমেরিকা ভারতকে সহায়তা করবে।

সন্ত্রাস দমনে সাম্প্রদায়িকতার লেবাস চাপানোর মাধ্যমে আবারও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার চেষ্টা এক ঢিলে বহু পাখি মারার উদ্যোগ। তার মধ্যে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টাই প্রধান যদিও সেটা অপ্রকাশ্য।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী-মুসলিমবিদ্বেষ উসকে দেওয়ার অবতার। তার নির্বাচনকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে। বিজয়ের পর ট্রাম্প সরকারের গৃহীত বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপ সেখানকার উচ্চ আদালত বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করেছিল। সেই সাম্প্রদায়িক প্রেসিডেন্টের ভারত সফরকে ভারতের জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। তাই বিক্ষোভ চলছিল তার ফিরে যাওয়ার দাবিতে। জবাব পুলিশি পদক্ষেপ। ক্রোধান্বিত সিএএ-বিরোধী দিল্লিবাসী ওই কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক আইন বাতিলের দাবিতে একই সঙ্গে হাজারে হাজারে মোদির বিজেপিবিরোধী স্লোগান নিয়ে মাঠে নামলে ট্রাম্পের নিরাপত্তা রক্ষার নামে কঠোর পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দিল্লি নগরী পুলিশি ব্যারিকেডের আওতায় আনা হয়। সৃষ্টি হয় এক যুদ্ধের আবহ।

ভারত সরকার যেন দিল্লিবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকল। মানুষের মৃত্যু আর হতাহতের বিষয়টি প্রতি মুহূর্তের ঘটনায় পরিণত হলো।

এ পরিস্থিতিতে বিজেপির কিছু নেতা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করলে সে সুযোগে সেখানে আগুন নিয়ে খেলা শুরু হলো। বিজেপির সন্ত্রাসী হিন্দু গুন্ডারা একটি মসজিদও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। প্রতিবাদী মুসলিমদের কয়েকজনকে হত্যা এবং লুটপাট শুরু হলো। পুলিশ যথারীতি নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে যথারীতি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করল।

বিষয়টি মুহূর্তে আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। বহু হিন্দু প্রতিবেশী মুসলিমদের অনেককে বাঁচালেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে দিল্লির জনতার প্রতিরোধ নতুন মাত্রা পেল।

কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির ক্রম অবনতি থামল না কিছুতেই। প্রতিবাদী হিন্দুদের অনেকের জীবন আহুতিও দিতে হলো। হিন্দু-মুসলিম নির্বিচারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকলেন তার মধ্যে পুলিশের গুলি ভাইয়ে ভাইয়ে গুলি উভয়ই চলল উন্মাদের মতো। এ পরিস্থিতিতে এলো আদালতের হস্তক্ষেপ। দিল্লি হাই কোর্টের একজন বিচারক মুবলিধর উসকানিমূলক বক্তৃতা বিবৃতি দেওয়া বিজেপি নেতাদের গ্রেফতারের আদেশ দিলেন। পুলিশ গ্রেফতার তো করলই না রাতের গভীরে সংগোপনে ওই বিচারককে দিল্লি হাই কোর্ট থেকে পাঞ্জাব হাই কোর্টে বদলি করে এক অভূতপূর্ব আদেশ দেওয়া হলো। ভারতের এতকাল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটা সুনাম ছিল। এই আদেশ দিয়ে তাকে ভূলুণ্ঠিত করা হলো।

বিরোধী দলগুলো-কংগ্রেস, বাম দলগুলোসহ সব সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনৈতিক দল তীব্র প্রতিবাদ জানালেও পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতির খবর এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি।

বলা মুশকিল, এ আগুন আর কয়দিন জ্বলবে-দিগি¦দিকে কতটাই বা ছড়িয়ে পড়বে-কতই না প্রাণনাশ ঘটবে-কতই না বাড়িঘর-দোকানপাট-বিপণি পুড়ে ছাই হবে।

একটি খবর অবশ্য কিছুটা স্বস্তি আনে। দিল্লি হাই কোর্ট দিল্লির পুলিশপ্রধানকে আদালতে তলব করেছে- উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতিদানকারী বিজেপি নেতাদের গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ তা কেন কার্যকর করল না তার কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস নেত্রী মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে মনমোহন সিংসহ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ বিজেপি পরিচালিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাই কোর্টের জজ বদলি প্রভৃতির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপিও অর্পণ করেছেন।

কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে মহিলারা একটি বিশাল মিছিল করেছেন দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিচালনাকারী বিজেপির বিরুদ্ধে।

দিল্লির দাঙ্গা থেমে গেছে। কিন্তু অকস্মাৎ এ ঘটনার ফলে নতুন করে যে দগদগে ঘা ভারতবাসীর দেহে গজিয়ে উঠল সেই ঘা সারানো যাবে কীভাবে কত দিনে? অথবা আদৌ কি তা সম্ভব হবে?

ইসলামের নামে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হিংস্র-অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাস, জঙ্গিপনা বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, বিশ্বসভ্যতা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে তার চেয়ে দিল্লির এ হিন্দু সন্ত্রাস, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু জঙ্গিপনা কি কিছু কম? কোনোক্রমে বা কোনো অজুহাতেই তাকে কি ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ আদৌ আছে?

দিল্লির চার চারটি জনপদ-জাফরাবাদ, মৌজপুর, চাঁদবাগ ও করোলবাগের অবস্থা এখনো ভয়াবহ। সে এলাকাগুলোতে ১৪৪ ধারা জারি আছে। দিল্লিতে ৪৫ কোম্পানি এবং ৮০০ বাড়তি জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছে।

ভারতে রাম মন্দির নির্মাণ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল সেই ক্ষত কি পুরোপুরি শুকিয়েছে। অনেকটা শুকিয়ে আসছিল বটে। কিন্তু তা হতে না হতেই আবারও দাঙ্গা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যা বাতিলের দাবিতে এ আন্দোলন সেই কুখ্যাত আইনটি বাস্তবায়নের জিদ তাদের। এ জিদ থাকলে সংঘাত বন্ধ হওয়া অসম্ভব। এখন সবকিছু দেখেশুনে বলতে ইচ্ছা হয়, “ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু”। আসলেই সাম্প্রদায়িকতাজনিত রক্তস্রোত, দাঙ্গাজনিত লাশের মিছিল, আর্তজনের কান্না, কোটি কোটি মানুষের চোখের অশ্রু আর অসহায়তা দেখতে দেখতে বা তাদের সেই গগনবিদারী আর্তনাদ শুনতে শুনতে এ উপমহাদেশের মানুষ ক্লান্ত।

সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলছে চল্লিশের দশক থেকে। তা থামানো দাওয়াই হিসেবে পাকিস্তান নামক দানবকে পয়দা করা হলো। আবার তা থেকে রক্তের সমুদ্রের বিনিময়ে বাংলাদেশ আনা হলো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে। এক দেশ ভেঙে তিন দেশ হলো। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা কি গেল? দাঙ্গা কি বন্ধ হলো? দাঙ্গাকারীরা কোনো দেশেই কি শাস্তি পেল?

না সাম্প্রদায়িকতা যায়নি-বেড়েছে। দাঙ্গা বন্ধ হয়নি-মাঝে মাঝেই তা হানা দিয়ে চলেছে, দাঙ্গাকারীরা কোথাও সাজা পায়নি বরং পুনর্বাসিত হয়েছে।

তাই স্থায়ীভাবে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। ভুলে যেন না যাই। হিন্দু মরছে না, মুসলমান মরছে না, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানও মরছে না। মরছে মানুষ।

লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

E-mail:[email protected]

সর্বশেষ খবর