সোমবার, ৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

লালসা নয় : প্রকৃতিকে বন্ধুভাবে ভোগ করুন

তুষার কণা খোন্দকার

লালসা নয় : প্রকৃতিকে বন্ধুভাবে ভোগ করুন

বেশ কয়েক দশক থেকে মানুষকে হামেশা বলতে শুনি, ‘আমরা সভ্যতার শিখরে পৌঁছে গেছি’। মানুষের দায়দায়িত্বহীন ভোগের পাপে পৃথিবী যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সভ্যতা নিয়ে কোনো লম্বা কথা শুনতে বুদ্ধিমান মানুষের ভালো লাগার কথা নয়। সভ্যতা নিয়ে যারা এমন আপ্তবাক্য বলে আনন্দ লাভ করে তারা হয় অজ্ঞানের স্বর্গে বাস করে অথবা নিজের সুখ-সুবিধার উপকরণগুলোকে সভ্যতা মাপার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেয়। ভোগবিলাসের সহজলভ্যতাকে যারা সভ্যতা বলে ভাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। ভোগী মানুষগুলো হয়তো ভাবে, আমরা একশ তলা উঁচু দালান বানাতে পারি এবং সেই একশ তলা দালানের ওপরে উঠতে এখন আর সিঁড়ি বাইতে হয় না। লিফটের বাক্সে সওয়ার হয়ে শাঁ করে দোতলা থেকে শুরু করে একশ তলার ওপরে এক লহমায় পৌঁছে যাওয়া যায়। দূর-দূরান্তে যেতে চাইলে দ্রুতগতির উড়োজাহাজ কত কম সময়ে সেখানে আমাদের পৌঁছে দেয়। রাতে গরম লাগলে এসি চালিয়ে শীতল বাতাসে আরামের ঘুম যা আমি ভোগ করি অমন আরাম সম্রাট আকবরও ভোগ করতে পারেননি।

অতএব আমরা সভ্যতার শিখরে চড়েছি এতে আর সন্দেহ কী! আসলে কি আমরা আদতে সভ্য হয়েছি নাকি অসভ্যতার শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে নিজেদের আবাস সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করেছি। আমরা সভ্য হলে কি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এত সাংঘর্ষিক হতে পারত? ২০২০ সালকে হিসাবে নিয়ে একবার ভেবে দেখুন, মানুষ এবং প্রকৃতি পরস্পরের বিরুদ্ধে কী ভয়ানক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আমরা মানুষ নামের দোপেয়ে প্রাণী প্রকৃতির সব দানকে উচ্ছৃঙ্খল পথে টাকায় রূপান্তর করে ভোগ করতে চেয়েছি। সে কাজটি করতে গিয়ে প্রকৃতির সহনক্ষমতা আমরা নিঃশেষ করে দিয়েছি। এখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে বলে রুষে উঠেছে। মানুষ প্রকৃতির আক্রোশ টের পাচ্ছে কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মিলমিশের আপস ফর্মুলা খুঁজে পাচ্ছে না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ দ্বন্দ্ব অবসানের আপস ফর্মুলা খুব সহজে পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না। উন্নত-অনুন্নত দুনিয়ার ১৯৫টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্যারিসে একত্রিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য একটি চুক্তি সই করেছিলেন। প্যারিস সম্মেলনে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তিতে কথা ছিল সব দেশ মিলেমিশে চেষ্টা করে পৃথিবীর তপ্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কমিয়ে আনবে। সারা দুনিয়ার বিশাল সব কলকারখানা থেকে ক্রমাগত যত গ্যাস নির্গমন হচ্ছে তার পরিমাণ কমিয়ে আনতে না পারলে উত্তপ্ত পৃথিবী অনেক অঘটন ঘটিয়ে দেবে; যা আমাদের ধ্বংসের দুয়ারে নিয়ে যাবে। কিন্তু হা হতাস্মি! কে শোনে কার কথা! প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অনেক আগেই ওটি হিমঘরে চলে গেছে। ২০২০ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি পৃথিবীর কোনো দেশেই দৃশ্যমান নয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য প্যারিস চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন কত জরুরি ছিল তা ভুক্তভোগী মানুষগুলো হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছে। ২০২০ সালের শুরু থেকেই প্রকৃতি তার রুদ্ররূপ দুনিয়াবাসীকে দেখাতে শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশের গরিবগরবা মানুষ। আমরা ডাঙায় হাঁটলেও কেউ হাসে না আবার পানিতে ডুবে মরলেও কেউ চোখ তুলে চেয়ে দেখে না। কিন্তু বড়লোক পৃথিবীর করুণ দশা আপনারা সবাই চোখ মেলে চেয়ে দেখুন। দাবানলের তা-বে অস্ট্রেলিয়া কতখানি বিপর্যস্ত হয়েছে যে, তার মতো ধনী দেশের জন্য দাতব্য সংস্থাগুলো মানুষের কাছে হাত পেতে অর্থ সাহায্য চাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার দুর্দশা দেখে আমরা আমাদের ভয়ঙ্কর পরিণাম অনুমান করতে পারি। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় প্রকৃতি প্রতিনিয়ত যেমন বিরূপ আচরণ করছে তাতে মনে হচ্ছে আমরা খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে শুরু করলে আমাদের অবস্থা কেমন বেহাল হবে ভেবে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুনিয়ায় কোনো কিছুকেই কেয়ার করেন বলে মনে হয় না। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে দিলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি মিথ্যা প্রচার। তাঁর বিজ্ঞমতে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এসব ফেক নিউজ। মিডিয়ার শয়তানি। এসব খবর নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। জলবায়ুর চিরাচরিত ধারা বিলকুল ঠিক আছে। তাঁর মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বাহানা করে আমেরিকান সরকারের ডলার নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর জলবায়ু বিপরীত আচরণ করছে। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এযাবৎ যত নষ্টামি করেছে প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতির প্রমাণ পৃথিবীর তাপমাত্রা অসহ্যরকমে বেড়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা অতিমাত্রায় বাড়ার কারণে সারা দুনিয়ার আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করছে। প্রকৃতির আচরণের অস্বাভাবিকতা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। ঝড়, বন্যা, খরা, রোগব্যাধি, কীটপতঙ্গ আমাদের সাধের পৃথিবীকে তছনছ করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরুতে জমাট বেঁধে থাকা বরফ অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে গলতে শুরু করেছে। মেরুপ্রদেশের জমে থাকা বরফ তড়িঘড়ি গলে গিয়ে যে পানি তৈরি হচ্ছে সে পানির তোড়ে সাগরের পানির উচ্চতা কয়েক মিটার বেড়ে যাবে। সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে ইউরোপের উন্নত দেশ নেদারল্যান্ডস এবং এশিয়ার অনুন্নত দেশ বাংলাদেশ একযোগে নোনা পানির তলে তলিয়ে যাবে। ইউরোপের দেশগুলো পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ার পরিণাম কী হতে পারে তা আঁচ করতে পারছে। তারা পৃথিবীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার ব্যাপারে অত্যন্ত নমনীয়। ইউরোপের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পথে আমেরিকা প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকা ট্রাম্পের নেতৃত্বে যা করছে সেগুলো একবারে দুনিয়াছাড়া কায়কারবার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুনিয়ার তাবৎ বিজ্ঞানীর সব তথ্য, সব সাবধানবাণী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন। ট্রাম্প সাহেব জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্যারিস সম্মেলনে গৃহীত প্যারিস চুক্তি থেকে সরে এসেছেন। এটি জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পথে একটি বড় বাধা। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর স্রোত ফেরাতে হলে সম্মিলিত কর্মসূচি নেওয়া এবং অবিলম্বে তা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করতে টাকার প্রয়োজন। ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে এক টাকাও খরচ করবেন না- এ কথা দুনিয়বাসীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। অথচ দেখুন, খোদ আমেরিকায় আজ কয়েক বছর ধরে যখন তখন ভয়ানক বন্যায় একটার পর একটা শহর তলিয়ে যাচ্ছে। গত কয় বছরে কতগুলো টর্নেডো আমেরিকার উপকূল তছনছ করে দিয়ে গেল। ২০২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় ভয়ঙ্কর দাবানল দেখে মনে হচ্ছিল দুনিয়ার ওপর বুঝি হাবিয়া দোজখ নেমে এসেছে। কিন্তু ট্রাম্প সাহেব সবকিছুকেই ক্রমাগত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, এমন তো হতেই পারে। আমরা আমেরিকাবাসী টাকার জোরে সব সমস্যার সমাধান করে নেব। যাদের টাকা নেই তারা গোল্লায় যাক তাতে আমাদের কী। উই উইল মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন! ট্রাম্প সাহেব জানেন না, দুনিয়ার শেষ বিন্দু পানি যখন নোনা হয়ে যাবে তখন উনি ডলার চিবিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারবেন না।

আমেরিকার পরে আসে অস্ট্রেলিয়ার দুর্যোগ-দুর্ভোগের প্রসঙ্গ। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের দাবানলকে কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? অস্ট্রেলিয়ার তিনটি রাজ্যে গত তিন বছরে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়েনি। ভয়ঙ্কর খরায় খালবিল ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। পানির অভাবে সেখানে বনবাদাড়, প্রাণিকুল সব উজাড় হতে চলেছে। আরেকদিকে অস্ট্রেলিয়ার আরেক অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানে বন্যার তোড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ইউরোপের দিকে চেয়ে দেখুন। সারা বছর ইউরোপের কোথাও না কোথাও ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড এ বছর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। টেলিভিশনের পর্দায় ইংল্যান্ডের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ওটি আমাদের দেশের বন্যাকবলিত হাওর-বাঁওড়ের ছবি। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিট নিয়ে মেতে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর প্রভাবকে তিনি গোনায় ধরছেন বলে মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয়ে তিনি ট্রাম্পের পায়ের তলায় থাকতে ভারি পছন্দ করেন। ইংল্যান্ডের প্রকৃতি যতই ভিন্ন কথা বলুক, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তহবিল গঠনের প্রসঙ্গ উঠলে জনসন ট্রাম্পের সুরে সুর মেলাবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আফ্রিকার এমনিতেই দুঃখের শেষ নেই। ওখানে বন্যার চেয়ে খরার ভয় অনেক বেশি। খরার কারণে আফ্রিকার বহু দেশে অনেকবার দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এবারও খরার ভয়ে মানুষ যখন চিন্তিত তেমন অবস্থায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো পঙ্গপালের আক্রমণ শুরু হয়েছে। পঙ্গপালের আক্রমণে ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা বিরান হতে চলেছে। লাখো কোটি পঙ্গপাল ফসলের সবুজ মাঠ কিংবা বনজঙ্গলকে চোখের নিমিষে খেয়ে ধূসর করে দিচ্ছে। জাতিসংঘ সাবধানবাণী দিয়ে বলেছে, খুব শিগগির পূর্ব আফ্রিকার এ দেশকটিতে প্রবল খাদ্য সংকট দেখা দেবে। ছয় দেশের মানুষকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সেখানে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সাহায্য পাঠাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো খাদ্যসংকটে ভুগছে। সৌদি আরবের নারকীয় যুদ্ধক্ষুধা ইয়েমেনকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। এর ওপর আফ্রিকার দেশগুলোয় খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস দুনিয়াকে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনকে সামলানো না গেলে আফ্রিকা একা নয়, পৃথিবীর বহু দেশ আফ্রিকার মতো খাদ্যসংকটে পড়বে। তেমন সংকট শুরু হলে কে কার মুখে আহার জোটাবে? আমরা ভুলে গেছি, প্রকৃতি যদি বিমুখ হয় তাহলে ধনী-গরিব কেউ আমরা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারব না। পৃথিবীর ধনী-গরিব সব দেশ এবং ধনী-গরিব সব মানুষ প্রকৃতি বাঁচানোর আন্দোলনে এক কাতারে শামিল হবে- আমাদের এখন এটিই একমাত্র চাওয়া।     

লেখক : কথাসাহিত্যিক।    

সর্বশেষ খবর