সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মাথা নোয়াবে না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মাথা নোয়াবে না

বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের জন্য অনন্য এবং সর্বোত্তম একটি ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ১৭ মার্চ ২০২০। এরকম আরেকটি দিন পুনরায় আসার জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে আরও একশত বছর। সে দিন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ কেমন অবস্থায় থাকবে তা এখনই বলা কঠিন। তাই এই ১৭ মার্চ আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই অনন্য। এমন দিনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মানুষ কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ে সদা লিপ্ত থাকলেও কোথা থেকে যেন মনের অজান্তে আবেগ এসে জড়ো হয়। তাই কবি গুরুর শাজাহান কবিতার চারটি লাইনের দ্বারা জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির পিতার কথা মনে করতে চাই। ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/ তাই তব জীবনের রথ/ পশ্চাতে ফেলিয়ে যায় কীর্তিরে তোমার, বারম্বার/ তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে/ তুমি হেথা নেই।’ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি বাংলাদেশ। আর মহত্ত্ব সেটা তো আরও বড়। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে শুধুমাত্র বাঙালির স্বার্থের জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। একটি বারের জন্যও আপস করেননি। শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন বাঙালির স্বার্থের সঙ্গে তিনি আপস করবেন না। এর চেয়ে বড় মহত্ত্ব আর কী হতে পারে। এটা এখন সবাই জানেন, তিনি যদি সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি এবং একাত্তরের গণহত্যাকারীদের সঙ্গে সামান্য একটু আপস করতেন তা হলে তাঁকে এমনভাবে সপরিবারে জীবন দিতে হতো না। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন। সোনার বাংলাদেশ গড়ার যাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন। কিন্তু এটা যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশে সেই যাত্রার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সব তছনছ হয়ে গেল। বাঙালির শত্রু বাংলাদেশের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল। এই হত্যাকারী ও তার সহযোগীদের আমরা এখন চিনি। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয় সবার বিচার আমরা করতে পারিনি। হত্যার সহযোগীরা বাংলাদেশে বসে এখনো বড় গলায় কথা বলে। বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আজ আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি এবং আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। এটা ছোট অর্জন নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথে কত দূর  আমরা এলাম সেই প্রশ্নটি সংগত এবং প্রাসঙ্গিক।

প্রায় ১১ বছর একনাগাড়ে দেশের নেতৃত্বে রয়েছেন জাতির পিতার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ঠিক বাবার মতোই নিজের জীবনের ওপর বাজি ধরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত হিমালয়সম পাহাড় ঠেলে শেখ হাসিনাকে এগোতে হচ্ছে। তারপরে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রের অগ্রগতি আজ বিশ্বের রোল মডেল। নিজের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রতি বছর একবার আমেরিকায় যেতে হয়। ২০১৮ সালেও কয়েক মাস ছিলাম। তখন একদিন আমি আর আমার স্ত্রী, দুজন একটি পর্যটন কেন্দ্রের বড় শপিং মলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আলো ঝলমলে শপিং মলের বিশাল বিস্তৃত করিডরে বহু দেশের, বহু বর্ণ ও রঙের মানুষের উচ্ছল মুখর কলকাকলি দেখলেও ভালো লাগে। কিছু কেনার অসাধ্যের বিষয়টি মনে আসে না। দুই দিকে বড় বড় সব শপিং সেন্টার। আর মাঝখানে বিস্তৃত লম্বা করিডর। এই করিডরের মাঝখানে কিছু দূর পরপর ছোট ছোট স্টল নিয়ে বসে আছে, যাদের বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী বিক্রয়কারী। এরা প্রধানত মোবাইল প্রযুক্তির দ্রব্যাদিসহ প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রয় করে। পরে জেনেছি এসব স্টলের বিক্রয়কারীর বেশিরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীই বেশি, যারা দু-তিনজন মিলে সময় ভাগ করে যার যার অফ টাইমে এসে দোকানে বসে। তো এরকম একটা স্টলের পাশ ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় একজন স্মার্ট তরুণী একটু এগিয়ে এসে হ্যালো বলে আমরা কোন দেশের জানতে চাইল। সৌজন্যমূলক হ্যালো বলে আমি বাংলাদেশের কথা বলি। সঙ্গে ওই তরুণী ইংরেজিতে বললেন, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেমন আছেন। আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য সম্বিত ফিরে এলে আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করি, তুমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কীভাবে চিনো। প্রতিউত্তরে মেয়েটি যা বলল, সেটি বলার জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা। জানাল, সে আমেরিকার নাগরিক এবং স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করছে। তার অধ্যাপক তাকে বলেছে, একটা নিম্নবিত্তের দেশ কীভাবে এবং কী গতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে তা স্বচক্ষে দেখতে হলে বাংলাদেশে যেতে হবে। তারপর থেকে সে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের খবর এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিশ্বের বড় বড় থিঙ্কট্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে। তখন আমরা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। গরিব, দুঃখী, শ্রমিক, কৃষকের মুখে হাসি থাকবে, এমন বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। সেই টার্গেট এখনো দূরে থাকলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে সে পথেই এখন আমরা হাঁটছি। সামাজিক খাতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, মানুষের গড় আয়ু এবং নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এখন প্রথম কাতারে রয়েছে। প্রতিবেশী বিশাল দেশ, ভারতের চেয়েও এসব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে আছি। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম তার বিখ্যাত রচনা-ইগনাইটেড মাইন্ডস গ্রন্থের ১৩৯-৪০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, মোটা দাগে একটা রাষ্ট্রের পাঁচটি সেক্টরের দিকে তাকালে বোঝা যায় ওই রাষ্ট্র উন্নয়ন সড়কের কোথায় অবস্থান করছে। সেক্টরগুলো হলো, কৃষি ও খাদ্য, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্ট্যাটেজিক সেক্টর, যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং স্পেস ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি। শেষোক্ত সেক্টরে বাংলাদেশ এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। আর বাকি সেক্টরগুলোর দিকে তাকালে যে কেউ বলবে বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নের সড়কে উঠছে তা নয়, অগ্রসরও হয়েছে অনেক দূর। আর সে কারণেই বিশ্ব অঙ্গনে থেকে বলা হচ্ছে, চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৮তম সমৃদ্ধশালী দেশ হবে। কিন্তু আমরা এখনো শঙ্কামুক্ত হতে পারছি না। পঁচাত্তরের পরে আবির্ভূত অপশক্তি এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবলভাবে সক্রিয়। এই শত্রু তো  রয়েছেই। কিন্তু বড় শত্রু ঘরের মধ্যে। আমরা মুখে, অবয়বে ও বাগাড়ম্বিতায় বঙ্গবন্ধুর কথা যত বলছি তার খুব সামান্যই অন্তরে ধারণ করছি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন দেখি রাজনীতিসহ সব শ্রেণি-পেশার বড় এক অংশের মানুষ মুজিবকোট পরছেন, বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে মুখের ফেনা তুলে ফেলেছেন। আবার তারাই লুটপাট, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট এবং লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতিসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে ক্ষমতার করিডরে অবাধে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। এই লুটেরাই আবার ওই লুটের টাকা প্রশাসনের সর্বত্র ছড়িয়ে সব ম্যানেজ করছেন। বড় ভয়টা এখানে। এদের কোনো নীতি, আদর্শ, চরিত্র কিছুই নেই। এরা নিজের স্বার্থের জন্য যা কিছু করতে পারে। ২০২০ সালের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের তালিকা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। দুই-তিন দিন আগে দেখলাম একজনের নাম বাদ দিয়ে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু বাদ পড়া এই নামটির জন্য কারা সুপারিশ করেছেন, কারা তদবির করেছেন। তারা তো বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা নামের কলঙ্ক। এরাই ঘরের শত্রু বিভীষণ। বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক পক্ষ এবং তাদের দোসররা রয়েছেন, তারা তো বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলতে যা কিছু বোঝায় তার সব কিছুর বিরুদ্ধে। এরা চিহ্নিত শত্রু। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহজ, এদের থেকে সতর্কও থাকা যায়। কিন্তু একটু আগে যাদের কথা উল্লেখ করলাম, মুখে বঙ্গবন্ধু, আর কাজকর্ম সবই বঙ্গবন্ধুর চিন্তা, চেতনা ও আদর্শের বিরুদ্ধে। এরাই আজকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে সবচেয়ে বড় শত্রু। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে আজ একাই ঘরে-বাইরে, দুই শত্রুর বিরুদ্ধেই লড়াই করে যাচ্ছেন। তবে তার সঙ্গে বৃহত্তর জনমানুষ রয়েছে, আছেন অন্তঃপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধারা। এরা দূর থেকে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন, কল্যাণ কামনা করেন। এদের করার কিছু নেই। কারণ, ওই ছদ্মবেশী বঙ্গবন্ধু ভক্তদের ভিড়ে এসব অন্তঃপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর কন্যার আশপাশে যেতে পারে না। শুধুই দোয়া। শেখ হাসিনা যেন সহিসালামতে থাকেন এবং তিনি যেন তার বাবার স্বপ্ন বাংলাদেশকে রক্ষা করেন। আর যেন বাংলাদেশকে দুস্থ যন্ত্রণাময় ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। বৃহত্তর সাধারণ মানুষ ও অন্তঃপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক বন্ধুবর নঈম নিজাম তার লেখায় প্রায়ই বলে থাকেন আজ সব জায়গায়ই আওয়ামী লীগারে ভর্তি। নৌকা আর বঙ্গবন্ধু ব্যাজের ছড়াছড়ি। কিন্তু ২০০১-২০০৬ এবং ২০০৭-২০০৮, এই দুঃসময়ে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। চেতনার ব্যক্তিই বড় শক্তি। বাংলাদেশের চেতনা শক্তির মূল উৎসের জায়গা আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যার সব কিছুর ভিতরে যে নামটি প্রোথিত হয়ে আছে, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই নামের শক্তিই কেবল বাংলাদেশকে সব অপশক্তি ও দুর্বৃত্তদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এমন সব অবলম্বন, যা তিনি সারা জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘদিন এসব কথা বলারই কোনো সুযোগ ছিল না। নিকষ কালো অন্ধকার এককাল আমরা পার করে এসেছি।

তখন কখনো কখনো মনে হয়েছে আর বোধ হয় এই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার পথ নেই। কিন্তু আমাদের মহান নেতা যার জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি তিনি অভয় দিয়ে গেছেন- বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তাই বাংলার তরুণ কবি সুকান্তের ভাষায় বলা যায়- সাবাস বাংলাদেশ/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে পুড়ে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়। বাংলাদেশ মাথা নোয়ায়নি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মাথা নোয়াবে না।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর