বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

টিটকারি গায়ে লাগেনি

দিলারা আনোয়ার

টিটকারি গায়ে লাগেনি

বয়স তখন নেহাত কম নয়, তখনকার হিসাবে। ষোল কিংবা সতেরো। বাবার সঙ্গে যাচ্ছি চট্টগ্রাম শহরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে। দুরুদুরু বুকে শিহরিত মনে। গ্রামের মেয়ের উচ্চশিক্ষার্থে শহরযাত্রা। সময়টা ১৯৫৬ সাল। সময়, সমাজ, স্রোতের বিরুদ্ধে একাকী এক বাবা আর তার মেয়ের অসম যুদ্ধ। যাত্রাপথ হলো চৌধুরীঘাট হয়ে নৌকাযোগে ফিরিঙ্গীবাজার। চেনা ঘাট পেরিয়ে অচেনা নদী, অজানা বাজার, অতঃপর স্বপ্নের চট্টগ্রাম শহর। চৌধুরীঘাটে যাওয়ার পথে ঢিল এসে লাগল গায়ে। পেছন থেকে একদল লোকের টিটকারি শব্দের বোমা, সঙ্গে শ্লেষমাখা উচ্চৈঃস্বরে হাসি। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার চারপাশে পেছন থেকে ঢিলের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাবা আমাকে সামনে দিয়ে নিজে পেছনে গেলেন যেন ঢিল আমার গায়ে না লাগে। টিটকারি, শব্দবোমা গায়ে মেশেনি, মনেও লাগেনি। ওই মুহূর্তে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আমার দুই চোখ ঝরছে। বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন অপমান গায়ে না মাখতে। তখন অবুঝ মনে বলতে পারিনিÑ অপমানে নয়, ভালোবাসায় কাঁদছি আর মনে প্রচন্ড জেদ নিয়ে বারবার বলেছি, ‘পড়বই, ইংরেজিই পড়ব’। ঘটনার প্রেক্ষাপট মাস তিনেক আগে। বাবা যখন প্রাইভেটে পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছিলেন। তখনই আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী জেনে গেছে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। এর মধ্যে নিকটাত্মীয়রা এসে আভাসে-ইঙ্গিতে বলে গেছেন মেয়েকে ইংরেজি পড়ানোর দরকার কী? বিয়ে হবে না, সংসার হবে না। দুই দিন পর তো সেই রান্নাঘরেই ঢুকতে হবে। একদিন সন্ধ্যায় মা মাগরিবের নামাজে। বাবা বাড়িতে নেই। মায়ের দিকের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বাসায় এসে দেখলেন, মা নামাজে। উঁচু গলায় বললেন, মেয়েকে ইংরেজি পড়তে দিয়ে নামাজ পড়লে হবে? (পরবর্তীতে উনার সব ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়েছে। ভালোবেসে সরল মনেই উনি এ কথা বলেছিলেন)। মা সারা রাত কাঁদলেন, আমার ঘুম হলো না। বড়দা (আবদুল মোমেন চৌধুরী, পরবর্তীতে ওয়াপদার চিফ ইঞ্জিনিয়ার) তখন বুয়েটের শেষ বর্ষের ছাত্র। ছুটিতে বাড়ি এসে মাকে অনেক বুঝিয়ে ঠিক করলেন, আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ রকম তিন-চারবার পড়া বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই বড়দা এসে মাকে বলে আবার পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। বড়দা যখনই ছুটিতে বাড়ি আসতেন, তখন অঙ্ক বইয়ের ৫-৬ চ্যাপ্টার আর ইংরেজি কমপ্লিট করে দিয়ে যেতেন। আমার পরীক্ষার আগে উনি বাড়িতে থাকলেন দুই মাস। দুই মাসেই আমার অঙ্ক আর আগের বারের ১৯৫৪-৫৫ সালের ম্যাট্রিকের সব প্রশ্ন কমপ্লিট করে দিয়ে গেলেন। বাবা থাকতেন কক্সবাজারের চকরিয়া। মাসে একবার-দুবার আসতেন, কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায়, কখনো বা ঘোড়ায় চড়ে। বাবাও বাড়িতে এসে পড়া দেখাতেন। আগেই বলেছি, আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকবার। ১৯৫০ ও ’৫২ সালে চতুর্থ ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেলাম, তারপর পড়ালেখা বন্ধ। কারণ সমগ্র চট্টগ্রামে মেয়েদের কোনো স্কুলে ভর্তি করা হয় না। ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম শহরের খাস্তগীর গার্লস স্কুল। বাবা সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের তারাকিংকর বাবুকে ঠিক করলেন সপ্তাহে তিন দিন আমাকে পড়ানোর জন্য। তখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পল্লী উন্নয়নে ক্লাস হতো। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেন উনি। বাবা ‘বেগম’ পত্রিকা ঠিক করে দিলেন। ডাকযোগে এক মাস পরপর আসত। আমার আর একটা সুবিধা ছিল, চাচাতো, জ্যাঠাতো ভাই সাত-আটজন তখন কলেজে পড়ছেন। যারা তখন কলেজে পড়তেন তারা মাঝে মাঝে পল্লী উন্নয়ন স্কুলে ক্লাস নিতেন। তারা ক্লাস নেওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তাদের সঙ্গেই আবার বাসায় ফিরতাম। আর একজন আলোকিত মানুষের কথা না বললেই নয়। (মৃত) আহমেদ হোসেন মাস্টার। প্রফেসর আসহাব উদ্দিন (রাজনীতিবিদ, সাবেক এমএলএ) যখন পল্লী উন্নয়ন উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন তখন এই আহমেদ হোসেন সাহেব ছিলেন তার নিত্যসঙ্গী। এমনকি ১৯৬০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর যখন সবাই লাশ ফেলে পালাচ্ছে তখন তারা দুজন লাশ দাফন করছেন। গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাবে মানুষ পালাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত লাশ দাফন কাজে আসছে না। তখনো তারা দুজন এগিয়ে আসেন। যা হোক, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথায় ফিরে আসি। রিজার্ভ করা নৌকায় বিছানাপাতা, বালিশ দেওয়া পাটাতনে ঘুমিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছলাম। ঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে খাস্তগীর গার্লস স্কুলে বসে পরীক্ষাও শেষ করলাম এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। ছিলাম মামার (জাকেরুল হক চৌধুরীর, সাবেক এমএলএ ও আওয়ামী লীগ নেতা) বাসায়। অতঃপর আকাশসম স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হলাম, মানবিক বিভাগে। আমাদের সময় মেয়েদের জন্য কমনরুম ছিল একটা। স্যারদের সঙ্গে ক্লাসে আসতাম, ক্লাস শেষে পরবর্তী ক্লাস না হওয়া পর্যন্ত আবার কমনরুমেই থাকতাম। বান্ধবী হিসেবে পেলাম হামিদা আর সুরাইয়া নামের দুজনকে। হামিদা পরবর্তীতে আমার জা হয়েছিল। ডা. রুহুল আমিনের বউ। আর সুরাইয়া হয়েছিল সেই খাস্তগীর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ক্লাসে মাত্র তিনটি মেয়ে আমরা। হঠাৎ করে আমার বিয়ে হয়ে গেল দ্বিতীয় বর্ষেই। অসুস্থ হলাম, আপাতত পড়ালেখার পাট চুকাল।

সেদিনের সেই ঢিলের জেদ মনের মধ্যে সব সময় ছিল, এখনো আছে। নিজের অসুবিধার জন্য পড়ালেখা বন্ধ, কিন্তু মেয়েদের বিশেষ করে আমার পরিবারের অন্য সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী মেয়েদের পড়ালেখার জন্য অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। অবশেষে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ হলো ১৯৭৭ সালে যখন আমার ছোট ভাই জসীম, গোপাল চৌধুরী সাহেবরা মিলে সাধনপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিলেন। কথায় আছে, বাস্তবতা স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যায়। আমার বেলায় হলোও তাই। মেয়েদের জন্য স্কুল হবে। মুসলিম পরিবারের জন্য সেটা ছিল হাস্যকর। জসিমের সঙ্গে গোপাল চৌধুরীর বাড়িতে মিটিংয়ে গেলাম, ওখানে বললাম, আমি আছি প্রকাশ্যে। পশ্চিম সাধনপুর থেকে মুসলিম মেয়েদের পড়ালেখার ব্যবস্থা আমি করব। শুরু হলো আমার নতুন প্রত্যয়। মেয়েদের স্কুলে দেওয়ার জন্য সচেতনতা তৈরির কাজ। পশ্চিম সাধনপুর, মধ্যম সাধনপুর, দক্ষিণ সাধনপুর, উত্তর সাধনপুরÑ এমন কোনো ঘর নেই যে বাড়িতে মেয়ে আছে আর আমি যাইনি। মেয়েদের মা-বাবাকে বুঝিয়েছি, বিশেষ করে মায়েদের, মেয়েকে পড়তে দাও, মেয়ে যদি শিক্ষিত হয়, জামাইর অত্যাচার সহ্য করতে হবে না। জামাই ন্যূনতম সম্মান করবে। দীর্ঘ তিন বছর এ কাজ করেছি আমি। ’৭৯ সালে যখন স্কুল শুরু হয়, তখন শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম। প্রথম দুই বছর কোনো বেতন নিইনি। অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। স্কুল শেষে বাড়ি বাড়ি যেতাম, মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানোর প্রচেষ্টায়। আমি নিজেও আবার নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করলাম। এইচএসসি বিএ বি.এড পাস করলাম।

মানুষ ভাগ্য ফেরাতে জ্যোতিষীর কাছে যায়, পাথর চায়- আকিক, গোমেজ, পান্না, মতি। পাথরই আমার নিয়তি নির্ধারণ করেছিল সম্ভবত ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে। সেই পাথর যার জেদ তাড়িয়ে বেড়ায় এখনো। ১৯৮৫-৮৬ সালে গ্রামের মেয়েদের নিয়ে করলাম ‘শহীদস্মৃতি মহিলা সমিতি’। উদ্দেশ্য একটাই- গ্রামের মেয়েদের শিক্ষিত করা। প্রথম প্রজেক্ট দুটি। আমার পাশে জেলেপাড়া আর ওস্তাদপাড়া, যেখানে কোনো ছেলেই পড়ালেখা করত না, মেয়েদের তো প্রশ্নই আসে না। আমার ২০ বছরের প্রচেষ্টা আজ দুই পাড়ার মেয়েরা কলেজে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। আল কোরআনে প্রথম নাজিলকৃত শব্দ ‘ইকরা’ অর্থ ‘পড়’। সূরা আলাক, আয়াত ১। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?’ সূরা জুমার, আয়াত ৯। ‘বল, হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ সূরা তোয়াহা, আয়াত ১১৪। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুজন ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্র। সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তাকে তা সৎ পথে ব্যয় করার শক্তিও দিয়েছেন। অন্যজন সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন। যার মাধ্যমে সে বিচার-ফয়সালা করে ও অন্যকে তা শিক্ষা দেয়।’ বুখারি, মুসলিম। ‘যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে যাতে সে বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’ মুসলিম। নারীকে শিক্ষিত হতে হবে সম্মান নিয়ে বাঁচার জন্য, তার ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার জন্য। সর্বোপরি নিজের স্বাধীনসত্তা আর অধিকার নিয়ে বাঁচার জন্য।

                লেখক : সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর