বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আবুল মনসুর আহমদ

ইমরান মাহফুজ

আবুল মনসুর আহমদ

আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি- ত্রিধারার অভিজ্ঞতায় বাংলার একজন অভিভাবক ছিলেন। তাঁর জন্ম এমন সময়ে (১৮৯৮), যখন এ অঞ্চলের মানুষ তাদের ধর্ম ও আত্মপরিচয় নিয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। ফলত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে আবুল মনসুর আহমদের জীবন ও কর্ম পারস্পরিক হাত ধরাধরি করে আছে দীর্ঘকাল। তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক সাংবাদিকতার চিন্তাধারা জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে এগিয়ে নিতে সব সময় ভূমিকা রেখে আসছে। অন্যদিকে বলতে গেলে বাংলা ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা মূলত অভিন্ন। তবু বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িকতার ঘটনায় এ অভিন্নতায় ছেদ পড়ে। ফলত ১৯০৫ ও ১৯৪৭ জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের অভিধাটিকেই বদলে দেয়নি, কেবল রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বিভাজন সৃষ্টি করেনি, সময়-অসময়ের অভিঘাত বাংলাদেশ ভূখন্ডে নতুন জাতিসত্তার উত্থান অনিবার্য করে তুলেছিল। আর এই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোর একজন অসামান্য চিন্তক ও প্রত্যক্ষদর্শী আবুল মনসুর আহমদ। রাজনীতি-প্রাজ্ঞ আবুল মনসুর আহমদ বাংলার অনেক মুসলিম নেতার মতোই হিন্দু-মুসলিম সমাজের ঐক্যের সমর্থক হিসেবেই পথচলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক আচরণের ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করে তিনি বস্তুত সময়ের সঙ্গে রাজনীতির ধারাকে আয়ত্ত করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের হয়েই রাজনীতি আরম্ভ করেন। ফলে মুসলিম লীগের নীতিগত কারণেই তাঁর পক্ষে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের’ পন্থাবলম্বী হওয়ার সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া পূর্বোল্লিখিত রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক বাস্তবতা তো আছেই! তবে অধ্যাপক অজয় রায়ের লেখা থেকে বলা যায়, ‘ব্যক্তি হিসেবে আবুল মনসুর সাহেব কোনো সময়ইÑ মুসলিম লীগ বাংলায় এবং ভারতে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে চেয়েছিল, তা পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেননি।’ কাল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের রাজনৈতিক জীবন ১৯২০-১৯৬২। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে ছিলেন। শৈশবে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। এতে ত্রিকালদর্শী জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে যশ ও খ্যাতি যেমন ছিল, তেমনি জুটেছিল সামরিক শাসনের কারাযন্ত্রণা। কর্মজীবনে তিনি মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ নওশের আলী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মিয়া ইফতেখারউদ্দিন, মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি, জি এম সৈয়দ, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, আবুল হাশিম প্রমুখ এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও নেতাদের সঙ্গে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ও হৃদ্যতার সম্পর্ক। জনশ্রুতি আছে- নেতাজি সুভাষ বসুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ‘তুমি’ ‘তুমি’ পর্যায়ের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধাস্পদ নেতা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সগৌরবে আবুল মনসুর আহমদকে ‘লিডার’ বলতেন এবং কলেজ জীবন থেকে নিজেকে তাঁর শিষ্য বলে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন।

স্মৃতিকথা পড়ে জানা যায়, তাঁর জন্ম বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। কিন্তু অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস। তথ্য ও তত্ত্ব তালাশে হদিস পাই- আবুল মনসুর আহমদ রাজনীতিসচেতনতা ও সাংবাদিকতাসূত্রেই সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। হাস্যরসাত্মক অথচ শানিত বিদ্রুপাত্মক লেখার জন্যই বাংলা সাহিত্যেও একটি অনন্যসাধারণ অবস্থান অর্জন করেন। সমাজপতি, ধর্মগুরু, রাষ্ট্রপতি, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী যেখানেই দুর্নীতি, সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে লেখনীর দ্বারা আঘাত করেছেন। তাঁর রসাঘাত কশাঘাতে পরিণত হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদিত ‘ইত্তেহাদ’ অফিস বাংলার মুসলিম চিন্তানায়কদের তীর্থস্থান এবং ‘ইত্তেহাদ’ প্রগতিবাদীদের মুখপত্রে পরিণত হয়। তিনি দেখেশুনে শিক্ষিত ও তরুণদের পত্রিকায় হাতে-কলমে সাংবাদিকতা শেখান। ফলে হেডলাইন, ডিসপ্লে, মেকআপ, গেটআপ, টাইপ বিতরণ, প্রুফ রিডিংয়ে অল্প দিনেই ইত্তেহাদ কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৈনিকে পরিণত হয়। কিন্তু দেশ বিভাগের পর সবাই ঢাকায় চলে এলেও আবুল মনসুর আহমদ কলকাতায় থেকে যান। নানান ঘটনায় ১৯৫০ সালে দৈনিক ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে যায়। ইতি ঘটে সাংবাদিক-জীবনের। ফিরে আসেন বাংলাদেশে। এ সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সমকালীন বিষয়াবলি নিয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়Ñ যার প্রায় সবই সংকলিত হয়েছে বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থে। তার মধ্যে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত হয়েছে বাংলাদেশের কালচার। বিভাগ-পূর্ব ভারতের শেষ দিক, পাকিস্তান আমলের পুরো অংশ ও সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশÑ এ তিন আমল নিয়ে মোট ৬০টি নিবন্ধ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সনের মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

তিনি মূলত একজন কলামিস্ট হিসেবেই সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ে এ ৬০টি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যা ‘শেরে-বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ নাম দিয়ে ১৯৭৩ সনে প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ ও End Of A Betrayal and Restoration of Lahore প্রকাশিত হয়।  সর্বোপরি ষাটের দশকে আবুল মনসুর আহমদ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনাদি দৈশিক-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-অধ্যয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাই সময়ের মোকাবিলা বা প্রতিধ্বনি তোলার জন্য আবুল মনসুর আহমদকে আলোচনা, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক।

                লেখক : কবি ও গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর