শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা নিয়েও রাজনীতি

তুষার কণা খোন্দকার

করোনা নিয়েও রাজনীতি

আমি এক শিশু ছড়াকারের দারুণ ভক্ত। এত দিন তাকে ভক্তি করতাম তার ছড়ায় অন্ত্যমিল সৃষ্টির দক্ষতা দেখে। গতকাল থেকে তাকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করছি তার ছোট্ট বুকের বিশাল পাটা দেখে। দুর্দান্ত সাহসী এই শিশু ছড়াকার এ সপ্তাহে যে ছড়াটি লিখেছে সেটি অনবদ্য, তুলনাহীন। সে লিখেছে, ‘করোনারে করোনা, ধর নারে ধর না, মারো নারে মারো না’। করোনার ভয়ে সারা দুনিয়া যখন থরথর করে কাঁপছে তখন খুদে ছড়াকার করোনার বিরুদ্ধে রীতিমতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনাকে সে চোখ রাঙিয়ে রীতমতো ভয় দেখাচ্ছে। আমার মনে হয়, পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়করা যদি এই খুদে ছড়াকারের পথ অনুসরণ করে সাহসে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতেন, পৃথিবীর সব দেশ, সব মানুষ এবং আমরা একত্রিত হয়ে লড়াই করে করোনাকে হারিয়ে দিই। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। পৃথিবীর প্রভাবশালী রাজনীতিকের বেশির ভাগের বয়স ষাটের ঊর্ধ্বে। করোনা বালাইটি কিন্তু উনাদের জন্য মরণঘাতী। ষাটের নিচে যাদের বয়স এবং শরীরে অন্য কোনো রোগবালাইয়ের জোরাল প্রভাব নেই তাদের জন্য করোনা নেহাত সর্দি-কাশি-জ্বর। দুর্ভাগ্য, মানবজাতির, পৃথিবীর ষাটোর্ধ্ব একজন রাষ্ট্রনায়কও ইতিবাচক সহমর্মিতার পথে হাঁটলেন না। তাঁরা এটাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মওকা খুঁজছেন। ষাটোর্ধ্ব মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে উনারা পিশাচের হাসি হাসছেন বলেই মনে হচ্ছে। ১৫ মার্চ যখন এ লেখাটি লিখছি তখন করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চীন অফিসে প্রথম করোনা আক্রমণের খবর আসে। শুরুতে করোনার উৎসস্থল ছিল চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের নামকরণের সময় একবার ভেবেছিল উহান শব্দটি তারা করোনার সঙ্গে যুক্ত করবে। অনেক দিক ভেবে তারা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ভাইরাসের নাম রাখল কভিড-১৯ অর্থাৎ করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯। করোনাভাইরাসের নাম ঘোষণার সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক পষ্ট করে বললেন, করোনাভাইরাসের নামের সঙ্গে উহান শহর কিংবা চীনের নাম যুক্ত করলে ওই দেশ কিংবা উহান শহরের ওপর মানুষের ঘৃণার সঞ্চার হতে পারে। তেমন একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সচেতনভাবে করোনা গ্রুপের এ ভাইরাসের নাম রাখল কভিড-১৯। করোনাভাইরাসের নামের সঙ্গে চীন কিংবা উহানের নাম যুক্ত করা না হলেও দুনিয়ার বিদ্বেষী মানুষ ঢাকঢোল পিটিয়ে তাদের শক্তিশালী গণমাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ঘৃণা ছড়াতে শুরু করেছিল। আমাদের কাছের দেশগুলোর মধ্যে যাদের প্রচারমাধ্যম খুব শক্তিশালী তারা তাদের সবটুকু শক্তি নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছিল এ কথা এখন কারও জানার বাকি নেই। মিথ্যা প্রচারের মধ্যে ছিল উহান প্রদেশের সব মানুষকে চীন গুলি করে মেরে ফেলছে, করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ির ভিতরে রেখে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি। এসব খবর বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল; যা এখন দুনিয়াবাসীর জানার বাকি নেই। এসব অপপ্রচার চালিয়ে চীনের যা ক্ষতি হয়েছে তা সাময়িক। চীন শক্তিমান দেশ। এমন তুচ্ছ মিথ্যা প্রোপাগান্ডা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা চীনের আছে। তবে যেসব দেশের প্রচারমাধ্যম এ নোংরা খেলায় মেতেছিল তারা যে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাল তা কি পুনরুদ্ধার করতে পারবে? যে দেশ বিদ্বেষবশত এমন নোংরামিকে প্রশ্রয় দিল তারা তাদের সুনাম কি সহজে ফিরে পাবে? আমার পিতৃতুল্য শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ বলতেন, ‘অপমান যে করে সে ভুলে যায়। অপমানিত যে হয় সে কখনো সেই লাঞ্ছনার স্মৃতি ভোলে না।’ চীনের বিপদের সময় চীনের পাশে না দাঁড়িয়ে যারা বগল বাজাল তাদের আমি বিষয়টি মনে রাখতে অনুরোধ করব।

করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র চীন থেকে সরে ইউরোপে চলে গেছে। ইউরোপের দেশ ইতালি এখন মরণদশায় ভুগছে। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। করোনা আক্রমণের শুরুতে সারা দুনিয়া চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকে ধিক্কার জানাতে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। চীনের প্রতি কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। উন্নত দুনিয়া নিজেদের ঘরের দরজা সাটাসাট বন্ধ করে দিয়ে খলখল করে হাসছিল। কোনো পাইলট প্লেন চালিয়ে চীনের কোনো বিমানবন্দরে গেলে সেই পাইলটকে পর্যন্ত তারা তাদের দেশে ঢুকতে দিচ্ছিল না। প্রায় তিন মাস ধরে চীন একা তার লড়াই চালিয়ে গেছে। কিন্তু দেখুন, ইতালির বিপদে চীন মুখ ফিরিয়ে রাখেনি। ইতিমধ্যে চীন ইতালিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে। সেই সঙ্গে তারা বিপুল চিকিৎসা সরঞ্জাম ইতালি পাঠাতে কার্পণ্য করেনি। আমেরিকা ভান করে তারা ইউরোপের পরীক্ষিত বন্ধু। অথচ ইতালি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমেরিকা ধাঁ করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব কত ক্ষণস্থায়ী এবং মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে কথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের এবার ভাবার সময় হয়েছে। অনেক বছর ধরে তারা আমেরিকার যুদ্ধসাধ পূরণ করার মিশনে যেচে পড়ে বন্ধুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে এ দেশ সে দেশকে মারতে বের হয়। বিপদে বন্ধুর পরিচয় এটি লোকচলতি প্রবাদ। করোনা বিপদে আমেরিকা যেভাবে ইউরোপের দিকে চোখ ওল্টাল তাতে মনে হচ্ছে বন্ধুত্বের পরীক্ষায় আমেরিকা শূন্য পেয়ে ফেল করেছে। ইউরোপের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা কোন পদের বন্ধুত্বের পরিচয় দিল সে জবাব ইউরোপকেই খুঁজে বের করতে হবে। ভবিষ্যতে আমেরিকার সঙ্গে গলাগলি করে যুদ্ধে যাওয়ার আগে ইউরোপ আশা করি করোনা সংকটের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করবে।

আমেরিকার আরেক কা- দেখুন! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সচেতনভাবে করোনাভাইরাসের নামের সঙ্গে চীন কিংবা উহানের নাম জড়াল না। অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনাব ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে বলছেন এটি চীনা ভাইরাস। চীন দুনিয়াব্যাপী এ ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এটিকে ডাকছেন উহান ভাইরাস। ভাইরাসের ডরে ট্রাম্প ও পম্পেওর বোধ করি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নইলে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধারেকাছে না গিয়ে ট্রাম্প এমন বালখিল্য আচরণ করতে পারতেন না। কথায় কথা বাড়ে। ট্রাম্প এবং পম্পেও গা জ্বালানো ঝগড়ার কথা শুরু করতে চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছেন, আমেরিকা চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে আমেরিকার মিলিটারিরা উহান ভ্রমণ করেছেন। তারা সেখানে চীনের লোকজনের সঙ্গে অবাধে মিশেছেন এবং তাদের সঙ্গে কুস্তি কুংফু খেলেছেন। ইচ্ছাকৃত এমন ঢলাঢলি করে আমেরিকান সৈন্যরা উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ রাজনীতিকদের কাছে করোনা রোগটি রোগ বলে আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। এটি এখন রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ির হাতিয়ার। আমরা সাধারণ মানুষ উন্নত দেশের রাজনীতি যুদ্ধনীতির গোমর বলতে পারব না। আমরা জানি, কভিড-১৯ একটি রোগ এবং রোগটি ভয়ানক ছোঁয়াচে। দুনিয়াজুড়ে সবাই মিলেমিশে চেষ্টা করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু এ রোগকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যেভাবে চীনকে আক্রমণ করছে তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। আমেরিকার প্রচারমাধ্যমে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু শুরুতে তিনি সেটি টেস্ট করতে রাজি হচ্ছিলেন না। হাজারটা টালবাহানা শেষে মার্চের ১৪ তারিখে তিনি সাংবাদিকদের বললেন তিনি শরীরে করোনা বহন করছেন কিনা তা টেস্ট করতে দিয়েছেন। পরদিন সংবাদমাধ্যমে খবর দেখলাম, ট্রাম্পের শরীরের করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট নাকি নেগেটিভ। অর্থাৎ উনার শরীরে করোনা নেই। তবে উনার মেয়ে ইভাঙ্কা হোয়াইট হাউসের ভিতরে নিজেকে কোয়ারেন্টাইন করে রেখেছেন। অর্থাৎ হোয়াইট হাউসের ভিতরে করোনাভাইরাস কতখানি বিস্তার লাভ করেছে তা আমরা বাইরে থেকে বলতে পারব না। তবে করোনা নিয়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যেসব বাক্যবিনিময় হচ্ছে তাকে ছেলেমানুষী বাগযুদ্ধ ছাড়া আর কী বলব! ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চীনের পেছনে যেমন জোঁকের মতো লেগে আছেন তাতে চীন উনার প্রতি একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। আমি ভয় পাচ্ছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে চীন বুঝি আমাদের দেশের কবি সুকুমার রায়ের ভাষায় বলে বসে, ‘খুসখুসে কাশি ঘুসঘুসে জ্বর, আজকেই শেষ রাতে বুড়া তুই মর!’ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চীন এমন নিষ্ঠুর ঠাট্টা কখনো করবে না। চীনের সভ্যতার বয়স হিসাব করলে তার পাশে আমেরিকার সভ্যতা দুগ্ধপোষ্য শিশু। আমেরিকা যা করতে পারে তা আমেরিকানদের শোভা পায় না। সভ্যতার বয়সের হিসাব ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে মনে হয় আমেরিকা যেমন খুশি তেমন বালখিল্যপনা করতে পারে। চীনারা দুনিয়ায় সভ্যতার আলো জ্বেলেছে। আমি বিশ্বাস করি, চীনাদের ধমনিতে কনফুসিয়াসের রক্ত। তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাকে মূল্য দেয়। উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চীন স্বউদ্যোগে ডাক্তার ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠিয়ে ইতালিকে সাহায্য করতে গেছে। এটি সত্যি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। চীন তার এ শুভ উদ্যোগ শুধু একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না। আমেরিকা কিংবা ইন্ডিয়া ইতালির মতো বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লে চীন তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। চীন তাদের প্রাচীন শিক্ষক তাওবাদের প্রবক্তা লাউ জুর শিক্ষাকে নিশ্চয়ই মনে রেখেছে। খ্রিস্ট জন্মের ৪০০ বছর আগে মহান গুরু লাউ জু বলেছিলেন, ‘পৃথিবীটা কোনো একজনের একার নয় বরং সবার। যে ব্যক্তি তার ভালো অর্জনকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয় সে সারা দুনিয়ার সমর্থন পায়। যে ব্যক্তি তার ভালো অর্জনকে নিজের স্বার্থে কুক্ষিগত করে সে দুনিয়াকে হারায়।’ আমি বিশ্বাস করি, করোনার সঙ্গে যুদ্ধ জয় করে চীন যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তার সুফল তারা দুনিয়াকে অবাধে বিলিয়ে দেবে।

               লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর