শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বাসযোগ্য রাজধানী চাই

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ

বাসযোগ্য রাজধানী চাই

৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ শহর এখন বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য, অনিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে। প্রায় ২ কোটি মানুষের আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন, যাতায়াদের রাস্তা, গণপরিবহন, গ্যাস-বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জোগান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ঢাকা শহরে নেই। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই বেড়ে চলেছে বস্তি ও ভাসমান মানুষের সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান বস্তি ও ভাসমান মানুষ একদিকে যেমন শহরের আবাসন, যোগাযোগ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে কর্মহীন, দরিদ্র বস্তিবাসীর অনেকেই মাদকসহ নানাবিধ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে নাগরিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে।

মানুষ অভ্যাসের দাস। যে কোনো ভালো বা খারাপ অভ্যাসের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। যারা ঢাকার বাসিন্দা, তারাও অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়েছে। একটি সুসভ্য নগরীর চরিত্র কেমন হতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারে না। মাঝেমধ্যে বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা বিস্মিত হই এই ভেবে, এমন শহরও কি হতে পারে! যারা বিদেশ-ঘুরে এসে সেসব দেশের রাজধানী বা অন্য কোনো শহরের গল্প করেন, তখন ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তা তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই শোনায়। অথচ এসব রূপকথা নয়, মানুষের চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনারই ফসল।

রাজধানী ঢাকার সমস্যার কথা উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। এখানে নাগরিক সেবা বলতে গেলে নেই। নাগরিকরা নিজেরাই যেভাবে পারে, সেবা খুঁজে নেয়। এতে পরিকল্পনা বলে কিছু থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর যে আয়তন এবং এখানে যে-সংখ্যক লোকজন থাকা প্রয়োজন তার দু-তিন গুণ লোক বসবাস করছে। তার ওপর প্রতিদিন রাজধানীতে প্রবেশ করছে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ। আয়তনের তুলনায় বিশ্বে আর কোনো শহরে এমন নজির দেখা যায় না। আবার ঢাকার আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। একদিকে বাড়ছে তো বাড়ছেই। নগরীর সব বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা কোনো রাজধানীর চরিত্র হতে পারে না। আমরা যদি ঢাকার দিকে তাকাই, দেখা যাবে নিরাপদে চলাফেরা, জীবনযাত্রার স্বচ্ছন্দ, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা প্রদান, আইন-শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাÑ এসবের পরিপূর্ণ সুবিধা এখানে নেই। ভাবা যায়, একটি আদর্শ শহরে চলাচলের জন্য যেখানে সড়ক থাকার কথা ২৫ ভাগ সেখানে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। এই স্বল্প রাস্তা আবার দখলসহ বিভিন্ন কারণে আরও কমে গেছে। এর ওপর প্রতিদিন ৩০০-এর অধিক নতুন গাড়ি নামছে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন করুণ থেকে করুণতর দিকে ধাবিত হচ্ছে যে, যানজটে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

গবেষণা-প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে দেখিয়েছে, এক যানজটে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়। প্রতিদিন ক্ষতি হয় ২২৮ কোটি টাকার মতো। মানুষের সময় নষ্ট হয় বছরে ৮০ লাখ ঘণ্টা। যানজটের এমন চিত্র বিশ্বে আর একটি রাজধানীতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে মানুষ ট্যাপ খুলে নিশ্চিন্তে এক গ্লাস নিরাপদ পানি খাবে তার কোনো সুযোগ নেই। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি পানের অযোগ্য তো বটেই, তা দিয়ে রান্নাবান্না, গোসল করাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। পানিতে ময়লা-আবর্জনা, কীট পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ এ দূষিত পানিই নগরবাসীকে অতি উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি, গ্যাস পাওয়াও এখন কঠিন। শীত মৌসুম এলেই চুলা জ্বলে না, তীব্র সংকট দেখা দেয়। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় নগরবাসীর খাদ্য রান্না করা বন্ধ হয়ে যায়। বিপরীতে তাদের গ্যাসের দাম ঠিকই দিতে হচ্ছে।

রাজধানীর দু-একটি এলাকার সৌন্দর্যবর্ধন করে একে বসবাস উপযোগী করা যাবে না। এটা শুধু অন্ধকারে একটু আলো হয়েই থাকবে, পুরো অন্ধকার দূর হবে না। প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এলাকাভেদে ভাগে ভাগে উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে কিছুটা হলেও একে উপযোগী করে তোলা সম্ভব। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথ পরিকল্পনা করলে এবং এ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নিলে, ছোট জায়গাও বাসযোগ্য করে তোলা যায়। সবার আগে প্রয়োজন অপরিকল্পিত যেসব কার্যকলাপ চলছে, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। শহরের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। বৃদ্ধির বিষয়টিও পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নাগরিকরা যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের সমন্বয় করতে হবে। আমরা আশা করব, রাজধানীতে যেসব সমস্যা প্রকট হয়ে রয়েছে এবং যেসব অনাচার সংঘটিত হচ্ছে, তার সমাধানে সরকার, দুই সিটি করপোরেশন ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হবে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর