শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপদান

শাইখ সিরাজ

টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপদান

ফল চাষে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকখানি, বলা চলে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। ২০ বছর আগেও আম আর কাঁঠালই ছিল এ দেশের প্রধান ফল। আর এখন ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ২১ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছিল। ১০ বছর আগের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ১৮ লাখ টন। শুধু উৎপাদনই নয়, দিন দিন বাড়ছে ফলের চাহিদাও। কিন্তু এই উৎপাদিত ফল নিয়ে প্রায়ই বিপাকে পড়তে হচ্ছে কৃষককে। প্রথমত মৌসুমে ফলের দাম থাকে না, দ্বিতীয়ত ফল সংরক্ষণাগারের অভাব। কৃষকের এ অভিযোগ শুনে আসছি দুই দশক ধরে। ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এ বরাবরই কৃষকের অভিযোগ থাকে উৎপাদিত ফল-ফসল কৃষক বিক্রি করতে পারে না। বিশেষ করে মনে পড়ছে, ঝালকাঠিতে পেয়ারা চাষিরা দাবি তুলেছিলেন জ্যাম-জেলির কারখানা স্থাপনের। একই সমস্যা ছিল টাঙ্গাইল, মধুপুর ও পার্বত্য অঞ্চলের আনারস চাষিদের। সিলেটের টমেটো চাষিরা বিপাকে পড়েন টমেটো নিয়ে, আর মুন্সীগঞ্জের কৃষক উৎপাদিত আলু নিয়ে পড়েন সমস্যায়। অথচ আমরা দেশের বাইরে থেকে আলুর চিপস, টমেটো কেচাপ, নানা ফলের জুস আমদানি করছি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আপেল, কমলা, আঙ্গুর ও মাল্টা আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৮০২ কোটি টাকার। আমরা নিজেদের উৎপাদিত ফল-ফসলের ভ্যালু অ্যাড করতে পারছি না। মনে পড়ছে, ২০১৮ সালে চীনের শিনশিং কাউন্টির এক গ্রামে গিয়েছিলাম। পথে এক ফুয়েল স্টেশনে যাত্রাবিরতিতে সুপার শপে দেখেছিলাম তাদের জাতীয় ফল কিউই থেকে উৎপাদিত নানারকমের বিস্কুট, পানীয়, প্যাকেট জাতীয় খাবার। এক কিউই থেকেই তারা উৎপাদন করছে কম করে হলেও ১২ ধরনের খাদ্যদ্রব্য। শুধু তাই নয়, আমরা যে মুড়ি শুধু পিয়াজ-মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খাই, তারা সেই মুড়ি দিয়ে বানিয়েছে উপাদেয় নানান ধরনের নানান ফ্লেভারের বেকারি পণ্য। আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলাম কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে পরিণত না করতে পারলে কৃষক সুফল পাবে না। আপনারা জানেন, একসময়ের কদরহীন আশ্বিনা আম প্রাণ কোম্পানির কল্যাণে মূল্যায়িত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের আশ্বিনা আম চাষিরা সুফল লাভ করছে। আর দেশব্যাপী উৎপাদিত আনারস প্রতি বছরই কৃষকের গলার কাঁটা হয়েই রইল। আশির দশকে কালিয়াকৈরের হাঁটুভাঙা নদী পার হয়ে যখন মধুপুরের সাগরদিঘি বাজারে আনারসের চিত্র ধারণ করতে যেতাম তখন রাস্তার দুই পাশে কৃষকের উৎপাদিত আনারস স্তূপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখতাম, আজও তাই দেখি। ৪০ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ ২০০৯ সালে একবার মালয়েশিয়ার জহুরবারোইয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি খেত থেকে আনারস তুলে হাফ ডজনের একটি বাক্সে পুরে তা রপ্তানি হচ্ছে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে। হতভম্ব হয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে মর্মাহত হয়েছিলাম নিজ দেশের কৃষকের কথা ভেবে। গত বুধবার আমার অফিসে এসে উপস্থিত হলেন ছাদকৃষি অনুষ্ঠানের গাছের ডাক্তার খ্যাত বাংলাদেশ সরকারের বছরব্যাপী ফল চাষের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ। খয়েরি খাম থেকে বের করে আনলেন দুটি চিপসের প্যাকেট। বললেন, ‘আপনার জন্য উপহার। আপনি প্রায়ই দুঃখ করে বলেন, কৃষিপণ্যে ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে না, তাই আমরা পরীক্ষামূলক ফল-ফসল থেকে চিপস তৈরির একটা উদ্যোগ নিয়েছি। এটা আনারসের চিপস।’ শুনে আনন্দিত হলাম। প্যাকেট খুলে বিস্মিতও হলাম। সত্যি, আনারসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। মিষ্টি চিপস। চিপসের নাম আনানাস। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি প্রকল্প। ইতিহাস বলে, পনেরো শতকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কোনো এক পর্তুগিজ নাবিক প্রথম এ উপমহাদেশে নিয়ে আসে আনারস। তারা বলত আনানাস। তারপর আনানাস হয়ে ওঠে আমাদের আনারস। ক্রমেই টাঙ্গাইলের পাহাড়ি অঞ্চলে, সিলেট ও চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে আনারস হয়ে ওঠে অর্থকরী ফসল। এ ছাড়া এখন কুমিল্লা, নরসিংদী, মৌলভীবাজার, দিনাজপুরসহ দেশের নানা স্থানে আনারস চাষ হচ্ছে। সেই আশির দশক থেকে যতবারই আমি আনারস চাষিদের কাছে গিয়েছি, তাদের অভিযোগ ছিল আনারসের দাম না পাওয়া। তাদের দাবি, পাহাড়ি জমিতে আর কোনো ফসল হয় না বলেই বাধ্য হয়ে তারা আনারস চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সারা দেশে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। সেখানে উৎপাদিত হয়েছিল ৪৮৫ হাজার টন। উৎপাদন ভালো হলেও মূল্য কম পাওয়ায় চাষিরা লাভবান হতে পারছেন না। গত মাসেও এ বছরের কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের প্রথম পর্বে গোপালগঞ্জে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী কষ্ট নিয়ে বলছিলেন, ‘আমার বাড়ি টাঙ্গাইল, আমার বাবা কৃষক। তিনি আনারস চাষ করেন। কিন্তু আনারস সংরক্ষণের কোনো উপায় না থাকায় অনেক আনারস পচে নষ্ট হয়ে যায়, মৌসুমে আনারসের কোনো দাম পান না।’ কয়েকদিন আগে শুনেছিলাম আনারস থেকে জুস তৈরির একটি কারখানা নির্মাণ হচ্ছে। শুনে আশান্বিত হয়েছিলাম। আর এখন মেহেদী মাসুদ সাহেবের চিপস খেয়ে বেশ আনন্দিত হলাম। যদিও প্যাকেটটা আকর্ষণীয় হয়নি, তার পরও সূচনা তো হলো। সরকারের দেখাদেখি এখন বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন। আনারস চাষিদের নতুন দিন আসবে। এটি বড় আশার কথা। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগ, ধন্যবাদ মেহেদী মাসুদের নতুন এ উদ্যোগের জন্য। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রদর্শনী কেন্দ্র বর্তমানে প্রতিদিন ২০০ প্যাকেট আনারসের চিপস উৎপাদন করছে। তারা আশা করছেন অচিরেই দিনে ১ হাজার প্যাকেট চিপস উৎপাদন করতে পারবেন। কিন্তু এ উৎপাদন একেবারেই নগণ্য। সরকারের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের ইচ্ছাও নেই। বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এবার আরেকটি তথ্য দিই। ইন্টারনেট থেকেই পাওয়া। ভারত নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বছরে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের আনারস রপ্তানি করে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, মালদ্বীপের আনারসের বাজার পাশের দেশ ভারতের দখলে। আমরা কি বাইরের দেশের বাজারগুলোয় প্রবেশ করতে পারি না? ফল-ফসলের আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে ফল-ফসল উৎপাদন করা গেলে বিশ্বের যে কোনো বাজারেই আমরা প্রবেশ করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। এর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। এখন তো করোনার প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্বই বিপর্যস্ত। এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পর আমাদের উচিত হবে বিশ্ববাজারে অংশ নেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা ও দক্ষতা অর্জন। আমাদের দেশের মাটি যেমন উর্বর, তেমনই আছে জনসম্পদ। এ দুই সম্পদ কাজে লাগিয়ে কৃষিপণ্যকে শিল্পপণ্যে রূপান্তর করা গেলে টেকসই উন্নয়ন অভিযাত্রায় আমাদের অগ্রগতি হবে নিঃসন্দেহে। এ ব্যাপারে সরকারকে যেমন নীতিমালা তৈরি করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, অনুরূপ বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিভিত্তিক টেকসই অর্থনীতি বিনির্মাণে এর বিকল্প নেই।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর