শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

হিজড়াদের সম্পত্তি ও বিয়ের অধিকার!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

হিজড়াদের সম্পত্তি ও বিয়ের অধিকার!

হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক হিজড়া কে? বাংলা অভিধান ও গবেষকদের গবেষণামতে হিজড়া হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যিনি প্রকৃত অর্থে পুরুষ হলেও নারীর মতো আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ পছন্দ করেন অথবা যিনি মেডিকেল অপারেশনের মাধ্যমে তার লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন। শারীরিক গঠন অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট চার ধরনের হিজড়া দেখা যায়। ক. পুরুষ (তবে নারীর বেশে চলে) তাদের আকুয়া বলা হয়। এরা মেয়েদের বিয়ে করতে পারে। খ. নারী (নারীর বেশে চলে, তবে দাড়ি-গোঁফ আছে)। তাদের জেনানা বলা হয়। তারা ইচ্ছা করলে পুরুষকে বিয়ে করতে পারে। গ. লিঙ্গহীন (বেশে যাই হোক)। আরবিতে তাদের ‘খুনসায়ে মুশকিলা’ বলা হয়। এ শ্রেণির হিজড়া আসলে কারা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ঘ. কৃত্রিমভাবে যৌনক্ষমতা নষ্ট করে বানানো হিজড়া। তাদের খোঁজা বলা হয়। যৌন অক্ষমতার দরুন তারা বিয়ে করতে পারে না বা বিয়ের পিঁড়িতে বসতেও পারে না। উল্লিখিত চার ধরনের হিজড়ার মধ্যে আকুয়া ও জেনানাদের লিঙ্গ নির্ধারণ দৃশ্যত সম্ভব হলেও এদের অনেকের লিঙ্গ কাজের বেলায় অক্ষম কিংবা জননে ব্যর্থ। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিয়ে হারাম। হিজড়া কীভাবে নির্ধারিত হবে কিংবা তাদের সম্পত্তির শ্রেণিবিন্যাস প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। হজরত আলী (রা.) রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রসূত বাচ্চা পুরুষ-নারী নির্ধারণ করতে না পারলে তার বিধান কী- জিজ্ঞাসা করলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, ‘সে মিরাস পাবে যেভাবে প্রস্রাব করে।’ বায়হাকি, কানজুল উম্মাল, মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক। এবার আসল কথায় আসি। মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারিত্বের ক্ষেত্রে দুটি দিকনির্দেশনা লক্ষ্য করা যায় যেমন- ১. প্রতিবন্ধকতা ২. অপ্রতিবন্ধকতা। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বঞ্চিত ব্যক্তিরা হচ্ছে- ক. ক্রীতদাস খ. হত্যাকারী গ. ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ঘ. আঞ্চলিকভাবে বঞ্চিত ব্যক্তি বা সমাজ। এসব ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গের কোনো বর্ণনা নেই। পুরুষ ও স্ত্রীলোক ক্রীতদাস, হত্যাকারী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হতে পারে। অপ্রতিবন্ধকতা শ্রেণির উত্তরাধিকারী হচ্ছে- ক. অংশীদার খ. অবশিষ্ট ভোগী গ. দূরবর্তী জ্ঞাতি ঘ. অসম্পর্কিত উত্তরাধিকারী এবং ঙ. বিবিধ প্রকার উত্তরাধিকারী। তা ছাড়া মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সব সুস্বাস্থ্যের অধিকারীসহ শারীরিক অক্ষমতা, বিকলাঙ্গতা, অঙ্গহানি, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গকে উত্তরাধিকারত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবল মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে যৌন-অক্ষম ব্যক্তিকে বিয়ে করা নিষেধ বা নিবৃত্ত করা হয়েছে। যেসব হিজড়ার মধ্যে পুরুষালি স্বভাবের প্রাধান্য থাকে তাদের পুরুষ আর যাদের মধ্যে নারী স্বভাবের প্রাধান্য তাদের নারী হিসেবে বিবেচনা করে সম্পত্তি বণ্টনের বিধান দিয়েছে ইসলাম। আর যেসব হিজড়ার মধ্যে নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যই সমভাবে বিদ্যমান, তাদের নারী হিসেবে সম্পত্তি প্রদানের বিধান দিয়েছে ইসলাম। এখন দেখা যাক হিজড়াদের বিয়ের অধিকার। হিজড়াদের বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা নেই বলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে তাদের বিয়ে স্বীকৃত নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো এদেরও রয়েছে যৌন চাহিদা। সারা পৃথিবীতে সমকামী নিয়ে আন্দোলন চলছে, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে, চলতে থাকবে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা জন্তুর সহিত প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা যে কোনো বর্ণনার কারাদন্ডে- যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে- দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবে।’

২০০৯ সালে দিল্লি হাই কোর্টের দেওয়া এক রায়ে বলা হয়েছে- ‘৩৭৭ ধারা তার বর্তমান রূপে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।’ সেই রায়ে আরও বলা হয়- ‘অসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ আইন ব্যক্তির পূর্ণতার পথে অন্তরায়।’ এ রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে বেশকিছু সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের তরফ থেকে আবেদন করা হয়। দীর্ঘ শুনানির পর দিল্লি হাই কোর্টের সে রায় খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি জি এস সিংভি ও বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানায়, ‘৩৭৭ ধারা অনুযায়ী প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যে কোনোরকম যৌনসংসর্গই অপরাধ।’ আইনে আলাদা করে সমকামিতাকে বেআইনি বলা হয়নি। কিন্তু সংজ্ঞা অনুযায়ী সমকামীরা তার আওতায় পড়েন। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২ জুলাই দিল্লি হাই কোর্টে বিচারপতি এ পি শাহ ও বিচারপতি এস মুরলীধরের বেঞ্চ ঘোষণা করে, ‘যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় যে যৌন সম্পর্কে অংশ নেবেন, তাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা মানে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করা।’ দিল্লি হাই কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ‘সমকামিতা কোনো মানসিক রোগ নয়।’ ওই রায়ের ৩৭৭ ধারায় ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌনাচার অপরাধ হলেও সে তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দেওয়া হয়।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর