বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ স্পেন

আজিমউদ্দিন আহমেদ

ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ স্পেন। যে দেশটি ৭০০ বছরের বেশি সময় ধরে মুর মুসলমানদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। যারা এসেছিল আফ্রিকার মরক্কো থেকে। স্পেনের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত জিব্রাল্টার প্রণালির মাধ্যমে সহজেই স্পেন ও আফ্রিকার মধ্যে যাতায়াত সম্ভব। আইবেরীয় উপদ্বীপের বহু সমুদ্রবন্দর সমুদ্রগামী ভূমধ্যসাগরীয় লোকদের সেখানে নেমে প্রাকৃতিক সম্পদ খোঁজার সুযোগ করে দেয়। স্পেনের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত ইতিহাসেও সেখানে বিভিন্ন অভিবাসী জাতির বসতি স্থাপনের দীর্ঘ ধারা ও সাংস্কৃতিক মিলনের কথা লেখা আছে। প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে স্পেনে আইবেরীয় জাতির লোকেরা বাস করত। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে কেল্টীয় ও ফিনিশীয়রা এখানে বসতি স্থাপন করে। ফিনিশীয়রা আইবেরীয় উপদ্বীপকে স্পান অর্থাৎ লুকানো বা দূরবর্তী দেশ বলে ডাকত। সেখান থেকেই স্পেনের নাম হিস্পানিয়া হয়েছে। কেল্টীয় ও ফিনিশীয়দের পর এখানে গ্রিক, কার্থেজীয় ও সব শেষে রোমানদের পদার্পণ ঘটে। রোমানদের এ গোটা উপদ্বীপ দখল করতে প্রায় ২০০ বছর লেগে যায়; শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এসে তাদের স্পেন বিজয় সম্পূর্ণ হয়।

রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে স্পেনের অধিকাংশ মানুষ খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয় এবং লাতিন ভাষার বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষায় কথা বলা শুরু করে। রোমানদের পরে জার্মানীয় গোত্রের লোকেরাও উত্তর দিক থেকে পঞ্চম শতকে স্পেনে প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ভ্যানডাল গোত্রের লোকেরা স্পেন পার হয়ে আফ্রিকায় চলে যায় এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করে। অন্যদিকে ভিজিগথেরা স্পেনে থেকে যায় এবং স্পেনে নিজস্ব রাজ্য স্থাপন করে। ভিজিগথের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে অন্তঃকোন্দলের কারণে রাজত্বের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ৭১১ সালে স্পেন আবার বহিরাক্রমণের শিকার হয়। এবারে আফ্রিকার মরক্কো থেকে মুসলমানরা স্পেন আক্রমণ করে। মুসলমানরা বহু শতাব্দী ধরে আইবেরীয় উপদ্বীপের বেশির ভাগ অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। স্পেনের মুসলিম সংস্কৃতি দশম শতকে এসে উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। স্পেনের মুসলিম শাসকরা দেশটিতে নতুন শস্য প্রবর্তন করেন ও দক্ষ সেচ ব্যবস্থা চালু করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং গণিত, চিকিৎসা ও দর্শনের প্রসার ঘটে। দশম শতকের পর স্পেনে মুসলিম শাসনের অবনতি ঘটে। উত্তর স্পেনের খ্রিস্টান রাজ্যগুলো ইউরোপ মহাদেশ থেকে অভিবাসী গ্রহণ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে উপদ্বীপটি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৪৯২ সালে স্পেনের শেষ মুসলিম রাজ্য গ্রানাডা দখলের মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে। এ খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাসতিল, আরাগন ও পর্তুগাল। এর মধ্যে কাসতিল ছিল সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী। মধ্যযুগে এ কাসতিল রাজ্য ছিল ক্যাথলিক, কাসতিলীয়ভাষী স্পেনের প্রাণকেন্দ্র। পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ স্পেনে বিদেশিদের অভিবাসন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু মিলনস্থল হিসেবে স্পেনের গুরুত্ব বজায় থাকে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর ইউরোপের মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্যের মধ্যস্থল হিসেবে স্পেন একটি সুবিধাজনক অবস্থানে অবস্থিত ছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে স্পেনের অধীন নাবিকরা সমুদ্র অভিযানে বেরিয়ে পড়েন এবং আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন। তারা সেখানে প্রচুর রুপা আবিষ্কার করেন। আমেরিকা থেকে আনা রুপা ইউরোপের সম্প্রসারণশীল বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে স্পেনকে স্থাপন করে। একই সময় রাজবংশগুলোর মধ্যে বিয়ে ও কূটনীতির সুবাদে স্পেন এক বিরাট ইউরোপীয় সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপ মহাদেশে বিস্তৃত স্পেনের সাম্রাজ্য উনবিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত টিকে থাকে। ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) ও নেপোলিয়নীয় যুদ্ধগুলোর (১৭৯৯-১৮১৫) পর স্পেনের সাম্রাজ্য বিলীন হয়ে যায়। উনবিংশ শতকের পুরোটাই স্পেনীয়রা তাদের সরকারের গঠন ও রাজনীতিতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এ সময় স্পেন ধীরে ধীরে শিল্পবিপ্লবের অংশীদার হয় এবং সম্প্রসারণমান অর্থনীতি নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তির সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও একক কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। অনেক স্পেনীয় এ নৈরাজ্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে এবং এর ফলে তাও একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্পেনে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও আসলে একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে স্পেনের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমে সংঘর্ষ ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে জেনারেল মিগেল প্রিমো দে রিবেরা নিজেকে একনায়ক ঘোষণা করেন। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে দ্বিতীয় স্পেনীয় প্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র নিয়ে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কার সম্পন্ন হয়। কিন্তু ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের কারণে এসব চাপা পড়ে যায়। এ যুদ্ধের কারণে স্পেনে প্রায় ৫ লাখ লোক প্রাণ হারায়, দেশটির অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে, বহু লোক উদ্বাস্তু হয়। যুদ্ধ শেষে সামরিক জেনারেল ফ্রানসিস ফ্রাংকো একনায়ক হিসেবে পরবর্তী ৩৬ বছর স্পেন শাসন করেন। ১৯৭৫ সালে ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর স্পেন   আধুনিক, গণতান্ত্রিক, গতিশীল  একটি ইউরোপীয় জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায় এবং একটি ধনী, নগরায়িত, শিল্পোন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে একবিংশ শতক শুরু করে।

সর্বশেষ খবর