শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আক্রান্ত বিশ্ব : খাদ্য উৎপাদনে নজর রাখা জরুরি

শাইখ সিরাজ

করোনা আক্রান্ত বিশ্ব : খাদ্য উৎপাদনে নজর রাখা জরুরি

চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া নভেল করোনার তা-বে এখন বিপর্যস্ত ইউরোপ-আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্ব। এ ভাইরাসের কাছে উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত বা অনুন্নত রাষ্ট্র বলে কিছু নেই, সব রাষ্ট্রকেই প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলছে। পাশাপাশি বিশে^র অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকাকে দারুণভাবে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ, পাল্টে দিচ্ছে করোনা পরিস্থিতি।  মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা- পরিস্থিতি যেন ভালোর দিকে যায়। করোনা নিয়ে আমাদের আতঙ্কের শেষ নেই। আমরা যতটা আতঙ্কিত ততটা কি সতর্ক? সতর্ক বা সচেতন হওয়া ছাড়া করোনা প্রতিরোধের আর কোনো উপায় নেই। ২৬ মার্চ থেকে সরকার ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। আমরা দেখেছি ছুটি ঘোষণার পরপরই লঞ্চে, ট্রেনে, বাসে ভিড় করে লোকজন ঢাকা ছেড়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। সুসময়ে কিংবা দুঃসময়ে প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়া, তাদের কাছাকাছি থাকতে চাওয়াটা জাতি হিসেবে আমাদের মজ্জাগত। যদি লোকজনের এই ফিরে যাওয়াটা সুশৃঙ্খল হতো, গাদাগাদি করে না গিয়ে একটা সিস্টেম মেনে হতো তাহলে সবচেয়ে ভালো হতো। এখন আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে, আমরা নিজেরাই যেন স্বজনদের অসুস্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়াই। আমাদের অনেকের বাড়িতেই বয়স্ক বাবা-মা, দাদা-দাদি আছেন। আমরা জানি বয়স্ক লোকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, এ ছাড়া শরীরে নানারকমের অসুখ থাকে, ফলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া বয়স্ক কোনো ব্যক্তির জন্য ভয়ের ব্যাপার। আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারছি, বিশ^জুড়ে করোনায় প্রতিদিনই প্রায় হাজারের ওপর মানুষ মারা যাচ্ছে। যার অধিকাংশই বয়স্ক। ইতিমধ্যে আমাদের দেশেও আমরা বেশ কয়েকজনকে হারিয়েছি। তাই করোনার হাত থেকে সুরক্ষা পেতে, আমাদের স্বজনদের সুরক্ষিত রাখতে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। নিয়মিত হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির আদবকেতা মেনে চলা, নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ থেকে বিরত থাকাসহ বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে চলতে হবে। আর অবশ্যই সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে থাকতে হবে। মানুষ থেকে নির্দিষ্ট দূরে থাকতে হবে। আপনারা জানেন, গণমাধ্যম বন্ধ রাখার উপায় নেই, যে কোনো দুঃসময়ে গণমাধ্যমের কর্মীরা থাকেন ঝুঁকির কেন্দ্রে। তার পরও এ সময়টায় চ্যানেল আই যতটুকু সম্ভব সর্বনিম্ন হিউম্যানরিসোর্স দিয়ে পরিচালনা করছি আমরা। কর্মীদের বড় একটি অংশকে অল্টারনেট পদ্ধতিতে বাসায় রেখে, কাউকে কাউকে অনলাইনে অফিসের সঙ্গে যুক্ত রেখে একটা সিস্টেম তৈরি করে নিয়েছি। চ্যানেল আই নিউজের ক্ষেত্রেও আমরা একই পদ্ধতি অনুসরণ করছি। যারা অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে যাচ্ছেন, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়, তাদের জন্য সেইফটি গাউন, মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিশ্চিত করা হয়েছে। নিউজরুমের ডেস্কগুলোয় দূরত্ব বজায় রেখে বসা ও এডিট প্যানেলে কাজ করার সময় মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এড়াতে সবার জন্য অফিসের গাড়িতে বাসা থেকে আসা-যাওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। বিশ্ব মহামারীর এই সময়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি চিন্তা করা। ব্যক্তি হিসেবে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, গ্রামের মানুষ বিশেষ করে কৃষক কি করোনা বিষয়ে সচেতন? তারা কি জানেন কীভাবে প্রতিহত করতে হবে এ অদৃশ্য শত্রুকে? আমাদের দায়িত্ব গ্রামের মানুষগুলোকে সচেতন করে তোলা এবং খুব দ্রুতই। দেরি হয়ে গেলে মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের উচিত হবে গ্রামে থাকা স্বজনটিকে ফোনের মাধ্যমে এবং যারা গ্রামে গেছেন তারা যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আপনার স্বজনদের করোনা প্রতিরোধে করণীয়গুলো বুঝিয়ে দিই। মনে রাখতে হবে, করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর শেষ আঁকড়ে ধরার খাতটি হবে কৃষি।

আমাদের অর্থনীতির বড় একটি খাত রেমিট্যান্সসহ গার্মেন্ট ও রপ্তানি শিল্পে বড় ধরনের আঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ বর্তমানে সব দেশই সর্বশক্তি দিয়ে করোনাকে প্রতিহত করার যুদ্ধরত। আমাদের প্রবাসে যারা আছেন, তারা এই সময়ে নিজেদের অবস্থান নিয়ে বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে দেখা দিয়েছে অশনিসংকেত। ফলে বিশ^ অর্থনীতিতে মন্দার যে বড় রকমের ঝুঁকি আছে, তার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবেই পড়তে পারে। ইতিহাস বলে, যুদ্ধ বা মহামারী শেষে শুরু হয় ক্ষুধা নিবারণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আরেক যুদ্ধ। বেশি পেছনে নয়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ইবোলা ভাইরাসের প্রকোপে পশ্চিম আফ্রিকার গিনি, সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ায় মহামারীর কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। সেখানে ২০১৫ সালে মহামারী শেষ হলেও প্রচন্ড আকারে দেখা দেয় খাদ্যাভাব। তখন সারা বিশ্বের হয়ে বিশ^ব্যাংক তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলেও, এই সময়ে করোনার বিশ্ব মহামারীর তান্ডব শেষে প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজের ঘর সামলাতে হিমশিম খাবে। ফলে এখন থেকেই আমাদের কৃষি ও কৃষক নিয়ে ভাবতে হবে। যদিও জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ১০-১১ শতাংশ কিন্তু দুঃসময়ে কৃষিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পিলার।

আশার কথা হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, ‘কৃষক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, কোনো জমি ফেলে রাখবেন না। আরও বেশি বেশি ফসল ফলান।’ নিশ্চয়ই সরকারের কৃষি নিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে চীনের সিনহুয়া সংবাদ সংস্থার কোলাবেরেশন আছে। সিনহুয়ার বরাতে দেখেছি, চীনের উহান যখন করোনা প্রকোপে লকডাউন, অন্যান্য অঞ্চলেও জনগণের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তখন চীন সরকারের কৃষি বিভাগ কৃষকদের অনলাইনে দিকনির্দেশনা দিয়েছে, শুধু তাই নয়, কোন ফসলের চাষ কীভাবে করবে তারও প্রশিক্ষণ দিয়েছে মোবাইলে ভিডিওকলের মাধ্যমে। আমাদের অবশ্য ভিডিও কল বা অনলাইনে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু ফোনে কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা কঠিন কিছু নয়। সরকারের কৃষি বিভাগ চাইলে এই সময়ের ভিতর একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। আর কয়েক দিন পরই কৃষক ঘরে তুলবে বোরোর ফসল। এটিই উৎপাদনের দিকে আমাদের সবচেয়ে বড় ফসল। করোনার এই দুঃসময় প্রলম্বিত হলে এই ফসলের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা মাথায় রাখতে হবে। খুব সতর্কতার সঙ্গে সহজেই কৃষক যেন এ ফসল ঘরে তুলতে পারে সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক পর্যায়ে আবহাওয়াসংক্রান্ত খবরগুলো দ্রুত এবং কার্যত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরবর্তী ফসলের জন্য জমি তৈরি, বীজ, সার প্রভৃতির সুব্যবস্থাপনা এবং বিকল্প পন্থা এখনই ভেবে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কৃষি খাতের জন্যও এ ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি রাখার প্রয়োজন আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার যে সব সময় কৃষকের পাশে আছে এই মানসিক শক্তিটুকু নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষি উপকরণ সহজলভ্য, ভালোমানের বীজ, সার, সেচ ও প্রয়োজনীয় কৃষি পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে কৃষককেও তৈরি করে নিতে হবে বৈরী সময়ের যোদ্ধা হিসেবে। 

পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ^ মহামারীর মতো ভয়াবহ দুর্যোগের ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে। আরও আগে ১৮৯৪ সালে চীনের ক্যান্টনে প্লেগেই মারা যায় ৮০ হাজার মানুষ। আমরা এ অঞ্চলে কলেরা ও গুটিবসন্তে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে শুনেছি। আর বর্তমান সময়ে এসে মুখোমুখি হয়েছি করোনার মতো অদৃশ্য শত্রুর। মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের এই দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দান করবেন। সবাইকে অনুরোধ করব, ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিকতা মেনে চলার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মেনে চলবেন। অযথা খাদ্য ও ওষুধসামগ্রী মজুদ করে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলবেন না। এ সময়টায় অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না গিয়ে, ঘরে থেকে পরিবারকে সময় দিন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।

                লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

               [email protected]

সর্বশেষ খবর