রবিবার, ২৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাভাইরাস : ডাক্তার নার্স ও শৃঙ্খলা বাহিনীর সুরক্ষা জরুরি

এ কে এম শহীদুল হক

করোনাভাইরাস : ডাক্তার নার্স ও শৃঙ্খলা বাহিনীর সুরক্ষা জরুরি

করোনাভাইরাস এখন গোটা বিশ্বে আতঙ্ক। বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজারের বেশি। মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। ইতালি ও স্পেনে প্রতিদিন সাত-আট শ লোক মারা যাচ্ছে।  ইরানে প্রতিদিন শতাধিক লোকের মৃত্যু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্সেও আক্রান্ত ও মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। ধনী ও উন্নত দেশগুলোও করোনা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। কোনো কোনো দেশ লকডাউন ঘোষণা করে জনগণকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে করোনা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিদিন করোনা নিয়ে অনেক লেখা ও ভিডিওচিত্র গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। পত্রিকায় চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ও গুণীজনদের মূল্যবান লেখা, পরামর্শ ও মতামত প্রকাশ হচ্ছে। সামাজিক মিডিয়ার সব তথ্যই যে সঠিক বা গ্রহণযোগ্য তাও নয়। কিছু কিছু সঠিক হতেও পারে। আবার অনেক তথ্যই মনগড়া ও গুজবনির্ভর। পাঠক ও দর্শকদের বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক, বেঠিক বা গুজব শনাক্ত করে তা গ্রহণ করতে হবে। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া গেলে গুজব হ্রাস পেতে পারে। করোনা নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছা ছিল না। কারণ এত লেখার মধ্যে আমার লেখা হয়তো তেমন একটা গুরুত্ব পাবে না। আমি তো আর চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ নই। আবার ভাবলাম আমার লেখা যদি সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র-কর্তৃপক্ষ দয়া করে ছাপান তবে আমার ধারণা অন্তত কোনো পুলিশ সদস্য তা দেখলে হয়তো পড়তে চেষ্টা করবে। সেই ধারণা থেকেই এ লেখার অবতারণা।

অনেকের সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করি যে, করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রোগীর চিকিৎসা ও শুশ্রষা তারাই করবেন। তাদের যদি সুরক্ষা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকে তবে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে চাইবেন না। আমাদের দেশে চিকিৎসক ও নার্সদের গৌরবময় অতীত আছে। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি ক্রান্তিকালে মানবতার সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার পরও প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের জীবনকে অধিক ভালোবাসার প্রবণতা থাকে। এটাই বাস্তবতা। তাই ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক পোশাক ও সরঞ্জামের (personal protective equipment) পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। যারা অন্যের জীবন রক্ষার জন্য কাজ করবে তাদের সুরক্ষা ও কল্যাণের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার। সাধারণ মানুষের উচিত তাদের সঙ্গে সহযোগিতা ও সদ্ব্যবহার করা। আপৎকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঝুঁকিভাতা দেওয়ার বিষয়েও চিন্তা করা যায়।

এ ধরনের ক্রান্তিকালে প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ (motivation) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সুরক্ষা -সামগ্রী সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ, ব্রিফিং ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে চিকিৎসক ও নার্সদের মন থেকে করোনাভাইরাসের ভীতি দূর করা জরুরি। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জারিকৃত পরামর্শ, গাইডলাইন ও সতর্কতা মেনে চললে এবং সুরক্ষা পোশাকসামগ্রী ব্যববার করলে ভয়ের কিছু নেই। এভাবে অব্যাহতভাবে ব্রিফিং দিয়ে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে অবশ্যই ব্যক্তি সুরক্ষা সম্পর্কে আস্থা, বিশ্বাস ও সাহস জন্মাতে হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল দৃঢ় না থাকলে তারা ভয়ে তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করতে পারে। কেউ কেউ হয়তো কর্তব্যকর্মে অনুপস্থিতও থাকতে পারে। তাই প্রশিক্ষণ, ব্রিফিং এবং যেসব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে বা হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে আস্থা (confidence) সৃষ্টি করে তাদের মানবতার সেবায় নিজেদের আন্তরিকভাবে নিয়োজিত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে মানবজাতির এটা একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে যারা সাহসিকতা দেখাবেন, নিজের ও অন্যের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন অবশ্যই সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা তাদের অবদানের স্বীকৃতি ও পুরস্কার দেবে। তার চেয়ে বড় কথা, তারা নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করবেন। কারণ মানবজাতির এক ভয়ঙ্কর শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা বীরের বেশে বিজয়ী হবেন। গর্বে যেমন তাদের হৃদয় ভরে যাবে তেমনি দেশের মানুষও তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। মানবতার সেবায় কাজ করার চেয়ে মহান কিছু আর নেই। এটাই সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রণোদনার একমাত্র উপাদান হওয়া উচিত।

জাতির সব দুর্যোগ সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের সুরক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাধারণত ব্যারাকে একসঙ্গে বসবাস করে। আবার কর্তব্যে নিয়োজিত হলেও দলবদ্ধভাবে নিয়োজিত হয়। তাদের কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে ব্যারাক বা কর্তব্যস্থলের অন্য সহকর্মীদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিজের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রত্যেক সদস্যকে করোনার লক্ষণ, উপসর্গ ও প্রতিরোধসংক্রান্ত পরামর্শ ও সতর্কতা সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ, নিষেধ ও উপদেশ যা সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত হচ্ছে সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের অবহিত হতে হবে। এসব পরামর্শ ও সতর্কতার গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজের ও অন্যের সুরক্ষার জন্য তা মেনে চলতে হবে। ব্যারাক, বাসস্থান বা কর্মস্থলে কারও দেহে যদি করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে তাকে কালবিলম্ব না করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে এবং চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ভাইরাস অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অন্যের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। তাই এরূপ ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই বিন্দুমাত্র গাফিলতি করা যাবে না। সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে জরুরি ভিত্তিতে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে। করোনা টেস্ট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনা সন্দিগ্ধ প্রত্যেক অফিসার ও ফোর্সের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। ঊর্ধ্বতন অফিসাররা নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নেবেন।

শৃঙ্খলা বাহিনীর হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাস টেস্টের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত কিট (টেস্টের জন্য) সরবরাহ করতে হবে। দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। বাহিনীর প্রধানরা এর নিশ্চয়তাবিধান করবেন। শুধু বাহিনীর হাসপাতাল কেন? রাজধানী ও মফস্বলের সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল এবং প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করোনা টেস্টের সুবিধা থাকা প্রয়োজন। কেবল দু-একটি সংস্থাকে টেস্টের দায়িত্ব দিলে হয়তো তারা সামলাতে পারবে না। এখনই মানুষ সেবা পাচ্ছে না অভিযোগ করছে। টেস্টে করোনা পজিটিভ পেলে সংশ্লিষ্ট রোগীকে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা-প্রটোকল মোতাবেক চিকিৎসা করবেন।

সচেতনতা, প্রতিরোধের নিয়মাবলি অনুসরণ ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এটা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। রেজিমেন্টাল ফোর্সের ওপর কমান্ডারদের কমান্ড থাকে। সেকশন কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার, কোম্পানি কমান্ডার, ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তথা ইউনিট ইনচার্জ প্রত্যেকেই করোনাভাইরাস বিষয়ে অধিক নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববান হতে হবে। এ দুর্যোগের সময় তাদের ভূমিকা অনেক অনেক বেশি। নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা স্বভাবতই কম সচেতন থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে তারা উদাসীন। তাই প্রত্যেক লেভেলের কমান্ডার ও ইনচার্জকে তার অধীন সদস্যদের করোনাভাইরাসের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে বারবার ব্রিফিং দিতে হবে। পরামর্শ ও সতর্কতা প্রতিপালিত ও অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য তদারকি অফিসারদের সরেজমিনে করতে হবে। ব্যারাকের বাইরে যখন দলবদ্ধভাবে ডিউটিতে যায় তখন ইনচার্জ অফিসার ফোর্সের আচার-আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। ফোর্সের সচেতনতা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের জন্য ব্যারাক ও কর্তব্যস্থলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন সাবান, স্যানিটাইজার, টিস্যু পেপার, মাস্ক, জীবাণুনাশক স্প্রে ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজন হলে সদস্যরা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এসব জিনিসের কিছু কিছু নিজেদের সুরক্ষার জন্য কাছে রাখতে পারে। আবাসস্থল, ব্যবহৃত পোশাক, আসবাবপত্র, পরিবহন ইত্যাদি নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

হাসপাতালগুলোর বিশেষ করে পুলিশ হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ডাক্তার ও নার্সদের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজস্ব প্রত্যেক হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য আলাদা ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখতে হবে। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের জন্যও ব্যবস্থা এখনই করতে হবে। সেন্ট্রাল ও বিভাগীয় হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর ব্যবস্থা থাকাও একান্ত প্রয়োজন। ডাক্তার ও নার্সের স্বল্পতা থাকলে জরুরি ভিত্তিতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ দিতে হবে।

ফোর্সের রোলকল বা ব্রিফিং প্যারেডে হাসপাতালের ডাক্তাররা উপস্থিত থেকে ফোর্সের উদ্দেশে করোনা সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কমূলক বক্তব্য প্রদান করবেন। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মজুদ রাখা বাঞ্ছনীয়।

সরকারিভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করছে। কোয়ারেন্টাইনাইড স্থানে কর্তব্যরত আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্যদের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে অবস্থানরত ব্যক্তিদের অতি কাছে যাওয়া যাবে না। নিরাপদ দূরে থেকে ডিউটি করতে হবে। প্রয়োজনে মাস্ক পরতে হবে। সাবান/স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক স্প্রে সঙ্গে রাখতে হবে। হোম কোয়ারেন্টাইনের ব্যক্তিরা ঘরে থাকেন কিনা এবং শর্ত ও নির্দেশনা মোতাবেক চলেন কিনা তা দেখাশোনা বা তথ্য সংগ্রহ করার কাজটি নিষ্ঠা, সতর্কতা ও বিনয়ের সঙ্গে করতে হবে। গণসচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ত থাকার প্রয়োজন আছে।

                লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর