শুক্রবার, ৩ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

কাজী সালাহউদ্দীন

অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম ব্যক্তিত্বের প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রগাঢ় মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। যুদ্ধোত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ ভারতে মানবতার সেবায় ‘আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম’ সংস্থাটির মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। দেশভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ও দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ সংক্ষেপে এস এম মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মা আফজালুন নেছা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। বাবা সৈয়দ আবদুস সালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। একসময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯২৬ সালে রাজশাহী বিভাগে সব প্রার্থীর মধ্যে মাহবুব মোরশেদ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৩০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ অনার্স পাস করেন। পর্যায়ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এলএলবি উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন যান। সে সময় তিনিই একমাত্র ভারতীয় ছাত্র ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ সংকলনের প্রথম মুসলমান সম্পাদক ছিলেন তিনি। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। চল্লিশ দশকের প্রথমার্ধে লেখক হিসেবে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত ‘গার্ডেন’ পত্রিকায় বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বে তিনি বিশেষভাবে প্রশংসিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। ’৫৪ সালের নির্বাচনে  যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। একই বছর তিনি ঢাকা হাই কোর্টে বিচারক হিসেবে শপথ নেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার পরিচয় সর্বজনবিদিত। ’৫৪ সালের ২১ দফা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা যা ২১ দফারই সারাংশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঊনসত্তরে ছাত্রদের উত্থাপিত ১১ দফা দাবির প্রতিপাদ্য বিষয় যে একই সূত্রে গাঁথা, ইতিহাস বিশ্লেষকদের তাও দৃষ্টি এড়ায়নি। এসব দাবি প্রণয়নে তাঁর মেধা ও মননশীলতার কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ’৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান এ সম্পর্কে বলেন, ‘আজ হয়তো অনেকেই জানেন না, সেই উৎসব কী পরিমাণ বিপজ্জনক ছিল আমাদের পক্ষে।’ পাকিস্তানি প্রভুদের নাখোশ করে আমরা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিলাম সেদিন। বিচারপতি সৈয়দ মোরশেদ সেদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন মনে পড়ে। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান, স্টেজে তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন। সেই বক্তব্য ছিল কুৎসিতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনো মনে পড়ে তাঁর সেই ঋজু দীর্ঘ দন্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ। মনে হয় এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোকময় মন্ডপে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’। মূলত তিনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একজন নির্ভীক সৈনিক। ’৬৮ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক তথাকথিত মামলা দায়ের করা হয়। বিচারপতি মোরশেদ এর প্রতিবাদস্বরূপ প্রধান বিচারপতির পদ ত্যাগ করেন। সাধারণ মানুষের কাতারে নিজেকে শামিল করেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাঁর কৌঁসুলি হিসেবে প্রখ্যাত আইনবিদ স্যার উইলিয়ামস নিযুক্ত হন। স্যার উইলিয়ামসের সবচেয়ে নিকটতম সহচর ছিলেন বিচারপতি মোরশেদ। প্রথম সাক্ষাতে টমাস উইলিয়ামসকে বিচারপতি মোরশেদ বলেছিলেন, আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব। জবাবে উইলিয়ামস তাঁকে বলেছিলেন, একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি। টমাস উইলিয়ামস যত দিন ছিলেন তত দিন বিচারপতি মোরশেদকে বিচারপতি বলেই সম্বোধন করতেন।

বিচারপতি মোরশেদ তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য, প্রজ্ঞা ও মেধার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে মূল্য দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি একদিকে আইয়ুব খানের তথা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, পাশাপাশি এ দেশবাসীর অকুণ্ঠ সম্মান, শ্রদ্ধা  ও ভালোবাসা লাভ করেছিলেন। বিশেষত যাঁরা স্বাধীনতাকামী অর্থাৎ বাংলাদেশ নামের একটি স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন, মূলত তাঁদের জন্য সময়টি ছিল ক্রান্তিকাল। ঠিক সেই সময় নির্ভীকতা, ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিচারপতি মোরশেদ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। ফলে রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এবং সব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের মাঝে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হলেন। তার পরও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আইয়ুব সরকার আরেক স্বৈর সরকার ইয়াহিয়াকে বাঙালি নিধনের জন্য ক্ষমতা দিয়ে নিরুদ্দেশে চলে গেলেন। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের মতো প্রজ্ঞাময় আরও অনেক বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের এই দেশটিকে গড়ার পেছনে। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক তাঁদের পাশে অকুতোভয় লাখো সৈনিক মা-বোনের ইজ্জত, একসাগর শহীদের রক্তে স্নাত আমাদের স্বাধীনতা এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যাঁরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর সুচিন্তিত ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ পদ্ধতি আজ সর্বজনস্বীকৃত, এটি সত্তরের নির্বাচনের সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ শুধু একটি নাম নয়, ইতিহাসের কিংবদন্তি অবিস্মরণীয় নাম। নতুন প্রজন্মকে তাঁর সম্পর্কে জানার আহ্বান জানাই এ কারণে যে, তাঁকে জানলে ইতিহাস জানা যাবে, বাংলাদেশকে জানা যাবে। তিনি আমাদের বাতিঘর, অনুপ্রেরণার উৎস। এই মহান মানুষ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল এই সুন্দর সুশোভিত পৃথিবী ছেড়ে গেলেও বেঁচে আছেন হৃদয়ের হৃদয়ে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়।

লেখক : কবি, মহাসচিব : মোরশেদ স্মৃতি সংসদ।

সর্বশেষ খবর