শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু : আমাদের করণীয়

মো. আবুল কালাম আজাদ

করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু : আমাদের করণীয়

একেই বলে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’- করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু। সারা বিশ্ব করোনায় কার্যত বন্ধ। জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ করোনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। করোনা কোথায় গিয়ে থামবে কেউ বলতে পারে না। মানুষের মৃত্যু, বিশ্ব অর্থনীতি, বিশ^বাণিজ্য, দেশে দেশে সম্পর্ক, মানুষের চলন-বলন, সামাজিক রীতিনীতি- এগুলোয় কী পরিবর্তন আসবে অনেক ক্ষেত্রে ধারণা করাও কঠিন। বাংলাদেশের মানুষ গত আট-নয় দিন ঘরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে; বাইরে যাওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে। পত্রিকায় প্রকাশ, দেশে সামগ্রিকভাবে অপরাধ কমলেও নারীর প্রতি সহিংসতা গত কয়েক দিনে বেড়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা এর ভালো বিশ্লেষণ করতে পারবেন। বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রথম দেখা দেয় ২০০০ সালে এবং সেবার মারা যায় ৯৩ জন। পরবর্তী তিন বছরে এর প্রভাব কমে এক পর্যায়ে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এ দেশে আবার ডেঙ্গুর দেখা মেলে ২০১৮ সালে। সে বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন এবং মারা যায় ২৬ জন। গত বছর এর বিস্তার ছিল অনেক বেশি। ইতিপূর্বে ডেঙ্গু শুধু ঢাকা শহরে থাকলেও ২০১৯ সালে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা পত্রিকায় জেনেছি, ২০১৯-এ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৭৯ জনের। আমাদের কাছে একটি মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য না হলেও এটি হচ্ছে বাস্তবতা। তবে গত বছরের ডেঙ্গু আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়ালেও এর মূল ব্যাপ্তি ছিল ঢাকা শহরে।

আক্রান্ত হওয়ার পর কেউ কেউ ঢাকা ছেড়েছেন, আবার নানা ধরনের যানবাহনের সঙ্গে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন, পৌরসভাসমূহ সমি¥লিতভাবে গত বছর এটার মোকাবিলা করেছে। ডেঙ্গু মোকাবিলা অনেকটা চেনা পথ। কিন্তু নতুন কিছু চ্যালেঞ্জও আছে।

আমরা যদি গত বছরের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার সার্বিক চিত্র দেখি তবে এককথায় বলা যাবে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সরকারি কর্মচারী ও স্থানীয় প্রশাসন, সমাজকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, মসজিদের ইমাম সবাই একযোগে কাজ করেছেন।

আমরা জানি, পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়া এই মশা বাড়িতে, ঘরের বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানিতে, ঘরের বাইরের পরিষ্কার পানিতে বংশ বৃদ্ধি করে। গত বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ডেঙ্গুর সময় ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিল সার্বিক কাজের সমন্বয়ের জন্য। তার সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি করপোরেশন, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবী, স্কাউট সবাই মিলে ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ও এগিয়ে এসেছিল, কত দ্রুত নতুন এডিস মশা মারার রাসায়নিক দ্রব্য আনা যায় তার অনুমতি দেওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করে।

গত বছর এডিস দমনে চিকিৎসাধীন প্রধানমন্ত্রী লন্ডন থেকে সার্বিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ, ১৯৭১-এর ভাষণ ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ আমরা দেখেছি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশসহ সারা দেশের পুলিশ বাহিনী এগিয়ে এসেছে, নিজের কর্মস্থল পরিষ্কার করেছে, একই সঙ্গে অন্যকে পরামর্শ দিয়েছে। থানা, পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় মুক্ত আকাশের নিচে পরিত্যক্ত গাড়ি, রিকশা ও অন্যান্য জিনিস ছিল এডিসের ভালো বংশ বৃদ্ধির স্থান, যা পুলিশ উদ্যোগ নিয়ে ধ্বংস করেছে।

২.

দেশব্যাপী স্কাউটরা এডিসের বিরুদ্ধে নিরলস কাজ করেছে। এডিস কীভাবে ছড়ায়, বংশ বৃদ্ধি করে এবং ডেঙ্গু হলে কী করতে হবে তার প্রচার, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এডিসের বংশ বৃদ্ধির স্থানগুলো ধ্বংস করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি কাজ স্কাউটরা তাদের নেতা স্কাউট লিডার এবং অন্য শিক্ষকদের নেতৃত্বে করেছে। এ বিষয়ে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি সবাই কাজ করেছে। কাজের মধ্যে আনন্দ, স্কাউটরা ডেঙ্গুবিরোধী একটি স্রোগান তৈরি করেছে যা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে : ‘তিন দিনে একদিন/জমা পানি ফেলে দিন।’ পরিষ্কার পানি কোথাও তিন দিন জমে থাকলে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধিতে তা সহায়ক।

সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগ করেছে আসল কাজগুলো; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসেবা। এলাকা ভাগ করে চিরুনি অভিযানের মতো হয়েছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। দীর্ঘদিনের জমা ময়লা, দুই বাড়ির মাঝের স্থান, ড্রেন, বাড়ির প্রাঙ্গণে পরিত্যক্ত স্থান এসব জায়গায় পৌঁছে গেছে মেয়র আতিকুল ইসলাম ও সাঈদ খোকনের হাত। সব যে পরিষ্কার করা গেছে তা নয়, তবে চেষ্টা ছিল আন্তরিক। স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে চমৎকার একটা সমন্বয় গড়ে উঠে। ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তার ঠিকানা ধরে সিটি করপোরেশনের লোকজন চলে গেছেন তার বাসায়; সে বাসাকে কেন্দ্র করে, চারদিকের বাসায় চালিয়েছে এডিস নিধন অভিযান। এতে লক্ষ্যস্থল সহজে চিহ্নিত করে এডিসবিরোধী কার্যক্রম করা গেছে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ করতে, নিজেরাও যোগ দিয়েছেন। তাদের এ কার্যক্রম জনগণকে এডিসবিরোধী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। এতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হয়েছে, অংশগ্রহণ করেছে। মসজিদের ইমামরা ঢাকাসহ দেশব্যাপী জুমার নামাজসহ বিভিন্ন ওয়াক্তের নামাজে এডিসের সতর্কবাণী মুসল্লিদের জানিয়েছেন। তাদের কথাগুলো সর্বস্তরের মানুষ জেনে তা কাজে রূপ দিয়েছে।

এ কথাটি ঠিক যে, সর্বস্তরের মানুষকে শতভাগ উদ্বুদ্ধ করা যায়নি তবে এ বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া গেছে যে, এডিস পরিষ্কার পানিতে জন্মায়, তা আপনার ঘরে অধিকাংশ সময় হয়ে থাকে। কাজেই জমা পানি ফেলে দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনেকখানি কার্যকর হয়েছে।

স্থানীয় ও জাতীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে এডিসবিরোধী কার্যক্রমে নেমেছে। সচেতনতা, এডিস ধ্বংস করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব কাজ করেছে।

চমৎকার ছিল মিডিয়ার ভূমিকা, তাদের গঠনমূলক সমালোচনা, অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদন, মন্তব্য, মতামত এডিসবিরোধী কার্যক্রমকে করেছে বেগবান। রাজনৈতিক নেতারা, সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারী ও স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কাজ করেছে।

এ বছরের ডেঙ্গু অবশ্য কিছু নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে। ধারণা করা যায়, ডেঙ্গু তার ধরন কিছুটা পাল্টাবে। সংগত কারণ রয়েছে এটি ভাবার, চিকিৎসকরাও তেমনটি বলেছেন। আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো একই সঙ্গে চলছে করোনা। গত বছর যেমন সহজে এডিসবিধ্বংসী নতুন রাসায়নিক পদার্থ বাইরে থেকে আনা গেছে, এ বছর তেমনটি করা যাবে না হয়তো। চিকিৎসকরা বলেছেন, ডেঙ্গুর লক্ষণের সঙ্গে করোনার অনেকটা মিল আছে। কাজেই শনাক্তকরণে বেশ সমস্যা দেখা দেবে। এখন যেমন জ্বর, সর্দি, কাশি, গায়ে ব্যথা হলে অনেকে সন্দেহ করছেন করোনা হয়েছে কিনা। এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ও করোনার লক্ষণের পরিষ্কার ভিন্নতা শনাক্ত করা সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই দুরূহ হবে বলে ধারণা। গত বছর ডেঙ্গুর সময় রোজা ও ঈদ বাদে বাকি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। এ বছর করোনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সে জায়গাগুলো এডিসসহ সব মশার বংশবৃদ্ধির বড় আবাসস্থল হতে পারে।

৩.

সাধারণ ছুটির কারণে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় কর্মীর স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। গণপরিবহন চালু না থাকায় অনেক কর্মী তাদের কর্মস্থলে যেতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল করোনার কারণে বন্ধ করে দিয়েছে, যা চিকিৎসা সুবিধা কিছুটা হলেও কমিয়েছে।

এ চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি অনেক সুযোগও আমাদের আছে। ঢাকাসহ সারা দেশের প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে। রাজনৈতিক নেতারা ও সমাজকর্মীরা করোনার চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে কাজ করতে পারবেন। করোনার কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষত সিটি করপোরেশন এবং মিউনিসিপ্যালিটিগুলো বেশ কয়েক দিন যাবৎ ‘পরিচ্ছন্ন গ্রাম, পরিচ্ছন্ন শহর’ কর্মসূচির আওতায় জোরেশোরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধনের কাজ করছে। জনগণের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক সচেতনতা আগের চেয়ে বেশি। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ডেঙ্গুবিষয়ক করণীয় সম্পর্কে সবাইকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়া এখনই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুবিষয়ক করণীয় সম্পর্কে প্রচার শুরু করতে পারে। করোনা ও ডেঙ্গুর লক্ষণ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন যাতে মানুষ যথোপযুক্ত চিকিৎসাসেবার জন্য যেতে পারে। স্বাস্থ্য বিভাগ অনেক ডেঙ্গু ইউনিটকে করোনা ইউনিটে রূপান্তর করেছে মর্মে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে। কাজেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু ইউনিট আবার চালু করা জরুরি। করোনা, ডেঙ্গু, সাধারণ শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগের জন্য আলাদা হাসপাতাল চিহ্নিত করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। গত বছর ডেঙ্গুর জন্য যে চিকিৎসাব্যবস্থা দাঁড় করানো হয়েছিল তা ব্যবহার করতে পারলে ডেঙ্গু মোকাবিলা সহজ হবে।

সারা দেশে বৃষ্টিবাদল শুরু হওয়ার আগেই ২০০-এর অধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হলে এর প্রকোপ বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। কাজেই এখনই সময় ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, ডেঙ্গুর আবাসস্থল ধ্বংস করা। করোনা মোকাবিলায় আমাদের যে কার্যক্রম, গত বছরে ডেঙ্গু বিষয়ে যে অভিজ্ঞতা তা নিয়ে আমরা আগামীর পথ চলব- সবাই মিলে- একসঙ্গে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ স্কাউটস এবং সাবেক

মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) ও সাবেক মুখ্য সচিব,  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সর্বশেষ খবর