শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা আক্রান্ত বিশ্ব : কৃষির জন্য প্রয়োজন প্রণোদনা

শাইখ সিরাজ

করোনা আক্রান্ত বিশ্ব : কৃষির জন্য প্রয়োজন প্রণোদনা

করোনা আক্রান্ত বিশ^। পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার সূচনা থেকেই অনুশীলন করে আসছে মানুষের পাশে থাকার। আমরা আমাদের চর্চার ভিতর নিয়ে এসেছি মানুষকে কাছে রাখার, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার বিষয়গুলো। অথচ করোনা আতঙ্কে আজ আমরাই বলছি সোশ্যাল ডিসট্যান্স বা সামাজিক দূরত্বের কথা! হ্যাঁ। আমিও বলছি, মানুষ থেকে দূরে থাকুন, অন্তত তিন ফুট। তবে এ দূরত্বটুকু হোক শুধু শারীরিক। মানসিকভাবে আমরা যেন মানুষের আরও কাছাকাছি যাই। অন্যের প্রয়োজনটুকু যেন আমরা আরও বেশি করে অনুভব করি। মানুষ হিসেবে আমরা যেন সব সময় মানুষের পাশে থাকি আর সৃষ্টিকর্তাকে সব সময় স্মরণ করি।

এমনিতে আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তের কৃষকের মাঠে বা খামারে যাই। কিন্তু করোনার বিস্তার রোধে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাসায় আছি এ কটা দিন। আমার কাজটা আমার কাছে যতখানি পেশা, তার চেয়ে বেশি নেশা। যদিও বাসায় থেকে সর্বক্ষণ অফিসের সঙ্গে যুক্ত আছি ফোনে, ইন্টারনেটে। তার পরও কৃষকের মাঠে, কৃষকের কাছে যাওয়ার জন্য ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করছি। কৃষকের কাছে যেতে না পারার কারণে এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করছে। জানি এ সময়টায় সঙ্গনিরোধ সবচেয়ে জরুরি। আমিও হতে পারি অন্যজনের ক্ষতির কারণ। শুধু নিজের জন্য নয়, প্রিয়জনকে ভালো রাখতে, সুস্থ রাখতে করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অনুশীলনগুলো মেনে চলা প্রয়োজন। কিছু সময় পর পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আদবকেতা মেনে হাঁচি-কাশি দেওয়া, নাক-মুখ-চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকা, একটু পর পর অল্প করে পানি পান- এ অভ্যাসগুলো আত্তীকরণ এ মুহূর্তে খুব জরুরি।

যাই হোক, বলছিলাম কৃষকের মাঠে যেতে পারছি না, কিন্তু ফোনে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রয়েছে দেশের নানা প্রান্তের কৃষকের সঙ্গে। গত সন্ধ্যায় ভালুকার মাছ চাষি আশরাফ আলী ফোন করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। মাছ তোলার সময় হয়ে গেছে কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। কেউ মাছ নিচ্ছে না। এদিকে মাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার টাকার খাবার দিতে হচ্ছে।’ মাছের খাবারের পেছনে একজন খামারিকে খামারের আয়তন অনুযায়ী প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। করোনা আক্রান্তের এই সময়ে আশরাফের মতো অসংখ্য মাছ চাষি পড়েছেন চরম বিপাকে। একই সংকট পোলট্রি খামারিদেরও। সিলেটের কৃষক বদু মিয়া জানালেন, সবজি নিয়ে তিনি পড়েছেন মহাসংকটে। সবজি নষ্ট হচ্ছে, বিক্রি করতে পারছেন না। একদিন ডিসি অফিসে সবজি বিতরণ করছেন। গত শুক্রবার সবজি নিয়ে ঢাকার কারওয়ানবাজার এসেছিলেন। কিন্তু কেউ তার সবজি রাখল না। পথের মানুষের মাঝে বিতরণ করে ফিরে গেছেন। গাজীপুরের কৃষক দম্পতি দেলোয়ার ও শেলী ১০০ কেজি স্ট্রবেরি মেয়র আতিককে পাঠিয়েছেন। এই সময়ে আটকেপড়া অসহায় মানুষকে দেওয়ার জন্য, যেন তাদের ভিটামিন সির চাহিদা কিছুটা হলেও মেটে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কৃষি খাতের জন্যও এ ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি রাখার প্রয়োজন আছে। কৃষকের মাঠে এখন বোরোর ফসল। কোথাও কোথাও ২০-২৫ দিন পরই শুরু হবে ধান কাটা। এখন পর্যন্ত সব অঞ্চলের খবরই মোটামুটি ভালো। করোনার লকডাউনে সার-কীটনাশক বা সেচের উপকরণ পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কথা বলেছি প্রায় সব অঞ্চলের কৃষকের সঙ্গেই। শুধু নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল খালিয়াজুরীর কৃষকের কেউ কেউ বললেন, এ বছর বৃষ্টি হয়নি। ফলে সেচ না দিতে পারায় কিছু ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ওই অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনিও জানালেন, সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি এ অঞ্চলে বৃষ্টি হয়। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ধানের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। আপনারা জানেন হাওরাঞ্চলে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়। তাই হাওরের অন্যান্য অঞ্চলের খবর নিলাম। আশার কথা, অন্যান্য অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে, ফলন ভালো। চ্যানেল আইয়ের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানালেন, আর সপ্তাহ দুয়েক পরই হাওরের ধান কাটা শুরু হবে। আমি ভাবছি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। কারণ আপনারা জানেন, হাওরে ধান কাটার সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে কৃষিশ্রমিকরা আসেন। শুধু হাওরেই নয়, ধান কাটার সময় কৃষিশ্রমিকরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গিয়ে শ্রম বিক্রি করেন। হাওরে এ ব্যাপারটি ঘটে বেশি। এ সময়টায় কৃষক মাঠে কীভাবে তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করবেন সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মাঠে যারা ধান কাটতে যাবেন, তারা যেন পরস্পর থেকে দু-তিন হাত দূরে অবস্থান করেন। কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখটা ভালো করে ঢেকে নেন। কৃষিশ্রমিকদের স্বাস্থ্যসচেতনতার দিকেও নজর রাখতে হবে। আল্লাহ না করুন, দেশের করোনা পরিস্থিতি যদি মন্দের দিকে যায় তাহলে হাওরে কৃষিশ্রমিকের সংকট দেখা দেবে। এমনিতে হাওরের ফসল তোলার সময়টা থাকে কম। কারণ, পাহাড়ি ঢলে নিমিষেই তলিয়ে যায় ফসলের জমিন। এ বিষয়টা মাথায় রেখে সরকারের কৃষি বিভাগকে আগেই সতর্ক অবস্থান নিতে হবে। চীনে করোনার কারণে লকডাউনে কৃষিতে বৈরী প্রভাব নিয়ে ফিন্যানশিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদনে পড়লাম। বেইজিং থেকে সান ইউ লিখেছেন, চীনের কৃষিতে সাধারণত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কাজ করতে যাওয়া (মাইগ্র্যান্ট) কৃষিশ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। লকডাউন বা যাতায়াত নিষেধাজ্ঞার কারণে এক অঞ্চল থেকে কৃষিশ্রমিক ও কৃষি উপকরণ না পাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কুফু নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপের কথা উল্লেখ করেছেন সান ইউ। সে জরিপে ১ হাজার ৬৩৬ কাউন্টির গ্রাম দফতরের ৬০ শতাংশই বলেছেন প্রত্যাশিত ক্ষতির চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষিতে। চীনের মতো যন্ত্রনির্ভর কৃষির দেশই যখন শ্রমিক সংকটে পড়ে, তখন আমাদের এ বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। করোনা সংকট কত দিন স্থায়ী হবে, কী পরিমাণ ক্ষতির কারণ হবে কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না বলে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের কথা ভাবছে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনায় ফুড সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় সৃষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা একটা গাইডলাইন দিয়েছে। সমস্যা মোকাবিলায় এ গাইডলাইন আমাদের সহায়ক হলেও স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট সমস্যা ও সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে কী করণীয় তা আমাদের আগেই স্থির করে নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে কৃষি নিয়ে পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। করোনা আক্রান্ত সময়ের কৃষি পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চয়ই তাঁর বিশদ পরিকল্পনা রয়েছে।

এ সময়টা অন্যসব সময়ের থেকে একেবারেই অন্যরকম এবং সময়ও খুব কম। তাই সব ধরনের পরিকল্পনা ও  প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হবে। বাংলাদেশের কৃষককে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। কৃষক তাদের ফসলের মাঠে নানান জাতের ফসল করেন। অনেক কৃষকই আর ধান-পাটে সীমাবদ্ধ নেই। আমার বিশ্বাস, কৃষককে যদি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও উপকরণ দেওয়া যায় ভালো উৎপাদনের জন্য সর্বোচ্চ শ্রমের ঘাটতি হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কৃষকের আবাদ বাড়াতে। আমরা যদি কৃষক ও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তাহলে প্রতিটি বাড়ির আঙিনা থেকে ফসলের মাঠ সব ভরিয়ে তুলতে পারি ফল-ফসলে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সুপরিকল্পিত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি কৃষি সহযোগী সংগঠনগুলোকে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এবারও চীনের উদাহরণই আনছি। করোনা পরিস্থিতিতে কৃষিশ্রমিকের সংকট সমাধানে এগিয়ে এসেছে কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো। চীনের একটি সংবাদ সংস্থার বরাতে পেয়েছি কীটনাশক, সার প্রয়োগের জন্য ড্রোনের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য কৃষিযন্ত্রের। আমাদের হয়তো এই মুহূর্তে যান্ত্রিক কৃষির আকস্মিক সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। তবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। প্রয়োজন অনুযায়ী দেশীয় পদ্ধতিতে কৃষিযন্ত্র প্রস্তুতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

বোরো আমাদের সবচেয়ে বড় ফসল। বোরো ফসলের পর আউশের চাষ। আমাদের আউশের চাষ তুলনামূলক কম। এর চাষ বাড়াতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষকের কাছে বেশি পরিমাণ আউশের বীজ আছে কিনা। ধান ছাড়াও সবজি বা ফলের চাষ বাড়াতে হবে। এই সময়টায় কৃষক কোন জমিতে কী ধরনের ফসল করতে পারে এ বিষয়ে কৃষককে সচেতন ও পরামর্শ প্রদান করতে হবে। সরকারিভাবে আগেই একটা অ্যাসেসমেন্ট করা যেতে পারে এবং কৃষককে সেভাবে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। ভালো বীজ, সার, সেচ ও বালাইদমন ব্যবস্থাপনা কৃষকের এ চার চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের পারস্পরিক যোগাযোগ বলা চলে একরকম বন্ধই। বন্ধ বিশে^র অনেক দেশের কলকারখানা। কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সারের সংকট হতে পারে কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। এ সংকটের কথা মাথায় রেখে কৃষককে এখনই প্রস্তুত করতে হবে জৈবসার তৈরির বিষয়টিতে। কৃষককে সচেতন করতে স্বাস্থ্য ও কৃষি তথ্য কৃষকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে সমন্বিত ভূমিকা রাখতে পারে  সরকারের কৃষি বিভাগ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এবং উন্নয়ন সংস্থার কর্মীবৃন্দ। সরকারের কৃষি বিভাগ, কৃষি সহযোগী উন্নয়ন সংস্থা, কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও গণমাধ্যম- আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠব ইনশা আল্লাহ। আর আমরা যদি প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গা থেকে চেষ্টা করি, দেশের জন্য দশের জন্য কাজ করি তবে এ করোনা আক্রান্ত সময়কেও জয় করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

 

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর