শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মহামারীতে ঘরে থাকা রসুলের সুন্নত

এম এ মান্নান

মহামারীতে ঘরে থাকা রসুলের সুন্নত

করোনাভাইরাস মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী হিসেবে আবির্ভূত। দুনিয়ার ২০০ দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। আক্রান্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যাও বিশাল। এ কথা ঠিক, অতীতে দুনিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহামারীতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু কোনো মহামারী দুনিয়াজুড়ে থাবা বিস্তার করতে পারেনি। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষের পাপ বা অন্যায়ের কারণে মহামারীর মতো বালা-মুসিবতের আবির্ভাব ঘটে। এ সময় আল্লাহর কাছে নিজেদের গুনা তথা ভুলের জন্য বেশি বেশি করে মাফ চাইতে হবে। শুদ্ধজীবন যাপনের শপথ নিতে হবে। মহামারীর সময় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৪০০ বছর পর আধুনিক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা ঘরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনা অনুযায়ীই সরকার ১৭ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সবাইকে ঘরে থাকার তাগিদ দিয়েছে। মহামারীর সময় ঘরে থাকা যেহেতু রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত সেহেতু এ নির্দেশনা পালনের মাধ্যমে তাঁর প্রেমের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, জিম্বাবুয়ের কাউন্সিল অব ইসলামিক স্কলার্সের ফতোয়া বিভাগের প্রধান মুফতি ইসমাইল মেনক গত ২৭ মার্চ শুক্রবার জুমার খুতবায় মহামারীর সময় ঘরে থাকার বিষয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, বিপদের সময় ইত্তাকুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস জোরদার করতে হবে। করোনাভাইরাসে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, আবার অনেকে সুস্থ হয়ে ঘরেও ফিরছেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ১৪০০ বছর আগে এ ব্যাপারে বলে গেছেন, মহামারীর সময় নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে হবে। তাকিয়ে দেখুন চারপাশে সমাজের ধনী-গরিব আজকে একই কথা বলছে- ‘সচেতন থাকুন, ঘরে থাকুন’। ক্ষমতাবান, দুর্বল, সব ধর্মের মানুষ আজ একই কথা বলছে- ঘরে থাকুন।

মুফতি মেনক আয়শা (রা.)-এর সূত্রে বুখারির একটি হাদিস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যেখানে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি তুমি সতর্কতার জন্য বাড়িতে অবস্থান কর এবং ধৈর্য ধর, তবে আল্লাহ অবশ্যই সেজন্য পুরস্কৃত করবেন।’ এখানে ধৈর্যধারণের কথা বলা হয়েছে। কারণ, মানুষ কাজ ছাড়া বাড়িতে অবস্থান করতে চায় না। কাজ ছাড়া বাড়িতে বসে থাকা কঠিন। কিন্তু মহামারী রুখতে বাড়িতে অবস্থান করলে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘অসুস্থ অবস্থায় কেউ কর্মক্ষেত্রে যাবে না। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আক্রান্ত জায়গায় গেলে সেখানে অবস্থান করতে হবে। কেউ আক্রান্ত এলাকার বাইরে আসবে না অথবা বাইরে থেকে কেউ আক্রান্ত জায়গায় যাবে না।’ মুফতি মেনক সবাইকে লকডাউন মেনে নিজেকে ঘরে আবদ্ধ রাখার ও আইসোলেশন অবস্থায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, নিজের জন্য যা ভালো তা করাও এক ধরনের ইবাদত। তবে অলস সময় পার করবেন না; যা ভালো তাই করুন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনা মেনে চলাও সুন্নত। তাই সবাই যে ধর্মের বা যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, বাড়িতে অবস্থান করা উচিত। আরও একটি বিষয়ে তিনি মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বলেছেন, ‘একজন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কীভাবে রক্ষা পাব রোগ, শোক, দুর্যোগ থেকে? তিনি তিনটি কথা বলেছেন। প্রথমত মুখের কথাকে সংযত রাখতে হবে। তুমি কী বলছ তা নিয়ে সচেতন থাক।’ আমাদের তাই সচেতন থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো তথ্য শেয়ারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকা জরুরি। ভুল তথ্য ছড়ানো থেকেও বিরত থাকতে হবে। অশ্লীল বাক্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। নিজের জিব সংযত করতে হবে। মানুষ তার মোবাইল ফোন খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। ভুলে যাবেন না আমাদের একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ সবাইকে দেখছেন। আল্লাহকে নারাজ করবেন না। দ্বিতীয়ত, ‘বাড়িতে থাক এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও।’

তৃতীয়ত, ‘আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ। নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ ঘরে বসে থাকা সময় জ্ঞানচর্চায় ব্যবহার করা উচিত। যারা বিপদগ্রস্ত তাদের জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ এ ভাইরাস থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আতঙ্কিত হবেন না। তবে পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিন। স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলুন। নিজেকে রক্ষা করাও ইবাদতের সমান। আজ সব ক্ষমতাবান জাতি বিপদগ্রস্ত। তাই মহাক্ষমতাবান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখুন। মুফতি ইসমাইল মেনক জুমার খুতবায় যে আহ্বান জানিয়েছেন তা আমাদের দেশের মুসল্লিদের জন্যও অনুসরণীয়। করোনাভাইরাস মহামারীর এই দিনে নিজে বাঁচা এবং অন্যকে বাঁচাতে অবদান রাখতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবশেষে বলব, আমরা যেন শয়তানের ধোঁকায় না পড়ি। গুজব না ছড়াই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুজব সৃষ্টির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধরে আসে এবং মিথ্যা কথা (গুজব) শোনায়। অতঃপর লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ বলে, আমি এমন এক ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনেছি যার চেহারা চিনি, কিন্তু নাম জানি না।’ মুসলিম থেকে মিশকাতে।

                লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর