রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার আগ্রাসন : সতর্ক না হলে বিপদ বাড়বে

তপন কুমার ঘোষ

করোনার আগ্রাসন : সতর্ক না হলে বিপদ বাড়বে

বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘করোনা’। করোনার আঁতুড়ঘর চীন। চীন থেকে ক্রমে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। বাদ যায়নি কোনো উন্নত দেশই। করোনা আতঙ্কে তটস্থ বিশ্ববাসী। থমকে গেছে জীবন। তামাম দুনিয়া আজ অচল-স্তব্ধ। এ মুহূর্তে করোনা অপরাজেয়। বিশ্ব শাসন করছে। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র। করোনা ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মানে না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দর্প চূর্ণ। মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইউরোপের ইতালিতে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ বলতে পারছে না। ভয়ের প্রহর গুনছে সবাই। বিশ্বজুড়ে এমন ভয়াবহ অবস্থা বোধহয় মানব ইতিহাসে আর কখনো আসেনি। করোনা আতঙ্ক মানবসমাজকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৪ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। মোট মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পারদের মতো বাড়ছে। এদিকে, সরকারি হিসাবমতে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ জন। আক্রান্তের মধ্যে মোট আটজনের মৃত্যু হয়েছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩০ জন। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ‘নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে’ রয়েছে- এ কথা জানিয়ে সবাইকে ঘরে থাকা ও নিজের সুরক্ষায় নজর দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৩১ মার্চ এক ভিডিও কনফারেন্সে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ পরামর্শ দেন। করোনা প্রতিরোধে যেসব নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে তা মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি। এখনো অবধি আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম হলেও আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। সতর্ক না হলে বিপদ বাড়তে পারে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে খবর আসছে, নগরে কড়াকড়ি হলেও গ্রামে-গঞ্জে উৎসবের আমেজে দিন কাটাচ্ছে অনেকে। অযথা এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। শহরের অলিগলিতেও বহু মানুষকে অকারণে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। এমন নয় যে, ঘরে থাকার বার্তা এদের কানে পৌঁছায়নি। এদের একাংশের মধ্যে ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাব। স্পষ্টতই, সচেতনতার অভাব। সচেতনতা বাড়াতে প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদা তৎপর। অবিরত সাবধানবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। অনেকে অবশ্য একান্ত প্রয়োজনে বা অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করতে ঘরের বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমজীবী মানুষ যারা ‘দিন আনে দিন খায়’ তারা বের হচ্ছে পেটের দায়ে। সবকিছু বন্ধ। ‘কামাই’ নেই। তাদের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। অভুক্ত অবস্থায় ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে যদি কোনো কাজ জোটে এ আশায়। দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্র সেই হতদরিদ্রদের ভিক্ষাও জুটছে না। ত্রাণের অপেক্ষায় অভাবী মানুষ রাস্তার পাশে বসে থাকছে। কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে না দিলে এদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। ঘরে ঘরে ত্রাণ বিতরণ এখন শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিসংক্রামক রোগ করোনা। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। করোনার বিস্তার ঘটে জ্যামিতিক হারে। চারজন থেকে আক্রান্ত হবেন ১৬ জন। সেই ১৬ জন থেকে ৬৪ জন। তারপর ২৫৬ জন। এভাবেই ক্রমান্বয়ে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। এ রোগের কোনো দাওয়াই বা প্রতিষেধক আজ অবধি উদ্ভাবিত হয়নি। করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব (শারীরিক দূরত্ব) বজায় রাখা আপাতত সমাধান বলে চিকিৎসকরা বলছেন। সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলতে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা নয়। সামাজিক স্তরে মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারস্পরিক নিরাপদ দূরত্ব হতে হবে কমপক্ষে ১ মিটার বা ৩ ফুট। বারবার কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ঘরদোর ও আশপাশ পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। বাইরে বেরোলে মাস্ক পরতে হবে। সোজা কথায়, করোনা থেকে রেহাই পেতে ‘শুচিবাইগ্রস্ত’ না হয়ে উপায় নেই। সতর্ক না হলে আমরা যে কেউ যে কোনো সময় করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। অদৃষ্টের ওপর সবকিছু ছেড়ে না দিয়ে সাবধান হতে হবে। প্রশাসনের নির্দেশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা আমাদের সবার অবশ্য কর্তব্য। এই মেনে চলা বা না-চলার সঙ্গে আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। শুরুর দিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র এখন পস্তাচ্ছে, এ কথা অনেকেই বলছেন। এখন সংক্রমণ এড়াতে মরিয়া সব দেশ। নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে করোনার আগ্রাসন ঠেকানো কঠিন হবে। সামান্য ভুলের পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা কি আমাদের উপলব্ধিতে আছে? আপনার-আমার একটু অসতর্কতার সুযোগে করোনা কেড়ে নিতে পারে হাজারো প্রাণ। এখন ছিদ্রান্বেষণ নয়। এখন শুধুই করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। গোটা বিশ্ব আজ অভিন্ন শত্রু করোনার বিরুদ্ধে একযোগে লড়ছে। এ লড়াইয়ে আমরা জয়ী হব। করোনা একদিন বশ্যতা স্বীকার করবেই। করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবারও শুরু হবে মানুষের অবাধ বিচরণ।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর