সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার ভয়াবহতা এবং করণীয়

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

করোনার ভয়াবহতা এবং করণীয়

পারমাণবিক বোমার প্রয়োগ, আন্তদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, তীব্রগতির বোমারু বিমানের হামলা এবং উর্দিওয়ালাদের তান্ডব  ছাড়াই করোনাভাইরাস তীব্র বেগে ধাবমান বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানব জাতির বিচ্ছিন্নতার বেদিতে উঠতে বাধ্য করেছে। মহাকাশ দখলে নেওয়ার প্রতিযোগীরা কেউ অনুমান করতে পারেনি এ ভাইরাস বিশ্বে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এটি এমন এক সংক্রমণ যা শ্রেণি রাষ্ট্র জাতি ধর্ম সবাইকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। উন্নত আর অনুন্নত বিশ্বের সীমারেখা মুছে দিয়েছে। দেশে দেশে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে  রাজনৈতিক গতিশীলতায় ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু সবাইকে ব্যর্থ করে দিয়ে সমানে ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার।

প্রযুক্তির প্রচ- দাপট আর বেসামাল সম্পদের বিশ্ব যে এমন অসহায় এবং গভীরভাবে বিপর্যস্ত হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি। সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউন রোগের বিস্তৃতি রোধের সাময়িক ব্যবস্থা কিন্তু স্থায়ী সমাধান নয়। ক্রমবর্ধমান করোনা সংকটে বিপর্যস্ত বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ অন্তরাত্মা দিয়ে তাকিয়ে আছে ভাইরাস প্রতিরোধক টিকার দিকে। বিশ্বের মেধাবী বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নে নিজেদের মেধা নিয়োজিত করেছে। অচিরেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কৃত  হবে ইনশা আল্লাহ। যে করোনা কোনো করুণা না করেই অসংখ্য মানবপ্রাণ পৃথিবী থেকে বিলোপ করে দিল সেই করোনাভাইরাসেরও একদিন বিলুপ্তি ঘটবে, সেদিন খুব দূরে নয়।

কিন্তু করোনা আমাদের আত্মম্ভরী চেতনা, অসমতাভিত্তিক উন্নয়নের দানবিক মাত্রা এবং ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে প্রচন্ড সংকটে ফেলে দিয়েছে, আবেগ এবং বিশ্বাসে চরম আঘাত হেনেছে।

উন্নয়নের নামে প্রকৃতি নিধন, কর্তন ও দূষণ করা, লক্ষ কোটি মানুষের সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে সমাজকে বৈষম্যমূলক সমাজে রূপান্তর করার আত্মঘাতী ব্যবস্থা এবং প্রচ- শক্তিমত্তার আত্মম্ভরিতা বিশ্ব ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে।

আমরা উন্নয়নের মহাসড়ক, ডাবল ডিজিটের জিডিপির স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি, কিন্তু একটি ভাইরাস থেকে বাঁচানোর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করেই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি, এ নিয়েও মূল্যায়নের সময় এসেছে।

আমরা যদি এ সংকটের মূল সত্যকে আড়াল করে রাখি তাহলে ভবিষ্যৎ ধ্বংসের বীজ আপনা আপনিই রোপিত হয়ে যাবে।

সাম্যবিহীন সমাজ মানুষের আত্মমর্যাদার জন্য অভিশাপ। সুষম সমাজ ছাড়া মানুষ সত্য ও সুন্দরের রূপকার হতে পারে না। সাম্য ছাড়া শোষণ নিপীড়নে মানুষ জান্তব হয়ে ওঠে। সমাজ মানবিকীকরণ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।

আমরা যা নই তা হওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত হয়ে সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হবে। করোনা সারা বিশ্বকে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতাকে আমাদের সামনে হাজির করেছে।

অসম ও অমানবিক সমাজ ব্যবস্থার উন্মেষ সমগ্র মানব সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছু মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন এ চূড়ান্ত অহমিকা অসার প্রমাণিত হয়েছে। ছোট্ট ভূখন্ডে কেউ নিরন্ন হাহাকারে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে আবার কেউ বিত্তবৈভব প্রাচুর্যভারে ভূস্বর্গ স্থাপন করবে তার বাস্তবতা আজ অপসৃত। অতি সম্পদ অতি বিলাসিতা জীবনের রক্ষাকবচ নয় তাও প্রমাণিত।

পরাক্রমশালী যে রাষ্ট্রব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি তা কেবল  প্রকৃতিকে নির্মম করেছে মহামারী আর বিপর্যয়কে সংবর্ধিত করেছে।

এখন আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে অগ্রসরমান প্রগাঢ় মানবিক একটি সমাজব্যবস্থা। বিশ্বজুড়ে সাম্য, মানবিক ও প্রকৃতিবান্ধব সমাজ বিনির্মাণের দর্শন গ্রহণ এবং এ দর্শন সংজ্ঞায়িত করাই করোনার বাস্তব শিক্ষা। এ নতুন মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলে মনুষ্যত্বের পরিচয় তুলে ধরাই হোক এখনকার সংগ্রাম।

মানুষের ব্যাপক জীবনবোধ ও বিশ্ববোধের মহামন্ত্রদ্রষ্টা গ্যেটে বলেছেন, ‘যা শ্রেষ্ঠ তার সমাদর যে যুগে নেই তা ভিন্ন বর্বর যুগ আর কী’?

                লেখক : গীতিকবি।

সর্বশেষ খবর