মঙ্গলবার, ৭ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রশাসন ও প্রবাসফেরতদের কাছে খোলা চিঠি

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

প্রশাসন ও প্রবাসফেরতদের কাছে খোলা চিঠি

প্রিয় পাঠক! যখন এ লেখাটি পড়ছেন তখন দেশ-বিদেশে মহামারী করোনা পরিস্থিতি কোন আকার ধারণ করেছে বা করবে, তা কল্পনা করার যথাযথ শক্তি সম্ভবত কারও নেই। তবে অভিজ্ঞতা আর গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের ভিত্তিতে অনুমান করা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতিও কমবেশি অবনতির দিকে। এর নেপথ্যে সরকার, প্রবাসফেরত বাংলাদেশি এবং সাধারণ মানুষ কার কী দায় বা কতটুকু দায়, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কিংবা দোষারোপের সময় এখন নয়। এখন সত্য অনুধাবন করে সুন্দরের পথে এগিয়ে যাওয়াই সবার এক ও অভিন্ন লক্ষ্য হওয়া উচিত।

জীবনের একটা দীর্ঘ সময় প্রবাসে ছিলাম। প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ নিয়ে গবেষণা করেছি এবং প্রচারমাধ্যমে তা তুলে ধরেছি এবং আজীবন প্রবাসীদের জন্য কাজ করে যেতে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই এ দুর্যোগের সময় প্রবাসীদের নিয়ে অনুদার মন্তব্য মেনে নিতে কষ্ট হয়। বাস্তব অবস্থা বোঝার জন্য ইতালিপ্রবাসী এক বাংলাদেশির সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া মন্তব্য পড়ছিলাম। তার মতে, আজ বাংলাদেশে যে অবস্থা, মাত্র কদিন আগেও ইতালিতে একই অবস্থা বিরাজ করছিল। ইতালির কেউ ভাবতেও পারেনি যে মাত্র অল্প কদিনের ব্যবধানে অবস্থার এত অবনতি হবে। তাই এই প্রবাসী ও প্রবাসে থাকা প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি যেমন উদ্বিগ্ন দেশে থাকা নিকটাত্মীয়দের জন্য, তেমনি দেশে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশিও উদ্বিগ্ন প্রবাসে থাকা প্রিয় মানুষটির জন্য। সংবাদ সম্মেলন আর সংবাদমাধ্যমে যা দাবি করা হচ্ছে, বাস্তব অবস্থা সরকারের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভিন্ন। আর আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে তার মাত্রা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা যায়। পরিস্থিতি রাজধানী ঢাকায় একরকম, আর মফস্বলে অন্যরকম। মফস্বলে করোনা পরীক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিনিয়ত খবর আসছে। আর দুঃখজনক হলো, ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষা দেওয়ার মতো বিশেষ পোশাকও পর্যাপ্ত নেই মফস্বলে।

সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিনিয়ত ‘আমরা প্রস্তুত আছি’ কিংবা ‘সরকার প্রস্তুতি নিয়েছে’ বলে এত দিন যারা তথ্য দিয়েছেন, তারা আজ কী উত্তর দেবেন? দীর্ঘ তিন মাস আগে সবাই দেখেছি নভোচারীদের মতো বিশেষ সাদা পোশাক পরে সেবা দিতে ব্যস্ত বিভিন্ন দেশের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। করোনাভাইরাস শনাক্তকারী চীনের প্রথম ডাক্তারসহ বহু ডাক্তার, নার্স ও সেবাদানকারীর মৃত্যুর খবরও কারও অজানা নয়। অজানা নয় করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানোদের সৎকারের ক্ষেত্রে জটিলতার কথাও। তাহলে আজ মফস্বলে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাকল্পে বিশেষ পোশাক দিতে ব্যর্থতার দায় কে নেবে? কে নেবে করোনা শনাক্ত ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রদানে ব্যর্থতার দায়?

প্রবাসীদের নিয়ে ঢালাও, বিরূপ ও নিষ্ঠুর মন্তব্য মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন। চীনে করোনা উৎপত্তিস্থলে কোনো প্রবাসী ছিল না। সেখান থেকে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ বিমানে দেশে ফিরে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থেকে নিরাপদেই নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছেন। সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এরপর কোথায় কী হলো বোঝার আগেই শুরু হয়ে গেল প্রবাসীদের নিয়ে হৈচৈ। প্রথমত, জটিলতা দেখা দিল প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে। এটা বোঝা উচিত যে, বাংলাদেশ বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। আমরা পাশ্চাত্যের মতো একক পরিবারের স্থলে বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবসহ মিলেমিশে থাকি। নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজে একই ঘরে গাদাগাদি করে থাকাটাই আমাদের বাস্তবতা। সেখানে একজন প্রবাসীকে একটি ঘরে স্বেচ্ছায় বন্দী থাকার অছিয়ত কতটুকু বাস্তবসম্মত তা ভাবতে হবে। আরও ভাবতে হবে, একজন প্রবাসী বিশেষত নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবাসীরা হামেশা দেশে আসার সামর্থ্য রাখে না। আমার প্রবাসজীবনে এমন বহু প্রবাসীর সান্নিধ্যে এসেছি, যারা বিভিন্ন কারণে অবৈধভাবে প্রবাসে অবস্থান করছেন। তারা একবার দেশে এলে আর ফিরে যেতে পারবেন না। তাই যে কদিন পারা যায় প্রবাসেই তারা থাকেন। এই মেয়াদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০-১৫ বছরও পার হয়ে যায়। যদি তিন থেকে পাঁচ বছর পরও কেউ দেশে ফেরেন, তবু তাকে স্বেচ্ছায় একঘরে থাকার প্রস্তাবও বাস্তবসম্মত নয়। আবার অনেক প্রবাসীই দেশে আসেন নিজের বা নিকটাত্মীয়ের বিয়ে, অসুস্থ আপনজনদের মৃত্যুশয্যা কিংবা মৃত্যুজনিত ঘটনা কিংবা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার মতো বাস্তবতা মাথায় নিয়ে। সুতরাং ‘চাহিবা মাত্র তাহারা কোয়ারেন্টাইনে থাকিবেন’ কোনো বাস্তবসম্মত ভাবনা নয়। তবে সুপরিকল্পিতভাবে প্রবাসফেরতদের ১৪-১৫ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করা এবং তারা দেশে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম, প্রচারমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের মাধ্যমে প্রচার করা হলে তা অবশ্যই সবার নজরে পড়ত এবং প্রবাসীরা বুঝেশুনেই মাটিতে পা ফেলতেন। চোখে পড়ার মতো পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে এভাবে প্রবাসফেরতদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরতে দেওয়া এবং প্রশাসন তথা পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাদের বাড়িঘরে তল্লাশি করা বেদনাদায়ক। আবার প্রবাসীদের তল্লাশির সময় বকশিশ দাবি, রাস্তাঘাটে ধরে জরিমানা আদায়ও অনাকাক্সিক্ষত।

প্রিয় প্রবাসফেরত ভাই-বোনদের বলছি, জাতি আজ দুর্যোগের কবলে। তাই অতীত ভুলে ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি নিয়ে এগোতে হবে। একজন প্রবাসী যে অবর্ণনীয় কষ্টের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেন, তার বড় অংশ ভোগ করেন আত্মীয়স্বজন। কেননা কেবল একজন মানুষের চলার জন্য খুব বেশি অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন হয় না। সেই নিকটাত্মীয়দের নিরাপত্তাকল্পেই আসুন ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করি। অনেক দিন আপনজন ছেড়ে প্রবাসে থাকা যায়। কিন্তু দেশে ফেরার সময় বিমানের শেষ একটি ঘণ্টাও অসহ্য লাগে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে মন বিদ্রোহ করে। তবু বলব, এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকার কোনো বিকল্প নেই। এটা মানতেই হবে। মেনে নিন। নিজে বুঝুন, পরিবারকে বোঝান। এ রকম কোয়ারেন্টাইনে থাকার প্রথম সুফলভোগী হবে নিজ পরিবার, যাদের জন্য প্রবাসজীবনে এত কষ্ট। সুতরাং কোয়ারেন্টাইন কোনো শাস্তি নয়, তা বুঝতে হবে।

প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরজ করছি, প্রবাসীদের প্রতি মানবিক হোন। তারা মিশ্র প্রকৃতির। কেউ দেশের বাইরে নিজ দক্ষতা ও যোগ্যতায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কেউ খেয়ে না খেয়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। কেউ ভুল পথে প্রবাসে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন। আবার দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেশে ফিরছেন এমনও আছেন কেউ কেউ। তাই ঢালাওভাবে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একটু বুঝিয়ে বলুন। না বুঝতে চাইলে আলাদা করে ঊর্ধ্বতন কারও কাছে নিয়ে যান। তাতেও কাজ না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিন। তাই বলে ঢালাও মন্তব্য কাম্য হতে পারে না।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় শুধু ঢাকাকে গুরুত্ব দিলে চলবে না। সারা দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা সবার জানা। ইসলামাবাদকে সাজাতে গিয়ে অবহেলা করা হয়েছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে। ইতিহাসের আলোকে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ‘ঢাকা বাঁচলে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচবে’ পশ্চিমাদের এ রণকৌশলও ভুল প্রমাণিত হয়েছে একাত্তরে। লাখ লাখ প্রবাসী অধ্যুষিত বাংলাদেশকে অবহেলা করে কেবল ঢাকায় করোনা চিহ্নিত ও চিকিৎসা করার প্রবণতাও আত্মঘাতী হতে বাধ্য। সব গণমাধ্যম বলছে, করোনাভাইরাস চিকিৎসায় মফস্বল এখনো প্রস্তুত নয়। বিষয়টির দ্রুত অনুধাবন ও তদনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।

                লেখক : গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর